এইচ.এম. মুনতাসীর রোমেল:
যেকোনো ব্যক্তি যার বিরুদ্ধে কোনো লিখিত দলিল বাতিল বা বাতিলযোগ্য হয় এবং তার যদি যুক্তিসঙ্গত আশংকা থাকে যে, যদি এরুপ দলিল অনিষ্পন্ন অবস্থায় রাখা হয়, তাহলে তার গুরুতর ক্ষতির কারণ হবে। সেক্ষেত্রে উক্ত ব্যক্তি যথাযথ এখতিয়ার সম্পন্ন কোর্টে দলিলটি বাতিল বা বাতিলের মামলা করতে পারে। এধরণের মামলাকেই দলিল বাতিলের মামলা বলে।
উদাহরণ: জনাব জলিল সাহেব জনাব আজিজ সাহেবকে একটি জমি প্রদান করে। পরবর্তীতে জলিল সাহেব উক্ত জমি জনাব মফিজ সাহেবকে উইল করে এবং মারা যায়। এরপর জনাব শাহিন সাহেব সম্পত্তির দখল নেয় এবং এই মর্মে একটি জাল দলিল পেশ করে যে, উক্ত জমি তার জন্য ট্রাস্টী হিসাবে জনাব আজিজ সাহেব বরাবর সম্পাদন করা হয়েছিলো। মফিজ সাহেব উক্ত জাল দলিল বাতিল করে নিতে পারে।
দলিল বাতিলের মামলা করার শর্তসমূহ
১. কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে একটি লিখিত দলিল বাতিল বা বাতিলযোগ্য হতে হবে।;
২. দলিলদাতার নিকট দলিলটির অস্তিত্ব ক্ষতির কারণ হবে বলে যুক্তিসঙ্গত আশংকা থাকতে হবে।
৩. দলিলের অস্তিত্ব দলিলদাতার গুরুতর ক্ষতির কারণ হতে হবে;
৪. তামাদি আইন অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই মামলা দায়ের করতে হবে;
৫. কোর্ট ফি আইন অনুযায়ী নির্দিষ্ট কোর্ট ফি প্রদান সাপেক্ষে মামলা দায়ের করতে হবে।
তামাদি মেয়াদ
তামাদি আইনের ৯১ ধারা অনুযায়ী, সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৩৯ ধারায় দলিল বাতিলের মামলা করার অধিকারী, এই বিষয়টি অবগত হওয়ার ০৩ (তিন) বছরের মধ্যে মামলা দায়ের করতে হয়। তবে ক্ষেত্র বিশেষে তামাদি আইনের ১২০ অনুচ্ছেদ অনুসারে ০৬ (ছয়) বছরের মধ্যেও মামলা দায়ের করা যেতে পারে।
কোর্ট ফির পরিমাণ
সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৩৯ ধারা অনুসারে শুধুমাত্র কোন দলিল বাতিল বা বাতিলযোগ্য ঘোষণার মামলায়, কোর্ট ফি আইন, ১৮৭০ এর দ্বিতীয় তফসিলের ১২(৩) অনুচ্ছেদ অনুসারে নির্দিষ্ট কোর্ট ফি ৩০০(তিনশত) টাকা প্রদান করতে হবে। তবে দলিল বাতিল ঘোষণার সাথে যদি দলিল অর্পণ এবং দলিল বাতিলের আবেদন করা হয় সেক্ষেত্রে প্রথম অংশের জন্য কোর্ট ফি আইনের ৭(৪)(গ) ধারা অনুসারে যে পরিমাণ মূল্যের উপর বাদী প্রতিকার চায় তা ব্যক্ত করে তার উপর কোর্ট ফি আইনের প্রথম তফসিল (বি) এ প্রদত্ত টেবিল অনুযায়ী ২% হারে ফি দিতে হবে।
দলিল বাতিলের মামলা করতে পারে যারা
- বাতিল বা বাতিলযোগ্য দলিলের যে কোনো পক্ষ সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৩৯ ধারা অনুসারে দলিল বাতিলের মামলা দায়ের করতে পারে;
