এক কিশোরকে হত্যার অভিযোগে চার আসামির বিরুদ্ধে মামলার বিচার চলছে চার বছর ধরে। ঢাকার আদালতে বিচারকাজ এখন শেষ পর্যায়ে। এ অবস্থায় জানা গেল, ছেলেটি খুন হয়নি। অপহরণ ও খুনের মিথ্যা মামলা দিয়ে আসামিদের ফাঁসানো হয়েছিল। এ অভিযোগে গতকাল শনিবার (৩১ আগস্ট) ওই কিশোরসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ।
ইতিমধ্যে ওই কিশোরের বয়স বেড়েছে, পুলিশের নথি অনুযায়ী ১৮। ২০১৪ সালে কিশোর আবু সাঈদের কথিত খুনের ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল রাজধানীর হাজারীবাগ থানা এলাকায়।
মামলার নথিপত্রে দেখা যায়, আবু সাঈদের বাবা আজম ২০১৪ সালের ১৫ এপ্রিল অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করে হাজারীবাগ থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে অপহরণ মামলা করেন। আজম দাবি করেন, তাঁর ছেলে সেদিন হাজারীবাগের বড় মসজিদ মাতৃপীঠ স্কুলের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। কিন্তু আর বাসায় ফেরেনি। এর দুই দিন পর তিনি হাজারীবাগ থানায় প্রথমে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। এরপর এলাকায় প্রচার চালান। ২০-২৫ দিন পর ২ লাখ টাকা মুক্তিপণ চেয়ে তাঁর মুঠোফোনে ফোন আসে।
অপহরণ মামলাটি প্রথমে তদন্ত করে হাজারীবাগ থানার পুলিশ। ২০১৪ সালের ২২ জুলাই পুলিশ আজগর আলী ও মিলন নামের দুই আসামিকে গ্রেপ্তার করে ঢাকার আদালতে হাজির করে। পরে মামলার তদন্তের দায়িত্ব পেয়ে ডিবির উপপরিদর্শক রুহুল আমিন বরিশালের আফজাল হোসেনসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করেন। আফজাল কিশোর সাঈদকে খুন করার কথা স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন বলেও জানানো হয়।
জবানবন্দিতে আফজাল আদালতে বলেছিলেন, আবু সাঈদকে অপহরণের পর লঞ্চ থেকে নদীতে ফেলে দিয়ে হত্যা করা হয়। আরেক আসামি সাইফুলও হত্যার কথা স্বীকার করেন।
তদন্ত কর্মকর্তা রুহুল আমিন ২০১৫ সালের ১৫ জুন আদালতে আফজাল, তাঁর বোন সোনিয়া আক্তারসহ চারজনের নামে ৩০২ ধারায় অভিযোগপত্র দেন। এতে বলা হয়, আসামিদের গ্রেপ্তার করে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। মুঠোফোনের কললিস্ট সংগ্রহ করে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় আসামিদের তিনি শনাক্ত করেন। অপহরণ করার পর ২০১৪ সালের ১৬ এপ্রিল আবু সাঈদকে এমভি অভিযান নামের লঞ্চে নিয়ে আসা হয়। সেদিন রাত সাড়ে ১২টায় আবু সাঈদকে ঘুম থেকে তোলা হয়। এরপর আসামি আফজাল ও সাইফুল আবু সাঈদকে লঞ্চ থেকে ধাক্কা মেরে নদীতে ফেলে দেন।
পুলিশ এবং আদালত সূত্র বলছে, হত্যা মামলাটি বিচারের জন্য ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৫-এ পাঠানো হয়। আদালত আফজাল হোসেনসহ চারজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন।
আবু সাঈদের বেঁচে থাকা
