বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মতো সরকারের আইন মন্ত্রণালয় ও বিচার বিভাগেরও যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। সরকারের ১১ বছরে প্রায় দেড় কোটি মামলার নিষ্পত্তি করা হয়েছে। হিসাবমতে, এখন প্রতি বছর গড়ে ১২ লাখের বেশি মামলার নিষ্পত্তি হচ্ছে। বিচার বিভাগের এমন অগ্রগতির পেছনে রয়েছে সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টা। বিচার বিভাগের সক্ষমতা বাড়াতে সরকার বিচারক নিয়োগের পাশাপাশি অবকাঠামো উন্নয়নে মনোযোগী হয়েছে। এর ফলে এ সময়ে এত বিশালসংখ্যক মামলার নিষ্পত্তি সম্ভব হয়েছে।
সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টে প্রশাসনের উদ্যোগে মামলার পরিসংখ্যানমূলক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৮ সাল থেকে এ বছরের মার্চ পর্যন্ত ১১ বছরে দেশে এক কোটি ৩৮ লাখ ৬৩ হাজার ২৫০টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। এ হিসাবে প্রতি বছর গড়ে ১২ লাখের বেশি মামলা নিষ্পত্তি করা হচ্ছে। প্রতিবেদনের নির্ধারিত সময়ের পর কয়েক মাসে আরও কয়েক লাখ মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। সেই হিসাবে, এখন পর্যন্ত প্রায় দেড় কোটি মামলার নিষ্পত্তি করেছেন আদালত। তবে একই সময়ে নতুন করে দায়ের ও পুনর্জীবিত হয়েছে এক কোটি ৫৯ লাখ ৫ হাজার ৬৬১টি মামলা। মামলা নিষ্পত্তির তুলনায় মামলা দায়েরের সংখ্যা ২০ লাখেরও বেশি।
সর্বোচ্চ আদালতের রায় অনুযায়ী, ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা হয়ে বিচার বিভাগের আলাদা পথচলা শুরু হয়। সে সময় বিভিন্ন আদালতে এজলাসের সংখ্যা ছিল অপ্রতুল। বিচারকরা এজলাস ভাগাভাগি করে কাজ চালাতে থাকেন। এতে করে বিচারপ্রার্থী জনগণের ভোগান্তি বাড়ার পাশাপাশি মামলার জটও বাড়তে থাকে। বিচারক স্বল্পতা, এজলাস সংকট, সীমিত অবকাঠামো, জনবল সংকট, অপ্রতুল বাজেটসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত হয়ে ধীরগতিতে চলতে থাকে মামলার কার্যক্রম। এ অবস্থায় ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার দেশের দায়িত্ব নেয়। দায়িত্ব নেওয়ার পরই সরকার বিচার বিভাগের অবকাঠামো উন্নয়নে বিশেষ উদ্যোগ নেয়।
একই সঙ্গে বিচারক নিয়োগ শুরু হয়। বর্তমানে উচ্চ আদালত ও অধস্তন আদালত মিলিয়ে বিচারকের সংখ্যা প্রায় ১৮শ’। ২০০৮ সালে এ সংখ্যা ছিল এক হাজারের মতো।
নিয়োগ দেওয়ার পরও দেশে বিচারক স্বল্পতা বিদ্যমান রয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়, দেশে প্রতি ১০ লাখ মানুষের জন্য বিচারক আছেন মাত্র একজন। ভারত, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশে জনসংখ্যা অনুপাতে বিচারকের সংখ্যা অনেক বেশি। প্রতি বছর আইন প্রণয়নের মাধ্যমে নতুন নতুন আদালত ও ট্রাইব্যুনাল সৃষ্টি করা হলেও সে অনুযায়ী বিচারক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না। একই ব্যক্তিকে একাধিক আদালত ও ট্রাইব্যুনালের দায়িত্ব দেওয়ায় তাদের ওপর চাপ বাড়ছে।
সম্প্রতি আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সংসদে জানান, গত ৩১ মার্চ পর্যন্ত দেশের নিম্ন আদালত থেকে সর্বোচ্চ আদালতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৩৫ লাখ ৮২ হাজার ৩৪৭টি। এর মধ্যে হাইকোর্টে বিচারাধীন মামলা ৫ লাখ ৬ হাজার ৬৬৪টি। আপিল বিভাগে বিচারাধীন রয়েছে ২১ হাজার ৮১৩টি মামলা। হাইকোর্টে দেওয়ানি মামলা ৯৬ হাজার ১১৪টি, ফৌজদারি মামলা ৩ লাখ ১৭ হাজার ৪৪৩টি ও অন্যান্য মামলা ৯৩ হাজার ১০৭টি। আপিল বিভাগে দেওয়ানি মামলা ১৪ হাজার ২৩টি, ফৌজদারি মামলা ৭ হাজার ৬৫৫ ও অন্যান্য মামলা ১৩৫টি। এ ছাড়া অধস্তন আদালতে বিচারাধীন মামলার মধ্যে দেওয়ানি ১৩ লাখ ২৮ হাজার ৬শ’টি ও ফৌজদারি ১৭ লাখ ২৫ হাজার ২৭০টি।
প্রতিবেদনে জানানো হয়, বর্তমানে দেশে অধস্তন আদালতে ৫ বছরের পুরনো দেওয়ানি মামলার সংখ্যা ৩ লাখ ৪৯ হাজার ৭১৮ ও ফৌজদারি মামলার সংখ্যা ২ লাখ ৩৬ হাজার ১১৬। মোট মামলার ১৯ দশমিক ১৮ শতাংশ ৫ বছরের পুরনো। আর নিষ্পত্তির হার ৮৭ দশমিক ১৫ শতাংশ। দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি নতুন নতুন অপরাধের কারণে মামলার সংখ্যাও বাড়ছে। তবে সরকার নিষ্পত্তির সক্ষমতা বাড়াতে নানা ধরনের উদ্যোগ নিচ্ছে।
বিচার বিভাগের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও মামলা নিষ্পত্তির হারে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন বিশিষ্টজন। সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেন, এটা সরকারের অনেক বড় সাফল্য। বিচার বিভাগ কাজ করছে, এটাই তার বড় প্রমাণ। তিনি বলেন, দেশে জনসংখ্যার পাশাপাশি মামলাও প্রতিনিয়ত বাড়ছে। সে ক্ষেত্রে বিচার বিভাগের জন্য বাজেট আরও বাড়াতে হবে। বিচারক নিয়োগ দিতে হবে ও আদালত ভবন নির্মাণ করতে হবে। তিনি আরও বলেন, বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির (এডিআর) মাধ্যমে মামলাজট কমানো সম্ভব। অন্যান্য দেশের মতো আমাদেরও এডিআরকে যুগোপযোগী ও গতিশীল করতে হবে।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এএম আমিনউদ্দিন বলেন, এত মামলা নিষ্পত্তি করা বিশাল ব্যাপার। সরকারের অনেক সাফল্যের মধ্যে এটি অন্যতম। তিনি বলেন, উচ্চ আদালত ও নিম্ন আদালতে মামলাজট কমাতে হলে আরও বিচারক নিয়োগ দিতে হবে। পাশাপাশি সরকারকে নানামুখী পদক্ষেপ নিতে হবে। বিচার বিভাগকে আরও উন্নত ও আধুনিক হতে হবে। আদালতে সঠিক ব্যবস্থাপনা থাকলে মামলা নিষ্পত্তির হার আরও বাড়বে।
সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র স্পেশাল অফিসার ব্যারিস্টার সাইফুর রহমান বলেন, বিচার বিভাগের জন্য এটা অভাবনীয় সাফল্য। বিচারকদের কর্মপন্থা ও কমিটমেন্টের কারণে এটা করা সম্ভব হয়েছে। কারণ প্রত্যেক বিচারক নিজের দায়িত্ব সম্পর্কে অনেক সচেতন।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, বর্তমান সরকার বিচারপ্রার্থী জনগণের ভোগান্তি লাঘব করতে চায়। এজন্য আধুনিক বিচার বিভাগ ও বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে সরকার। এসব পদক্ষেপ বাস্তবায়ন হলে দেশে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা সহনীয় পর্যায়ে আসবে। মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে কার্যকর ও দৃশ্যমান উন্নয়ন সাধিত হবে। সূত্র : সমকাল