সুশাসন, নারী ও শিশু নির্যাতন, সন্ত্রাস-জঙ্গি, মাদক, খাদ্যে ভেজালসহ বিভিন্ন বিষয়ে জেলা প্রশাসকদের ৩১টি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে পাঁচ দিনব্যাপী জেলা প্রশাসক (ডিসি) সম্মেলনের উদ্বোধনকালে এসব নির্দেশনা দেন তিনি।
আজ রোববার (১৪ জুলাই) সকালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের শাপলা হলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাঁচ দিনব্যাপী এ সম্মেলনের উদ্বোধন করেন। সম্মেলন শেষ হবে ১৮ জুলাই।
জেলা প্রশাসকদের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনাগুলো হলো-
(১) ২০২০ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে তৃণমূল পর্যন্ত উদযাপনের লক্ষ্যে আপনাদের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
(২) ২০২১ সালে বঙ্গবন্ধুর আজীবন লালিত স্বপ্নের ‘সোনার বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করতে হবে।
(৩) সরকারি সেবা গ্রহণে সাধারণ মানুষ যাতে কোনোভাবেই হয়রানি বা বঞ্চনার শিকার না হন, সেদিকে অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে।
(৪) জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস ও সাম্প্রদায়িকতা দূর করে সর্বক্ষেত্রে শান্তি-শৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে আপনাদের আরও সতর্কতার সঙ্গে এবং কঠোরভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে।
(৫) যুব সমাজকে মাদকের হাত থেকে রক্ষা করতে মাদকবিরোধী অভিযান অব্যাহত রাখতে প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নিতে হবে।
(৬) গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন, সম্ভাবনাময় স্থানীয় ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিকাশ এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে দারিদ্র্যবিমোচনে আপনাদের ব্রতী হতে হবে।
(৭) তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির উন্নয়ন ও বিকাশে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দিতে হবে। দৈনন্দিন প্রয়োজনে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ক্রমবর্ধমান ব্যবহারে জেলার সাধারণ জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
(৮) তৃণমূল পর্যায়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে কাজ করতে হবে।
(৯) শিক্ষার সব স্তরে নারীশিক্ষার হার বৃদ্ধি, শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয় ত্যাগের হার হ্রাস ও ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের মূলধারায় ফিরিয়ে আনার পদক্ষেপ নিতে হবে।
(১০) ভূমি প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা, দক্ষতা বৃদ্ধি এবং সরকারি ভূমি রক্ষায় সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।
(১১) কৃষি-উৎপাদন বৃদ্ধিতে সার, বীজ, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ইত্যাদির সরবরাহ নির্বিঘ্ন করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নিতে হবে।
(১২) ভেজাল খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন, পরিবহন ও বাজারজাতকরণ প্রতিরোধে ব্যাপক গণসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে এবং এ ধরনের অনৈতিক কর্মকাণ্ড কঠোর হস্তে দমন করতে হবে।
(১৩) দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণে কমিউনিটি ক্লিনিকের কার্যক্রম আরও জোরদার করতে হবে।
(১৪) পরিবেশ রক্ষায় জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং এ সংক্রান্ত আইন ও বিধি-বিধানের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
(১৫) প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বিপর্যয় প্রশমনে ‘দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১২’ এবং এ সংক্রান্ত স্থায়ী নির্দেশনাবলি অনুসারে সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নিতে হবে।
(১৬) সাধারণ মানুষকে সহজে সুবিচার ও আদালতে মামলার জট কমাতে গ্রাম আদালতগুলিকে কার্যকর করতে হবে।
(১৭) জেলা প্রশাসকগণ জেলাপর্যায়ে বিভিন্ন কমিটির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এসব কমিটিকে সক্রিয়, গতিশীল ও ফলপ্রসূ করতে হবে।
(১৮) দপ্তরগুলোতে বিদ্যমান সেবা তৃণমূলে পৌঁছানোর লক্ষ্যে তথ্য মেলা, সেবা সপ্তাহ পালনসহ ইত্যাদি কার্যক্রম জোরদার করতে হবে।
(১৯) শিল্পাঞ্চলে শান্তি রক্ষা, পণ্য-পরিবহন ও আমদানি-রপ্তানি নির্বিঘ্ন করা এবং চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, পেশিশক্তি ও সন্ত্রাস নির্মূল করার ব্যবস্থা নিতে হবে।
(২০) বাজার-ব্যবস্থার সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণের প্রতি গুরুত্বারোপ করতে হবে। ভোক্তা-অধিকারকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হবে এবং বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির যে কোনো অপচেষ্টা কঠোর হস্তে দমন করতে হবে।
(২১ নারী ও শিশু নির্যাতন এবং পাচার, যৌতুক, ইভটিজিং ও বাল্যবিবাহের মতো সামাজিক ব্যাধি থেকে মুক্তির জন্য আপনাদের দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে হবে।
(২২) নারীর প্রতি সহিংসতা, নিপীড়ন ও বৈষম্যমূলক আচরণ বন্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
(২৩) শিশু-কিশোরদের পুষ্টিচাহিদা পূরণ এবং তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের লক্ষ্যে শিক্ষা, ক্রীড়া, বিনোদন ও সৃজনশীল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। শিশু-কিশোরদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, সংস্কৃতিবোধ ও বিজ্ঞানমনস্কতা জাগিয়ে তুলতে হবে।
(২৪) প্রতিবন্ধী, অটিস্টিক ও পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর কল্যাণে বিশেষ পদক্ষেপ নিতে হবে।
(২৫) পার্বত্য জেলাগুলোর উন্নয়ন ত্বরান্বিতকরণের পাশাপাশি এ অঞ্চলের ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য, বনাঞ্চল, নদী-জলাশয়, প্রাণিসম্পদ ও গিরিশৃঙ্গগুলির সৌন্দর্য সংরক্ষণ করতে হবে। এছাড়া, পর্যটনশিল্প, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প এবং কুটিরশিল্পের বিকাশে সর্বাত্মক সহযোগিতা দিতে হবে।
(২৬) বর্জ্যব্যবস্থাপনায় কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত এ ব্যবস্থা নিতে হবে। আমাদের নদীগুলো দূষিত হয়ে গেছে। এখন থেকে পরিকল্পিতভাবে বর্জ্য ব্যবস্থাপণা করতে হবে।
(২৭) জেলাগুলোর আকার ভিন্ন, জেলার আয়তন, জনসংখ্যা, প্রাকৃতিক পরিবেশ, জেলার চাহিদা সব কিছু বিবেচনা করে উন্নয়ন পরিকল্পনা নিতে হবে।
(২৮) স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করা। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, জনগণের কল্যাণ ও জীবনমান উন্নয়নের দিকে বিশেষভাবে লক্ষ্য রেখে উন্নয়ন প্রকল্প ও কর্মসূচি নেওয়া।
(২৯) মানুষের চিত্তবিনোদনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া। স্কুল কলেজের মাঠে নয়, আলাদা মাঠে মিনি স্টেডিয়ামের ব্যবস্থা করা, শহর থেকে একটু দূরে হলেও।
(৩০) গৃহহারা, ভূমিহীন- একটি মানুষও গৃহহারা থাকবে না। তাদের পুনর্বাসন করা।
(৩১) সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রেখে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, হিজড়া, বেদে ও প্রতিবন্ধীদের প্রতি বিশেষ লক্ষ্য রাখতে হবে। জলাধার সংরক্ষণের নিমিত্তে খাল খনন ও পুকুর খনন করতে হবে। পরিকল্পিত নগরায়ন ও বনায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে অন্যদের মধ্যে মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম, প্রধানমন্ত্রী মুখ্য সচিব মো. নজিবুর রহমান।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন, খুলনা বিভাগীয় কমিশনার লোকমান হোসেন মিয়া, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক ইলিয়াস হোসাইন, শেরপুর জেলা প্রশাসক আনারকলি মাহবুব, টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসক শহীদুল ইসলাম।
প্রসঙ্গত, ডিসি সম্মেলন তিন দিনের পরিবর্তে এবার দুদিন বাড়িয়ে পাঁচ দিন করা হয়েছে। মাঠ প্রশাসনকে শক্তিশালী করে সরকারের কর্মসূচি ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে আরো ত্বরান্বিত করতে এ সম্মেলনের মাধ্যমে বার্তা দেওয়া হয় সরকারের কেন্দ্র থেকে। জেলা প্রশাসকরাও মাঠ প্রশাসনের চাহিদা, সুবিধা ও অসুবিধাগুলো তুলে ধরেন মন্ত্রণালয়গুলোর কাছে।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এ সম্মেলনের উদ্বোধন হলেও পরে সচিবালয়ে সম্মেলনের কার্যকরী অধিবেশনগুলো হবে। এবারই প্রথম জেলা প্রশাসক সম্মেলনে প্রধান বিচারপতি, তিন বাহিনীর প্রধানগণ ও জাতীয় সংসদের স্পিকারের সঙ্গে ডিসিদের বৈঠক হবে।
সম্মেলনে ২৯টি অধিবেশন ও ২৪টি কার্য-অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে। সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন আগামীকাল সোমবার (১৫ জুলাই) সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন জেলা প্রশাসকরা।