মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে গায়ে কেরোসিন ঢেলে পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টা ছাড়াও ফেনীর সোনাগাজীর ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ। এরমধ্যে ছাত্রীদের শ্লীলতাহানি, নাশকতা ও পুলিশের ওপর হামলা মামলায় তিনি তিন দফা কারাভোগ করেন। এছাড়াও মাদ্রাসায় গ্রুপিং, মাদ্রাসার অর্থ তছরুপের পাশাপাশি মাল্টি-পারপাস কোম্পানি খুলে অর্থ আত্মসাৎ, অন্য একটি মাদ্রাসা গড়ে চেক জালিয়াতির অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে।
জানা গেছে, স্থানীয়ভাবে শক্তিশালী একটি বলয় তৈরি করে মাদ্রাসার নিয়ন্ত্রণ শক্তভাবে নিজের হাতে রাখেন অধ্যক্ষ। আর এই চক্রে রয়েছেন ১০ থেকে ১২ জন। যে কারণে তার বিরুদ্ধে কেউ টুঁ শব্দটি করতে পারতেন না।
সরেজমিনে কথা বলে জানা গেছে, সিরাজ-উদ-দৌলা আশির দশকে ইসলামী ছাত্রশিবিরের রাজনীতির মাধ্যমে জামায়াতের রাজনীতিতে সক্রিয় হন। তারই ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে জামায়াতের রুকন হন।
সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার শিক্ষার্থী, অভিভাবক কমিটির সদস্য ও স্থানীয় রাজনীতিবিদরা জানান, ২০০১ সালের শুরুর দিকে তিনি সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেন। ২০১৬ সালের দিকেও তাকে জামায়াতের মিছিল-সমাবেশে দেখা যেতো। তবে পরবর্তী সময়ে তাকে আর জামায়াতের সভা-সমাবেশে দেখা যায়নি। ওই সময় থেকেই তিনি মূলত ক্ষমতাসীন দলের উপজেলা পর্যায়ের নেতাকর্মী ও স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন।
সিরাজ-উদ-দৌলার গড়ে তোলা আলোচিত চক্রের মধ্যে নিহত নুসরাত জাহান রাফির ভাইয়ের মামলায় আসামি হন পাঁচজন। তাঁরা হলেন আফছার উদ্দিন, মাকসুদ আলম, আবদুল কাদের, নুর উদ্দিন ও শাহাদাত হোসেন ওরফে শামীম। পুলিশ অভিযান চালিয়ে শুধু আফছার উদ্দিনকে গ্রেপ্তার করতে পারলেও বাকি সদস্যরা গা ঢাকা দিয়েছেন।
আসামিদের মধ্যে মাকসুদ আলম সোনাগাজী পৌরসভার ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও পৌর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক। একইসঙ্গে তিনি মাদ্রাসার পরিচালনা পর্ষদের সদস্য। অধ্যক্ষ সিরাজকে সব সময় সহায়তা দেন তিনি। গত ২৭ মার্চ অগ্নিদগ্ধ নুসরাতের শ্লীলতাহানির ঘটনার প্রতিবাদে সাধারণ মানুষ ও শিক্ষার্থীরা মানববন্ধন কর্মসূচিতে নামলে তিনি অধ্যক্ষের অনুগত লোকদের নিয়ে বাধা দেন। এতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার হয়। ফলে এ ঘটনায় সোনাগাজী সদরে আর কোনো কর্মসূচি পালিত হয়নি।
আর নুর উদ্দিন ও শাহাদাত হোসেন দুজনই মাদ্রাসার ছাত্র ছিলেন। অধ্যক্ষের যেকোনো অপকর্মের দোসর তারা। নুসরাতকে ২০১৭ সালে একবার চুন নিক্ষেপ করেন নুর উদ্দিন। স্থানীয়রা বলছেন, এ দুজনকে গ্রেপ্তার করতে পারলেই নুসরাতের ওপর হামলাকারী বোরকা পরা চারজনের পরিচয় মিলবে।
সিরাজ-উদ-দৌলার আরও যৌন হয়রানি
গত বছরের ৩ অক্টোবর অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা আলিম শ্রেণির এক ছাত্রীকে যৌন হয়রানি করেন। প্রতিকার চেয়ে মেয়েটির বাবা মাদ্রাসা পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের (রাজস্ব) কাছে অভিযোগ দিয়েছিলেন। চিঠির অনুলিপি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছেও দেওয়া হয়। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বরং তার যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে মুখ খুলে আরবি বিভাগের প্রভাষক আবুল কাশেম এবং জ্যেষ্ঠ শিক্ষক বেলায়েত হোসেন ও হাসান আহমেদ অধ্যক্ষের রোষানলে পড়েন। অধ্যক্ষ ওই তিন শিক্ষককে কারণ দর্শানোর চিঠি দেন। পরে তারা কোণঠাসা হয়ে যান।
সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসায় অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদানের আগে ফেনী সদর উপজেলার ধলিয়া ইউনিয়নের সালামতিয়া মাদ্রাসা থেকে বহিষ্কৃত হন এসএম সিরাজ-উদ-দৌলা। ওই মাদ্রাসার এক শিশুকে বলাৎকারের অভিযোগে তাকে বহিষ্কার করা হয়।
সিরাজ-উদ-দৌলা স্থানীয় প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপে নিজের অপকর্ম ধামাচাপা দেন অভিযোগ তুলে নাম প্রকাশ না করে কয়েকজন অভিভাবক জানান, যখনই সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে ‘অপকর্মে’র অভিযোগ উঠতো, তার কাছ থেকে কিছু ‘সুবিধা’ নিয়ে ওইসব অভিযোগ ধামাচাপা দিতো মাদ্রাসা কমিটির সহসভাপতি আওয়ামী লীগ নেতা রুহুল আমিন।
মাদ্রাসার নৈশপ্রহরীর ভাষ্য
গত ৬ এপ্রিল অগ্নিদগ্ধ ছাত্রী নুসরাতকে উদ্ধার করতে আসা দুজনের একজন হলেন মাদ্রাসার নৈশপ্রহরী মো. মোস্তফা। পুলিশের একজন সদস্যকে নিয়ে ওই মেয়েকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করেন তিনি।
অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা পরপর দুটি শ্লীলতাহানির ঘটনায় ধরা পড়েছে জানিয়ে মো. মোস্তফা বলেন, ‘এর আগেও নিজ দপ্তরে তাঁকে একাধিকবার মেয়েদের সঙ্গে আপত্তিকর অবস্থায় দেখেছি। দেখে ফেলায় তিনি আমাকে চাকরিচ্যুত করার হুমকি দেন।’
মোস্তফা আরও বলেন, ‘অধ্যক্ষের দপ্তর ছিল নিচতলায়। মেয়েদের সঙ্গে অশালীন আচরণের ঘটনা একাধিকবার আমার চোখে পড়েছে। তখন “সাপ ঢুকেছে, নিচতলার দপ্তর নিরাপদ নয়”বলে পাশের ভবনের দ্বিতীয় তলায় তিনি দপ্তর স্থানান্তর করেন।’
অন্যান্য মামলা ও কারাভোগ
ফেনীতে উম্মুল কুরা ডেভেলপার্স নামের একটি কথিত সমবায় প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ সিরাজ। এ প্রতিষ্ঠানের নামে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে জমা পাওয়া টাকা তিনি আত্মসাৎ করেন। এ ঘটনায় চেক প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় সিরাজ উদ দৌলার বিরুদ্ধে ১ কোটি ৩৯ লাখ ৪ হাজার টাকার মামলা হয়। এ বিষয়ে আদালতে দায়ের হওয়া মামলায় (সিআর ৯৪/১৮ নম্বর) আদালত গত বছরের ১০ জুলাই তাঁর জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠান। পরে জামিনে মুক্ত হন তিনি। এ ছাড়া তাঁর বিরুদ্ধে মাদ্রাসা তহবিলের ৪৩ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। ২০১৪ সালে নাশকতা ও পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় করা মামলায় সিরাজ উদ দৌলা ২০১৭ সালে কারাভোগ করেন। এছাড়াও, অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে তাকে নোয়াখালীর বসুরহাটের রঙ্গমালা ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসা থেকে চাকরিচ্যুত করা হয়।
সিরাজ-উদ-দৌলার অর্থিক দুর্নীতি ও অন্যান্য অপরাধের কথা উল্লেখ করে ফেনী জজ কোর্টের আইনজীবী জাহাঙ্গীর আলম জানান, ‘মাল্টি-পারপাস কোম্পানি খুলে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ আছে সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে। এ নিয়ে তার নামে মামলাও হয়। এ মামলা ছাড়াও আরও কমপক্ষে চার মামলায় গ্রেফতারও হন তিনি। এর মধ্যে ফেনী মডেল থানায় দায়ের হওয়া একটি নাশকতা মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি তিনি। সোনাগাজী থানায় দায়ের হওয়া দুটি ও আদালতে হওয়া আরও এক মামলায় তিনি জেল খাটেন।’
বিস্ময় প্রকাশ করে এ আইনজীবী আরও বলেন, ‘এমন একজন অপরাধী কীভাবে মাদ্রাসার অধ্যক্ষের চেয়ারে এতোদিন থাকলেন, চিন্তার বিষয়।’