প্রিয়াঙ্কা মজুমদার:
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে পণ্যের মূল্য পরিশোধের একটি নিরাপদ মাধ্যম হল লেটার অব ক্রেডিট। আমদানী রপ্তানিতে ক্রেতা এবং বিক্রেতা ভিন্ন দেশে অবস্থান করে বিধায় উভয়ের মধ্যে একটা আশংকা বিরাজ করে। ক্রেতা ভয় পায় পণ্য ঠিকঠাক মত বুঝে পাবে কিনা আর বিক্রেতার ভয় থাকে পণ্যমূল্য পাবে কিনা। এক্ষেত্রে লেটার অব ক্রেডিট হল সেই মাধ্যম যা ব্যাংকের মাধ্যমে বিক্রেতার মূল্য পরিশোধের এবং ক্রেতার কাছে তার পণ্য সঠিকভাবে প্রেরণের নিশ্চয়তা দেয়।
ঋণপত্র বা লেটার অব ক্রেডিটের সংক্ষিপ্ত রুপ হচ্ছে L/C ইতালি ভাষায় যাকে বলে Lettera di creditio, ফ্রেঞ্চ ভাষায় “accreditation” বলা হয় এবং ল্যাটিন “accreditivus” যার অর্থ হল “বিশ্বাস”। এই Letter Of Credit বা L/C মূলতঃ ব্যাংকের দেয়া এক ধরনের গ্যারান্টি যার মাধ্যমে আমদানিকারক ও রপ্তানীকারকের মধ্যে বিশ্বস্ততা অর্জিত হয় এবং তারা এই মর্মে নিশ্চিত হয়ে যে বিক্রেতা তার পণ্যের মূল্য পাবে এবং ক্রেতাও নিশ্চিত হয় যে তার হাতে পণ্য না আসা পর্যন্ত কোন লেনদেন সম্পন্ন হবে না।
লেটার অব ক্রেডিটের সাথে কিছু পক্ষ জড়িত থাকে। তারা হলেনঃ
১) এপ্লিকেন্টঃ যার অনুরোধে ব্যংক L/C খোলে। বায়ার, আমদানি কারক, কাস্টমার হচ্ছেন এপ্লিকেন্ট।
২) বেনিফিশিয়ারিঃ বেনিফিশিয়ারি হলেন রপ্তানি কারক বা সেলার যার অনুকূলে ব্যাংক L/C খুলে থাকে।
৩) ইস্যুয়িং ব্যাংকঃ এই ব্যাংক বায়ার বা আমদানি কারকের পক্ষে LC ইস্যু করে। এটাকে আবার ওপেনিং ব্যাংক ও বলা হয়।
৪) এডভাইজিং ব্যাংকঃ এডভাইজিং ব্যাংক হল ওপেনিং ব্যাংকের প্রতিনিধি। ওপেনিং ব্যাংকের অনুরোধে এই ব্যাংক ঋণপত্র সুবিধা প্রদান করে। এই ব্যাংক রপ্তানিকারকের দেশে অবস্থিত। এডভাইজিং ব্যাংক কোন কনফার্মিং ব্যাংক নয়।
৫) নমিনেটেড ব্যাংকঃ নমিনেটেড ব্যাংক হল সেই ব্যাংক যেখানে ঋণপত্র সুলভ। এই ব্যাংক সর্বদা ঋণপত্রের মূল্য পরিশোধ করতে প্রস্তুত থাকে।
৬) কনফার্মিং ব্যাংকঃ ইস্যুয়িং ব্যাংক পণ্যমূল্য পরিশোধ করতে না পারলে কনফার্মিং ব্যাংক তা পরিশোধ করবে। এই ব্যাংক সাধারণত এডভাইজিং ব্যাংক হিসেবেও কাজ করে এবং ঋণপত্রের নিশ্চয়তা দিয়ে থাকে।
৭) রিইমবার্সিং ব্যাংকঃ এই ব্যাংক ইস্যুয়িং ও নমিনেটেড ব্যাংক বা কনফার্মিং ব্যাংকের মধ্যে মীমাংসাকারী হিসেবে কাজ করে।