আবু সাঈদ হত্যা মামলার আসামি আফজাল হোসেন গত ২৯ আগস্ট রাজধানীর পল্লবী থানায় একটি জিডি করেন। সেখানে তিনি বলেন, আবু সাঈদ নামের যে কিশোরকে হত্যা করার অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে, সেই কিশোর বেঁচে আছে। সে তার বাবাকে নিয়ে অবস্থান করছে বিহঙ্গ পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাসির উদ্দিন খোকনের বাসায়। জিডিতে আরও বলা হয়, কথিত খুনের মামলায় এর আগে আবু সাঈদের পরিবার সাড়ে ৫ লাখ টাকা নিয়েছে। এখন আরও ১ লাখ টাকা চাইছে।
বিহঙ্গ পরিবহনের মালিক নাসির উদ্দিন গণমাধ্যমের কাছে দাবি করেন, আবু সাঈদ হত্যা মামলার চার আসামিই তাঁর এলাকার। হত্যা মামলায় আসামি হওয়ার পর থেকে তাঁরা দাবি করে আসছিলেন, তাঁরা মিথ্যা মামলার শিকার। তখন থেকে তিনি এই মামলার খোঁজখবর নেওয়া শুরু করেন। একপর্যায়ে মামলার বাদী আবু আজমকে আপসের প্রস্তাব দেন। এ জন্য তাঁরা টাকাও নিয়েছিলেন। কিন্তু কখনো স্বীকার করেননি যে আবু সাঈদ বেঁচে আছে। একপর্যায়ে তিনি খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, লঞ্চ থেকে আবু সাঈদকে নদীতে ফেলে দিয়ে হত্যার দাবি ঠিক নয়। কারণ, ওই দিন ওই লঞ্চ ঢাকা থেকে ছেড়ে যায়নি। তিনি আরও জানতে পারেন, আবু সাঈদ খুন হয়নি, বেঁচে আছে। এরপর গত বৃহস্পতিবার সাঈদের মা-বাবা টাকা নেওয়ার জন্য তাঁর বাসায় এলে তিনি পুলিশকে খবর দেন। পুলিশ এসে তাঁদের গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। একই কথা বলেছেন আফজাল হোসেনও। চার আসামির একজন সোনিয়া গতকাল সাঈদের মা-বাবাসহ সাতজনের বিরুদ্ধে হাজারীবাগ থানায় প্রতারণার মামলা করেন। এই মামলায় সোনিয়া এক নম্বর আসামি করেছেন তাঁর সাবেক স্বামী মিরাজ হোসেনকে। মিরাজ এখন পলাতক বলে জানা গেছে।
আফজাল জানান, তাঁদের চারজনকে বরিশাল থেকে ধরে এনে ঢাকার মিন্টো রোডে ডিবির কার্যালয়ে রাখা হয়। আফজালের দাবি, পুলিশের নির্যাতনের মুখে তিনি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন এবং পুলিশের শেখানো কথা আদালতে বলেন। তিনি জেল খাটেন ৩৩ মাস।
হাজারীবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইকরাম আলী মিয়া গণমাধ্যমকে বলেন, আবু সাঈদ নামের কিশোর খুনই হয়নি। মিথ্যা মামলা দিয়ে প্রতারণার অভিযোগে তাকেসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের বাড়ি বরিশাল জেলার মেহেন্দীগঞ্জ থানার বদরপুর গ্রামে।
সোনিয়ার আইনজীবী ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, এসব ঘটনার মূল হোতা মিরাজ হোসেন। স্ত্রী থাকার পরও ২০১৪ সালে মিরাজ সোনিয়াকে বিয়ে করেন। এ নিয়ে সোনিয়ার পরিবারের সঙ্গে মিরাজের বিরোধের সূত্রপাত।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক এ বিষয়ে বলেন, কথিত এই হত্যাকাণ্ড ও তার যে বিচার হচ্ছে, যা সাজানো মিথ্যা মামলা। এর থেকে আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো, এই বিচারপ্রক্রিয়ায় তদন্ত কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সাক্ষী পর্যন্ত বহু লোক জড়িত আছেন, যাঁরা ফৌজদারি অপরাধ করেছেন। এ পরিস্থিতিতে প্রশাসনিক দায়দায়িত্ব এবং অপরাধমূলক কার্যক্রমের তদন্তের জন্য কমিশন অব ইনকোয়ারি অ্যাক্টের অধীনে একটা তদন্ত কমিশন গঠন করা উচিত। দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। সূত্র – প্রথম আলো