- দলিলের পক্ষগণ ছাড়াও যাদের বিরুদ্ধে দলিলটি বাতিল বা বাতিলযোগ্য তারাও মামলা দায়ের করতে পারে।
নাবালক মামলা করতে পারে কিনা
নাবালক অবস্থায় কোনো দলিল সম্পাদিত হলে এবং উক্ত দলিল তার বিরুদ্ধে বাতিল বা বাতিলযোগ্য হলে ও উক্ত দলিলের অস্তিত্ব নাবালকের গুরুতর ক্ষতির কারণ হলে, নাবালক সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৩৯ ধারা অনুসারে দলিলটি বাতিলের মামলা করতে পারে।
বাতিলযোগ্য কতিপয় দলিলসমূহ
সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইন, ১৮৭৭ এর ৩৯ ধারার শর্তসমূহ সাপেক্ষে যে কোনো দলিলই বাতিল ঘোষিত হতে পারে। নিম্নে কয়েকটি বাতিলযোগ্য দলিলের উল্লেখ করা হলো-
ক. বিক্রয় দলিল বা সাফ কবলা দলিল;
খ. দানপত্র দলিল বা হেবা দলিল;
গ. রেহেনী বা বন্ধকী দলিল;
ঘ. ইচ্ছাপত্র বা উইল দলিল;
ঙ. ইজারা বা লিজ দলিল ইত্যাদি।
দলিল আংশিক বাতিল ও আংশিক বহাল রাখা যায় কিনা
সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইন, ১৮৭৭ এর ৪০ ধারায় বলা হয়েছে যে, যেক্ষেত্রে একটি দলিল বিভিন্ন অধিকার বা বিভিন্ন বাধ্যবাধকতার সাক্ষ্য হয়, সেক্ষেত্রে আদালত যথাযথ মামলায় তা আংশিকভাবে বিলোপ করতে পারেন এবং অবশিষ্ট অংশকে বহাল রাখতে পারেন।
ক্ষতিপূরণের নির্দেশ – (ধারা ৪১)
সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৪১ ধারায় বলা হয়েছে, দলিল বাতিলের রায় প্রদানের সময় আদালত যে পক্ষকে এরুপ প্রতিকার মঞ্জুর করেছেন, সেই পক্ষের তরফ হতে অপরপক্ষকে ন্যায়বিচারের প্রয়োজনে ক্ষতিপূরণ প্রদানের নির্দেশ দিতে পারেন।
দলিল বাতিলের মামলায় প্রমাণের দায়িত্ব (Burden of Proof)
দলিল বাতিলের মামলায় যে ব্যক্তি দাবি করে যে, দলিলটি তার বিরুদ্ধে বাতিল বা বাতিলযোগ্য এবং দলিলটির এরুপ অস্তিত্ব উক্ত ব্যক্তির গুরুতর ক্ষতির কারণ হতে পারে, সেক্ষেত্রে ঐ ব্যক্তির উপরই উক্ত অভিযোগটি প্রমাণের দায়িত্ব বর্তাবে।
আদালতের ক্ষমতার প্রকৃতি
সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের যেকোনো প্রতিকারই আদালতের ডিসক্রিশনারি পাওয়ার বা ইচ্ছাধীন ক্ষমতার অন্তর্ভুক্ত। কোনো দলিল বাতিল বা বাতিলযোগ্য ঘোষণা, দলিল অর্পণ বা দলিল বাতিলের আদেশ প্রদান আদালতের ইচ্ছাধীন ক্ষমতা। তবে এই ইচ্ছাধীন ক্ষমতা কোনোভাবেই স্বেচ্ছাচারিতা নয়। এ ধরণের ক্ষমতা অবশ্যই সুষম, যুক্তিযুক্ততার সাথে প্রয়োগ করতে হবে এবং বিচারিক মূলনীতি দ্বারা পরিচালিত হবে।
লেখক : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ও লিগ্যাল কনসালটেন্ট, বাটা স্যু কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড।