কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার গোলাম মোস্তফা। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন রাজধানীর মহানগর ল কলেজ থেকে এলএলবি পাস করেন ২০১৫ সালে। এরপর ২০১৭ সালে আইনজীবী হওয়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নে শুরু করেন বার কাউন্সিলে ‘পেশাগত সনদ’ অর্জনের লড়াই। কিন্তু তার রেজিস্ট্রেশনের দুই বছর পার হলেও বার কাউন্সিলের সেই পরীক্ষা হয়নি আজও।
শুধু গোলাম মোস্তফা নন, রেজিস্ট্রেশন করে সনদের জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনছেন এমন প্রায় ৪৩ হাজার ‘শিক্ষানবিশ আইনজীবী’। তাদের প্রায় ২৫ হাজার এরই মধ্যে এমসিকিউ পরীক্ষার জন্য ফরম পূরণ করে ব্যাংকে নির্ধারিত ফিও জমা দিয়েছেন। কিন্তু সাত মাস ধরে ফরম পূরণ বা পরীক্ষার আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা দেয়নি কর্তৃপক্ষ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বার কাউন্সিলের সচিব জেলা জজ মো. রফিকুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘ফরম ফিলআপের আনুষ্ঠানিক কোনো তারিখ ঘোষণা করা হয়নি। যারা ফরম ফিলআপ করে টাকা জমা দিতে চেয়েছে, তাদের টাকা আমরা গ্রহণ করেছি। যাতে পরবর্তী সময়ে ফরম ফিলআপের সময়ে কাজের চাপ তৈরি না হয়। কর্তৃপক্ষের অনুমোদন পাওয়ার পর পরীক্ষা এবং ফরম ফিলআপের সময়সূচি ঘোষণা করা হবে।’
বিধি অনুযায়ী, বার কাউন্সিলের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেই তারা নিম্ন আদালতে সরাসরি মামলা পরিচালনা করার সুযোগ পাবেন। এ জন্য প্রথম ধাপে একজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবীর তত্ত্বাবধানে শিক্ষানবিশ হিসেবে নূ্যনতম ছয় মাস কাজ করতে হবে। এরপর তাকে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা দিতে হয়। ওই পরীক্ষায় পাস করলে লিখিত পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেন। লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের পরে মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। এরপর আইনজীবী তালিকাভুক্তির চূড়ান্ত ফল ঘোষণা করে বার কাউন্সিল। আইন পেশা পরিচালনার জন্য দেশে বার কাউন্সিলই সনদ প্রদানকারী একমাত্র সরকারি প্রতিষ্ঠান।
জানা গেছে, ২০১৭ সালের ২১ জুলাই সর্বশেষ বার কাউন্সিলের নৈর্ব্যক্তিক (প্রিলিমিনারি) পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। ওই পরীক্ষায় অংশ নেওয়া ৩৪ হাজার ৩৮৯ শিক্ষার্থীর মধ্যে ১১ হাজার ৮৪৬ জন কৃতকার্য হন। পরে ওই বছরের ১৪ অক্টোবর তারা লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেন। গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর প্রকাশ করা হয় মৌখিক পরীক্ষার ফল। এতে সাত হাজার ৭৩২ জন উত্তীর্ণ হন। কিন্তু সাত মাসেও নতুন পরীক্ষার ঘোষণা দেয়নি বার কাউন্সিল কর্তৃপক্ষ। অথচ প্রতিবছর দুটি ব্যাচের পরীক্ষা হওয়ার কথা। পরীক্ষা বিলম্বের কারণে অনেকের রেজিস্ট্রেশনের মেয়াদও শেষ পর্যায়ে রয়েছে।
