কানাডার উচ্চ আদালত বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত ঘাতক নূর চৌধুরীর ওই দেশে অবস্থানসংক্রান্ত তথ্যের গোপনীয়তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের ‘জুডিশিয়াল রিভিউয়ের’ আবেদন মঞ্জুর করেছেন। কানাডা সময় গত মঙ্গলবার (১৭ সেপ্টেম্বর) অটোয়ার অন্টারিওর ফেডারেল আদালত ওই রায় দেন।
ঘাতক নূর চৌধুরী কানাডায় কিভাবে আছেন এবং বহিষ্কার ঠেকাতে তাঁর ‘প্রি-রিমুভাল রিস্ক অ্যাসেসমেন্টের’ (পিআরআরএ) আবেদন কী পর্যায়ে আছে সে বিষয়ে বাংলাদেশকে কানাডা কোনো তথ্য দিচ্ছে না অভিযোগ করে গত বছর জুন মাসে ‘জুডিশিয়াল রিভিউয়ের’ (বিচারবিভাগীয় পর্যালোচনা) আবেদনটি করা হয়েছিল। কানাডার আদালতে করা এ আবেদন নিয়ে গত মার্চে শুনানি হয়।
দেশটির উচ্চ আদালত মঙ্গলবার এ বিষয়ে রায়ে আবেদনটি মঞ্জুর করে বলেছেন, কানাডা কর্তৃপক্ষ ও নূর চৌধুরী বাংলাদেশকে তথ্য না দেওয়ার বিষয়ে যেসব যুক্তি তুলে ধরেছেন তা গ্রহণযোগ্য নয়। গোপনীয়তা আইনেও এসব যুক্তি খাটে না। বাংলাদেশ বলেছে, নূর চৌধুরী কিভাবে কানাডায় আছেন তা জানতে পারলে তাঁর ব্যাপারে আইনি উদ্যোগ নেওয়া সহজ হবে। কিন্তু কানাডা কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশের আবেদন যথাযথভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেনি। তাই আদালত বাংলাদেশের আবেদন আবার বিবেচনা করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিচ্ছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ রায় বাংলাদেশের জন্য একটি বড় আইনি বিজয়। কারণ গোপনীয়তার অজুহাত দেখিয়ে কানাডা বাংলাদেশকে নূর চৌধুরীর বিষয়ে তথ্য দিচ্ছিল না। নূর চৌধুরীর ব্যাপারে বাংলাদেশের কাছে কানাডার তথ্য গোপন করা যে সঠিক হয়নি তা দেশটির আদালতের রায়ের মাধ্যমেই প্রমাণিত হয়েছে।
বাংলাদেশ সরকার দায়ের করা মামলায় কানাডার অ্যাটর্নি জেনারেলের পাশাপাশি নূর চৌধুরীকেও পক্ষভুক্ত করেছিল। গত ২৫ মার্চ কানাডার অন্টারিওতে ফেডারেল আদালতে শুনানির সময় বাংলাদেশ পক্ষ কানাডায় নূর চৌধুরীর ‘লিগ্যাল স্ট্যাটাস’ জানতে চেয়েছিল। তবে কানাডার অ্যাটর্নি জেনারেলের পক্ষ আদালতকে বলে, নূর চৌধুরীর ‘লিগ্যাল স্ট্যাটাস’ না জানায় কানাডায় জনগণের কোনো ক্ষতি হচ্ছে না।
কানাডার অ্যাটর্নি জেনারেলের দপ্তর প্রায় ১০ বছর ধরে নূর চৌধুরীর একটি আবেদন ঝুলিয়ে রেখে কার্যত তাঁকে ওই দেশে থাকার সুযোগ করে দিয়েছে। সেই আবেদন নিষ্পত্তির কোনো লক্ষণ নেই। এই প্রেক্ষাপটে আদালতের নির্দেশনা চেয়ে বাংলাদেশ মামলাটি দায়ের করে। বাংলাদেশের পক্ষে আইনি প্রতিষ্ঠান ‘টরিস এলএলপি’ মামলা পরিচালনা করে।
আদালতের রায়ে বলা হয়েছে, ১৯৯৬ সালে নূর চৌধুরী ও তাঁর স্ত্রী কানাডায় ‘ভিজিটর’ স্ট্যাটাস পান। এর কিছুদিন পরই তাঁরা ‘রিফিউজি প্রটেকশনের’ (শরণার্থী হিসেবে সুরক্ষা) আবেদন করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার দায়ে বাংলাদেশে ফেরারি হিসেবে নূর চৌধুরীর বিচার হয় এবং সেখানে তিনি দোষী সাব্যস্ত হন।
