কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের মোচাগড়া গ্রামের দিনমজুর আবদুল মতিন। ১৭ মাসের বকেয়া বিদ্যুৎ বিলের দায়ে গত ১৬ এপ্রিল তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরদিন আদালতে হাজির করা হলে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। অথচ দরিদ্র মতিনের বাড়িতে তখনও পৌঁছেনি বিদ্যুতের সংযোগ। চাঞ্চল্যকর এ ঘটনা নিয়ে তোলপাড় শুরু হলে একটি বেসরকারি সংস্থার সহায়তায় বিষয়টি ১৮ এপ্রিল আদালতের নজরে আনেন কুমিল্লার আইনজীবীরা। এর পরিপ্রেক্ষিতে ওই দিন দুপুরেই মতিনকে জামিন দেন কুমিল্লার চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সোহেল রানা। এরপর সন্ধ্যায় কারাগার থেকে মুক্তি পান তিনি।
শুধু মতিন নন, দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় নানাভাবে হয়রানির শিকার হলেও আইনি মারপ্যাঁচে বা অর্থিক অনটনের কারণে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত রয়েছেন হাজারো ভুক্তভোগী। কখনও বা তারা আইনি সহায়তা পান, নয়তো কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্টেই কেটে যায় বহু বছর। এসব পরিস্থিতিতে তাদের পাশে এসে সরকারি খরচে আইনি সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা (লিগ্যাল এইড) ও বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা। তবুও গণমাধ্যমেই বিভিন্ন সময়ে উঠে আসছে বিনা বিচারে বা অন্যের সাজা ভোগ করার মতো চাঞ্চল্যকর ঘটনা। এমনই এক ঘটনায় গত ২৩ এপ্রিল ভুল আসামি হয়ে তিন বছর ধরে কারাগারে থাকা রাজধানীর পল্লবীর বেনারসি কারিগর মো. আরমানের মুক্তির বিষয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট। পাশাপাশি ওই মামলার যাবতীয় নথি সাত দিনের মধ্যে হাইকোর্টে পাঠাতেও ঢাকার মহানগর দায়রা জজকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
লিগ্যাল এইডের তথ্যনুযায়ী, সরকারি খরচে গত ১০ বছরে তিন লাখ ৯৩ হাজার ৭৯০ জনকে আইনি সেবা দেওয়া হয়েছে। যাদের মধ্যে ৬৬ হাজার ৪০২ জন কারাবন্দি ছিলেন। সরকারি সংস্থার উদ্যোগ না থাকলে তাদের অনেককেই বহু বছর বিচারের দীর্ঘসূত্রতায় বা বিনা বিচারেই কারাগারে থাকতে হতো। আর এ সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে এ বছর জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলায় শেখ হাসিনার অবদান, বিনামূল্যে লিগ্যাল এইডে আইনি সেবাদান’।
আজ রোববার (২৮ এপ্রিল) ‘জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস’। দিবসটি উপলক্ষে পৃথক বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আজ সকাল সাড়ে ১০টায় রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল মিলনায়তনে জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবসের কেন্দ্রীয় অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছে। এর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ঢাকার পাশাপাশি জেলা ও উপজেলাগুলোতেও দিবসটি উপলক্ষে শোভাযাত্রা, গোলটেবিল আলোচনা, নাটক, মাইকিং, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন কর্মসূচি আয়োজন করা হয়েছে।
২০০০ সালের ২৮ এপ্রিল জাতীয় সংসদে আইনগত সহায়তা প্রদান আইন পাস হওয়ার পর ২০০১ সালে জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা প্রতিষ্ঠা করে সরকার। কিন্তু জনবল ও বিধির অভাবে প্রায় আট বছর অকার্যকর ছিল সংস্থাটি। ২০০৯ সালে সংস্থাটিকে ঢেলে সাজানো হয়। এখন দেশের ৬৪টি জেলায় লিগ্যাল এইডের কার্যালয় ও স্থানীয় কমিটি রয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গণমাধ্যমকে বলেন, আর্থিকভাবে অসচ্ছল, সহায়সম্বলহীন এবং নানাবিধ আর্থসামাজিক কারণে বিচার পেতে অসমর্থ বিচারপ্রার্থী মানুষকে আমরা আইনগত সহায়তা দিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু এই কার্যক্রম সফল করতে প্রয়োজন জনসচেতনতা। কারণ, এখনও দেশের মানুষের একটি অংশ দরিদ্র ও নিরক্ষর। তারা তাদের আইনগত অধিকার সম্পর্কে সচেতন নয়। এসব বিষয়কে গুরুত্ব দিয়েই সরকার নানা প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে, যার সুফল এরই মধ্যে মানুষ পেতে শুরু করেছে। তিনি আরও বলেন, সংবিধান অনুযায়ী সব নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করতে বর্তমান সরকার লিগ্যাল এইড কার্যক্রমকে সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। এটি অব্যাহত থাকবে।
জাতীয় আইনগত সহয়তা সংস্থার তথ্যনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০১৯ সালের মার্চ পর্যন্ত সারাদেশে তিন লাখ ৯৩ হাজার ৭৯০ জনকে বিনামূল্যে আইনগত সহায়তা দেওয়া হয়েছে। এদের মধ্যে দুই লাখ ৪০ হাজার ২১৮ জনকে মামলায় সহায়তা, এক লাখ ১৮ হাজার ৩১৫ জনকে আইনি পরামর্শ সেবা, ১৭ হাজার ৯২৯ জনকে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি সেবা এবং হটলাইন ও জাতীয় হেল্পলাইনের মাধ্যমে ৭০ হাজার ৭৫৬ জনকে তথ্যসেবা দেওয়া হয়েছে। আইনগত সহায়তাপ্রাপ্তদের মধ্যে ৬৬ হাজার ৪০২ জন কারাবন্দিও ছিলেন। এদিকে, ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে সুপ্রিম কোর্টেও লিগ্যাল এইড কমিটির কার্যক্রম শুরু হয়েছে। গত ৩০ মার্চ পর্যন্ত জেল আপিলসহ দেওয়ানি ও ফৌজদারি মিলিয়ে দুই হাজার ৪৩৭টি মামলা লিগ্যাল এইডের আওতায় নিষ্পত্তি করা হয়েছে। বর্তমানে হাইকোর্টের একাধিক বেঞ্চ বিচারের দীর্ঘসূত্রতা ও বিনা বিচারে কারাগারে আটক কয়েদিদের লিগ্যাল এইডের আওতায় আইনি সহয়তা দিতে তৎপর রয়েছেন।
এ বিষয়ে জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার পরিচালক জেলা জজ মো. আমিনুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, সরকারের নানা উদ্যোগের কারণে কয়েক বছর ধরে সরকারি খরচে আইনি সেবা গ্রহণের হার ক্রমে বাড়ছে। আমরা আশা করছি, সবার প্রচেষ্টায় এ কার্যক্রম আরও এগিয়ে যাবে। বর্তমানে ৫৮টি জেলায় পূর্ণকালীন লিগ্যাল এইড কর্মকর্তা রয়েছেন বলে জানান তিনি। সমকাল