জানতে চাইলে বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন গণমাধ্যমকে বলেন, জাতীয় নির্বাচন ও বার কাউন্সিল ভবনের নির্মাণকাজ শুরুসহ বিভিন্ন কারণেই গত বছর বার কাউন্সিলের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়নি। এ নিয়ে অনেক পরীক্ষার্থীই যোগাযোগ করেছেন। আমরাও চেষ্টা করছি। শিগগিরই যাতে পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করা যায়, সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেবেন বলেও জানান তিনি।
কবে নাগাদ পরীক্ষা হতে পারে- এমন প্রশ্নে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর এই সদস্য বলেন, পরীক্ষার তারিখ ও ফরম ফিলআপের তারিখ নির্ধারণের জন্য আমরা এনরোলমেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান আপিল বিভাগের বিচারপতি মো. নুরুজ্জামানের কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছি। তারিখ কমিটিই নির্ধারণ করবে। তবে আমরা চেষ্টা করব, শিগগিরই যাতে পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করা সম্ভব হয়।
বার কাউন্সিল আগে রাজধানীর মৎস্য ভবন মোড়ে নিজস্ব কার্যালয়ে থাকলেও গত এপ্রিলে ভবনটি ভেঙে ফেলা হয়েছে। বর্তমানে বার কাউন্সিলের কার্যক্রম রাজধানীর বাংলামটর ও
পরীবাগে ভাড়া নেওয়া দুটি ভবনে পরিচালিত হচ্ছে। ফরম পূরণ ও এনরোলমেন্টের কার্যক্রম পরিচালিত হয় বাংলামটরের রূপায়ণ টাওয়ারের ষষ্ঠতলায়। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্তির (এনরোলমেন্ট) পরীক্ষার খোঁজ নিতে প্রার্থীরা প্রতিদিন বার কাউন্সিলে ভিড় জমাচ্ছেন। ২০১৭ সালে নৈর্ব্যক্তিক পরীক্ষা দিয়ে যারা উত্তীর্ণ হননি, এমন প্রার্থীর সংখ্যা ২৬ হাজার ৬৫৭ জন। তাদের সঙ্গে গত তিন বছরে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি পরীক্ষায় উর্ত্তীণ প্রার্থীরাও নতুন ব্যাচে এনরোলমেন্ট পরীক্ষা দিতে রেজিস্ট্রেশন করেছেন। সব মিলিয়ে মোট পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ৪৩ হাজারেরও বেশি। পরীক্ষা হতে যত বিলম্ব হবে, রেজিস্ট্রেশনকারীর সংখ্যাও তত বাড়বে। পাশাপাশি পাঁচ বছর আগে রেজিস্ট্রেশন করা প্রার্থীদেরও নতুন করে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে।
এ বিষয়ে ভুক্তভোগী শিক্ষানবিশ আইনজীবী সাদিয়া শবনম মুক্তা বলেন, ‘এলএলবি পরীক্ষার ফল প্রকাশ হয়েছে ২০১৭ সালে, আর এখন চলছে ২০১৯। এখন পর্যন্ত বার কাউন্সিলের এমসিকিউ পরীক্ষাই দিতে পারলাম না। কবে এমসিকিউ পরীক্ষা পাস করব, কবে লিখিত ও ভাইভা পরীক্ষা দেবো? তা ছাড়া এই পরীক্ষাগুলো পাস না করলে তো আবারও দু-এক বছর অপেক্ষা করে পরীক্ষা দিতে হবে। আমাদের সমস্যা নিয়ে কেউ ভাবছে না।’
পরীক্ষাজটে পরীক্ষা পদ্ধতি পরিবর্তনের দাবি জানিয়ে শিক্ষানবিশ আইনজীবী রইছ উদ্দিন আবীর বলেন, ‘একজন শিক্ষার্থীকে চার বছর আইন পড়ার পর সনদের জন্য এতগুলো পরীক্ষা দেওয়ার কোনো মানে নেই। পরীক্ষা পদ্ধতি পরিবর্তন করা প্রয়োজন। পরীক্ষাজট কমাতে ৩৯তম বিসিএসে এবার লিখিত পরীক্ষাই হয়নি। বার কাউন্সিল কর্তৃপক্ষ আন্তরিক হলে শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের দুর্ভোগ ও সময় বাঁচাতে লিখিত বা এমসিকিউ যে কোনো একটি বাদ দিয়ে দ্রুত পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব।’ সমকাল