কানাডার আদালত বলেছেন, গুরুতর ‘অরাজনৈতিক’ অপরাধের কারণে নূর চৌধুরী ও তাঁর স্ত্রী ২০০২ সালে ‘রিফিউজি প্রটেকশন’ থেকে বাদ পড়েন। গুরুতর অপরাধের দায়ে ২০০৬ সালে তাঁরা কানাডায় প্রবেশের অযোগ্য হিসেবেও বিবেচিত হন। বাংলাদেশে ফিরলে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হতে পারে—এমন যুক্তি দেখিয়ে ২০০৯ সালে নূর চৌধুরী ‘প্রি-রিমুভাল রিস্ক অ্যাসেসমেন্টের’ জন্য অনুরোধ করেন।
রায়ে বলা হয়েছে, ২০১০ সাল থেকে কানাডায় নূর চৌধুরীর স্ট্যাটাস জানতে বাংলাদেশ কানাডার সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। তাঁর ‘প্রি-রিমুভাল রিস্ক অ্যাসেসমেন্টের’ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হওয়ার ব্যাপারেও বাংলাদেশ উদ্বেগ জানাচ্ছে। ২০১৮ সালে বাংলাদেশের হাইকমিশনার কানাডার নাগরিকত্ব, শরণার্থী ও অভিবাসন বিষয়ক মিনিস্টারের (নাগরিকত্ব, শরণার্থী ও অভিবাসনবিষয়ক মন্ত্রণালয় বোঝাতে) কাছে লেখা চিঠিতে নূর চৌধুরীর স্ট্যাটাস ও ‘প্রি-রিমুভাল রিস্ক অ্যাসেসমেন্টের’ আবেদনের স্ট্যাটাস জানানোর অনুরোধ করেন। কানাডার নাগরিকত্ব, শরণার্থী ও অভিবাসন বিষয়ক মিনিস্টার বাংলাদেশের হাইকমিশনারের অনুরোধ প্রত্যাখান করেন। তাঁর যুক্তি ছিল, গোপনীয়তা আইন অনুযায়ী ওই তথ্য জানানোর সুযোগ নেই। তা ছাড়া বাংলাদেশ ও কানাডার মধ্যে তথ্য বিনিময়ের চুক্তিও নেই। বাংলাদেশের হাইকমিশনার সীমিত পরিসরে তথ্য পাওয়ার জন্য হলেও চুক্তি করতে আগ্রহ দেখান। কিন্তু কানাডা কর্তৃপক্ষ তা প্রত্যাখ্যান করে। এই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ নূর চৌধুরীর ‘প্রি-রিমুভাল রিস্ক অ্যাসেসমেন্টের’ স্ট্যাটাস জানতে জুডিশিয়াল রিভিউয়ের আবেদন করে।
বাংলাদেশের যুক্তি, নূর চৌধুরীর স্ট্যাটাস জানতে চেয়ে বাংলাদেশের আবেদন পরীক্ষা-নিরীক্ষায় কানাডা কর্তৃপক্ষের ভুল হয়েছে। বিশেষ করে জনস্বার্থে তথ্য জানানোর গুরুত্ব বিবেচনা করতে কানাডার কর্মকর্তারা ব্যর্থ হয়েছেন। এ ছাড়া বাংলাদেশের অনুরোধ কানাডা কর্তৃপক্ষের প্রত্যাখ্যানের কারণগুলো যথেষ্ট নয় বলেও বাংলাদেশ যুক্তি তুলে ধরেছে।
অন্যদিকে কানাডা কর্তৃপক্ষের যুক্তি ছিল নূর চৌধুরীর ব্যাপারে বাংলাদেশের অনুরোধ ‘প্রিম্যাচিউর’ এবং এটি বিচারযোগ্য নয়। জনস্বার্থের জন্য তাদের সিদ্ধান্ত ও যুক্তিগুলো স্পষ্ট ও পর্যাপ্ত বলেও দাবি ছিল কানাডা কর্তৃপক্ষের।
আদালতের বিচারক জে. রেইলি বলেছেন, ‘আমার দৃষ্টিতে জুডিশিয়াল রিভিউয়ের জন্য বাংলাদেশের আবেদনে ইতিবাচক সাড়া দেওয়া উচিত। কারণ কানাডা কর্তৃপক্ষ জনস্বার্থে তথ্য প্রকাশের বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে ব্যর্থ হয়েছেন।’
রায়ে বিচারক লিখেছেন, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তিনি চারটি বিষয় বিবেচনা করেছেন। এগুলো হলো জুডিশিয়াল রিভিউ ‘প্রিম্যাচিউর’ (উপযুক্ত সময়ের আগে) কি না, বাংলাদেশের দাখিল করা হলফনামা যৌক্তিক কি না, বিষয়টি বিচারযোগ্য কি না এবং কানাডা কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক কি না?