লেটার অব ক্রেডিটের কিছু পর্যায় রয়েছে যেমনঃ
১) আমদানিকারক এবং রপ্তানিকারকের মধ্যে একটি চুক্তি সম্পন্ন হয়।
২) আমদানিকারক ইস্যুয়িং ব্যাংকের মাধ্যমে L/C’র জন্য আবেদন করে।
৩) ইস্যুয়িং ব্যাংক লেটার অব ক্রেডিট ইস্যু করে এবং আমদানিকারকের নির্দেশে এডভাইজিং বাংকে পাঠায়।
৪) এডভাইজিং ব্যাংক লেটার অব ক্রেডিটের নির্ভরযোগ্যতা যাচাই করবে তারপর রপ্তানিকারকের কাছে একটা কপি পাঠাবে।
৫) রপ্তানিকারক লেটার অব ক্রেডিট পরীক্ষা করবে এবং L/C’র টার্মস ও কন্ডিশন ঠিক আছে মর্মে আমদানিকারকের সাথে বাণিজ্য করার একটা সিদ্ধান্তে আসবে।
৬) যদি রপ্তানিকারক দেখে যে L/C তে উল্লেখিত শর্তাবলীর সাথে বাণিজ্য চুক্তির কোন সাদৃশ্য নেই তাহলে তাৎক্ষণিকভাবে আমদানিকারককে জানাবে এবং সংশোধনের অনুরোধ জানাবে।
৭) রপ্তানিকারক যখন সংশোধিত L/C বা নথি পায় তখন পণ্য চালানের ব্যাবস্থা করবেন।
৮) রপ্তানীকারক মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে তার ব্যাংকে নথি উপস্থাপন করে। ক্রেডিট পত্র অনুযায়ী ব্যাংক নথিগুলি চেক করে এবং ইস্যুকারী ব্যাংকের কাছে তা প্রেরণ করে।
৯) ইস্যুকারী ব্যাংক ক্রেডিট শর্তাবলী মেনে চলা নিশ্চিত করার জন্য নথি পরীক্ষা করে এবং সেই নথি আমদানিকারকের কাছে পাঠায় যার মাধ্যেমে আমদানিকারক পণ্য গ্রহণের জন্য প্রস্তুত হয়।
১০) ব্যাংকের মাধ্যমে রপ্তানিকারক পেমেন্ট প্রাপ্ত হয়, আমদানিকারক মালামাল বুঝে পায় পায়।
এভাবে উপরোক্ত প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেন সমাপ্ত হয়।
বিভিন্ন ধরনের লেটার অব ক্রেডিটঃ
১) রিভোকেবলঃ যেকোন সময় ক্রেতার মাধ্যমে বা ইস্যুয়িং ব্যাংকের মাধ্যমে পরিবর্তন করা যায়। এক্ষেত্রে বেনিফিশিয়ারিকে নোটিশ দেয়ার দরকার নেই।
২) ইরেভোকেবলঃ উভয়পক্ষ একমত না হলে ইস্যুয়িং ব্যাংক লেটার অব ক্রেডিটের কোন পরিবর্তন করতে পারবে না।
৩) স্ট্যান্ডবাইঃ স্ট্যান্ডবাই L/C যেকোন ভুলের ক্ষেত্রে সেলারকে পেমেন্ট প্রেরণের নিশ্চয়তা প্রদান করে।
৪) কনফার্মডঃ যখন এডাভাইজিং ব্যাংক বিক্রেতাকে পেমেন্টের নিশ্চয়তা দেয়।
৫) আনকনফার্মডঃ একমাত্র ইস্যুয়িং ব্যাংকের মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয় সেকেন্ড ব্যাংকের নিশ্চয়তার দরকার করা হয় না।
৬) রিভলভিং: আমদানিকারক ও রপ্তানিকারকের মধ্যে কতিপয় দেনা পাওনা মেটাতে সমর্থ রিভলভিং L/C.