কানাডা কর্তৃপক্ষ ও নূর চৌধুরীর যুক্তি ছিল, ‘প্রাইভেসি কমিশনারের’ (গোপনীয়তাবিষয়ক কমিশনারের) কাছে অভিযোগ দায়ের না করে বাংলাদেশ আদালতে জুডিশিয়াল রিভিউয়ের আবেদন করতে পারে না। তাঁরা আরো বলেছিলেন, প্রাইভেসি কমিশনারের কাছে আবেদন করে ব্যর্থ হলেই বাংলাদেশ জুডিশিয়াল রিভিউয়ের জন্য যেতে পারে।
বিচারক ওই যুক্তি প্রত্যাখ্যান করেছেন। বাংলাদেশের দাখিল করা হলফনামার কিছু অংশ নিয়ে কানাডা কর্তৃপক্ষ ও নূর চৌধুরীর আপত্তিও আমলে নেননি বিচারক।
বাংলাদেশের আবেদন বিচারযোগ্য কি না এ প্রশ্নে কানাডা কর্তৃপক্ষের যুক্তি ছিল, ব্যক্তিবিশেষের অধিকার খর্ব না হলে বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে কানাডার যোগাযোগের বিষয়টি বিচারযোগ্য নয়। নূর চৌধুরীও গোপনীয়তা আইনের ধারা এবং বাংলাদেশ ও কানাডার মধ্যে তথ্য বিনিময় চুক্তি না থাকার বিষয়টি তুলে ধরে দাবি করেন যে বাংলাদেশের আবেদন ওই আদালতে বিচারযোগ্য নয়। বিচারক ওই দুটি যুক্তিই প্রত্যাখ্যান করেছেন।
নূর চৌধুরীর ব্যাপারে বাংলাদেশকে তথ্য না দেওয়ার সিদ্ধান্ত যৌক্তিক কি না—এই প্রশ্নে কানাডা কর্তৃপক্ষ ও নূর চৌধুরী আদালতে দাবি করেছেন, ওই তথ্য জনস্বার্থের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। এ ধরনের তথ্য জানালে তা ব্যতিক্রমী ঘটনা হবে। বাংলাদেশের আবেদন আনুষ্ঠানিক নয় বরং অনানুষ্ঠানিক। তা ছাড়া ‘প্রি-রিমুভাল রিস্ক অ্যাসেসমেন্ট’ ব্যক্তির গোপনীয় বিষয়।
এসব দাবি ও যুক্তি নাকচ করে দিয়ে বিচারক বলেছেন, কানাডা কর্তৃপক্ষ নূর চৌধুরীর ব্যাপারে পরীক্ষা-নিরীক্ষা সঠিক হয়েছে বলে দাবি করলেও তা কিভাবে সঠিক তা ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থ হয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ শুরু থেকে তাঁর আবেদনকে ‘আনুষ্ঠানিক’ বলে অভিহিত করেছে। বাংলাদেশ বলেছে, নূর চৌধুরীর স্ট্যাটাসের বিষয়ে জানতে পারলে তারা আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ পাবে। আর তথ্য জানালে বাংলাদেশ ও কানাডার মধ্যে সম্পর্ক আরো জোরালো হবে। তা ছাড়া বাংলাদেশ মনে করে, দণ্ডিত অপরাধীদের স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ না দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করা গেলে তা কানাডা, বাংলাদেশ—দুই দেশের জনগণের স্বার্থেই কাজে লাগবে। এগুলোর কোনো ব্যাপারেই কানাডা কর্তৃপক্ষ জবাব দেয়নি বলে আদালতের রায়ে উল্লেখ আছে। সূত্র – কালেরকণ্ঠ