৭) ব্যাক টু ব্যাকঃ রপ্তানিকারকের অনুকূলে এলসি খোলার পর যখন পণ্য সরবরাহ করার মতো প্রয়োজনীয় মূলধন রপ্তানিকারকের থাকে না তখনই ব্যাক টু ব্যাক এলসি ইস্যু হয়ে থাকে। ব্যাক টু ব্যাক এল সি’র মাধ্যমে রপ্তানিকারক রপ্তানির উদ্দেশ্যে পণ্য ক্রয়, প্রক্রিয়াজাতকরণ, প্রস্তুতকরণ এবং প্যাকেজিং এর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের বন্দোবস্ত করে।
৮) রেড ক্লজঃ বিক্রেতার কাছ থেকে লিখিত অনুমোদন পাওয়ার পর পণ্য প্রেরণ করার পূর্বেই অগ্রীম অর্থ প্রদান করা হয়।
৯) ডাইরেক্ট পেঃ এই লেটার অব ক্রেডিটে ইস্যুয়িং ব্যাংক বেনিফিশিয়ারিকে ডাইরেক্টলি অর্থ পরিশোধ করে।
১০) ডিফারড পেমেন্টঃ এই L/C তে বিলম্বে অর্থ পরিশোধ করা যায়। এটি Usance LC নামেও পরিচিত।
লেটার অব ক্রেডিটের সুবিধা ও অসুবিধাঃ
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে এক দেশ থেকে আরেক দেশে পণ্য ক্রয় বিক্রয়ের মধ্যে একটা ঝুঁকি থাকে। দুইটি ভিন্ন দেশের মধ্যে বাণিজ্য স্থাপনে নিশ্চিত গ্যারান্টি দিয়ে থাকে লেটার অব ক্রেডিট। এটি অর্থ পরিশোধ এবং প্রাপ্তির একটি নিরাপদ মাধ্যম। এর ফলে বিক্রেতা এ ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারেন যে, সে কত টাকা পাবে কোন সময়ে পাবে। অবশ্য এজন্য তাকে এল সি-তে বর্ণিত শর্ত পুরোপুরি ভাবে পালন করতে হয়। অর্থ না পাওয়ার ঝুঁকি এল সি-তে ব্যক্তির থেকে ব্যাংকের কাছে স্থানান্তর হয়। অপরদিকে এলসি ব্যবহারের ক্ষেত্রে ক্রেতা বুঝতে পারে যে, বিক্রেতা তার শর্ত সঠিকভাবে পূরণ করেছে কারণ প্রতিটি ধাপে তাকে ডকুমেন্টারি এভিডেন্স ব্যাংকে জমা দিতে হয়। ফলে ক্রেতার মনে পণ্য ঠিকমতো না পাওয়ার যে আশংকা সেটা আর থাকেনা।
লেটার অব ক্রেডিট এর অসুবিধা হলো এটি ব্যবহারের ফলে ক্রেতা বিক্রেতা উভয়কেই অতিরিক্ত অর্থ খরচ বহন করতে হয়। এটি প্রতিপালনের জন্য ব্যাংক একটি নির্দিষ্ট হারে চার্জ আদায় করে। লেটার অব ক্রেডিট ব্যবহারের ফলে পণ্য ডেলিভারিতে দেরি হতে পারে।
L/C খুলতে যা প্রয়োজন
L/C খুলতে সবার প্রথমে একটা ব্যাংক একাউন্ট থাকতে হবে। এরপর ব্যাংক সাধারণত যে ডকুমেন্টস গুলো চায় তা হলোঃ
১) সেই ব্যাংক এ কোম্পানীর নামে একটা একাউন্ট
২) কোম্পানির ট্রেড লাইসেন্স
৩) যে পন্য আনা হবে তার ইনডেন্ট কালেক্ট করা। যেমনঃ কেউ যদি কোরিয়া থেকে কোন পণ্য আমদানি করতে চায় তাহলে যে কোম্পানী থেকে পণ্য আনবে সে কোম্পানীর বাংলাদেশ প্রতিনিধির কাছে গিয়ে দাম ঠিক করে একটা ডকুমেন্ট নেবে। এটাই ইনডেন্ট। আর সে কোম্পানীর যদি বাংলাদেশ প্রতিনিধি না থাকে তাহলে সে কোম্পানীতে সরাসরি মেইল করে দাম ঠিক করে ডকুমেন্ট আনবে। তখন এটাকে বলা হয় পি আই বা প্রফরমা ইনভয়েস। এতে পণ্যের বিস্তারিত, দাম, পোর্ট অব শিপমেন্ট এসব তথ্যাদি থাকে।
৪) ব্যাংক থেকে L/C ফর্ম সংগ্রহ করে তা পূরন করে ব্যাংক এ জমা দেয়া।
৫) এলসি মার্জিন জমা দেয়া । অর্থাৎ ব্যাংক এ টাকা জমা দিতে হবে।
৬) টিন সার্টিফিকেট
৭)ভ্যাট সার্টিফিকেট
৮) জাতীয় পরিচয় পত্র কপি
৯) ব্যাংক চুক্তি সংক্রান্ত ডকুমেন্ট
১০) গ্যারান্টি ফরম ইত্যাদি
এরপর ব্যাংক L/C হোল্ডারকে এলসির একটা কপি দেবে। অরিজিনালটা পাঠিয়ে দেবে বিদেশে সেলারের কাছে।
সবশেষে একটি কথা, লেটার অব ক্রেডিট ডকুমেন্ট নিয়ে কাজ করে, সঠিক পণ্যের নিশ্চয়তা দেয় না। বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী সমস্ত আমদানি লেটার অব ক্রেডিটের মাধ্যমে সম্পন্ন হতে হবে। চৌধুরী এন্ড হাবিবের (২০০৬) তথ্য মতে, বাংলাদেশে আমদানি পেমেন্টের ৯৭% এবং রপ্তানি পেমেন্টের ৬৫% লেটার অব ক্রেডিটের মাধ্যমে হয়ে থাকে।
লেখক : আইনজীবী, ফেনী জজ কোর্ট।