জমিসংক্রান্ত মামলার জট তৈরি হয়েছে দেশজুড়ে। এর সংখ্যা বর্তমানে ৩ লাখের মতো। মামলা জট কমাতে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার গঠন করে ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনাল ও আপিল ট্রাইব্যুনাল। সারা দেশে এ ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা ছিল ১২টি। পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠন করে মামলা নিষ্পত্তিতে আরো ৪১টি ট্রাইব্যুনাল গঠন করে। তবে সব উদ্যোগ ভেস্তে যায়। নিয়ম অনুযায়ী মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ায় প্রতিনিয়ত মামলার সংখ্যা বাড়তে থাকে। দেখা যায়, এ সংখ্যা প্রতি জেলায় ২০ থেকে ৩০ হাজারের মতো।
পরিস্থিতি জটিল হওয়া এবং মানুষের দুর্ভোগ দৈনন্দিন বাড়তে থাকে। তাই সিদ্ধান্ত বদলাতে বিদ্যমান ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনাল ও আপিল ট্রাইব্যুনাল বিলুপ্তির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এতে ভূমি মন্ত্রণালয়, আইন মন্ত্রণালয়, আইন কমিশন এবং সংসদীয় কমিটি পরস্পর আলোচনায় একটা সমঝোতায় এসে পৌঁছেছে বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে।
সূত্র বলছে, এ বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে ট্রাইব্যুনাল বিলুপ্তির। এজন্য একটা খসড়াও প্রস্তুত করা হয়েছে।
খসড়াতে বলা হয়েছে, ‘দি স্ট্রেট অ্যাকুইজিশন অ্যান্ড টেনানন্সি অ্যাক্ট, ১৯৫০ এর অনুচ্ছেদ ১৪৫জি- উক্ত আইনের অনুচ্ছেদ ১৪৫এ, অনুসারে ‘ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনাল’ বিলুপ্তি করা হলো। পাশাপাশি বিলুপ্ত ট্রাইব্যুনালের সব বিচারাধীন মামলা এবং অন্যান্য কার্যধারা স্ব স্ব স্থানীয় অধিক্ষেত্রের সহকারী জজ ও সিনিয়র সহকারী জজ আদালতে স্থানান্তরিত হবে। এছাড়া ট্রাইব্যুনাল বিলুপ্তির জন্য ভূমি মন্ত্রণালয়ের সম্মতি রয়েছে বলে জানা গেছে। আইন, বিচার সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে, যা সম্প্রতি এ সংক্রান্ত কমিটিতে উত্থাপন করা হয়।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক সংসদীয় কমিটির সভাপতি সাবেক আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আবদুল মতিন খসরু বলেন, দেশের জমিসংক্রান্ত মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনাল ও আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছি। বিএনপি-জামায়াত জোট প্রচলিত বিধান উপক্ষো করে এই ট্রাইব্যুনাল গঠন করে। সারা দেশের জন্য ১২টি ট্রাইব্যুনাল করায় মামলা নিষ্পত্তিতে কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি। তাই বর্তমান সরকার ২০১২ সালে এ সংখ্যা বাড়াতে আরো ৪১টি ট্রাইব্যুনাল গঠন করে।
তিনি বলেন, এর পরেও মামলা নিষ্পত্তিতে ধীরগতি দেখা যায়। ক্রমান্বয়ে মামলার সংখ্যা আরো বাড়তে থাকে। বর্তমানে এ সংখ্যা ৩ লাখের মতো হলেও প্রতিটি জেলায় এর হার ২০ থেকে ৩০ হাজার। তাই ট্রাইব্যুনাল বিলুপ্ত করে সহকারী ও সিনিয়র সহকারী জজদের অধীনে পুনরায় মামলা স্থানান্তরিত করে মামলা জট কমানো হবে। এই ট্রাইব্যুনাল বিলুপ্তির জন্য আগামী ১৭ অক্টোবর আরেক দফা বৈঠক হবে; সেখানেই ফাইনাল হবে এ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত, যোগ করেন সাবেক এই মন্ত্রী।
আইন মন্ত্রণালয়ের দেওয়া প্রতিবেদন পর্যালোচনায় পাওয়া তথ্যে দেখা গেছে, প্রচলিত বিধান বাদ দিয়ে জমিসংক্রান্ত মামলার জট কমাতে ট্রাইব্যুনাল গঠন করে বিএনপি-জামায়াত। কিন্তু তারা এটা করেছিল অসৎ উদ্দেশ্যে বলে এ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। ফলে ভূমি জরিপ আদালতে মামলার জট বাড়তে থাকে। এ কারণে আইন ও বিচার বিভাগ দি স্ট্রেট অ্যাকুইজিশন অ্যান্ড টেনানন্সি অ্যাক্ট, ১৯৫০ এর ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনাল ও ল্যান্ড সার্ভে আপিল ট্রাইব্যুনাল সংক্রান্ত বিধান সংশোধনের জন্য আইন মন্ত্রণালয় থেকে ২০১৭ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ভূমি মন্ত্রণালয়ে পত্র পাঠায়। কিন্তু এ বিষয়ে তারা পদক্ষেপ নেয়নি।
তবে সর্বশেষ চলতি বছরের ২ এপ্রিল ভূমি মন্ত্রণালয় এ বিধান সংশোধনের জন্য আইন মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানায়। সেখানে বিএনপির সময়ে গঠিত ট্রাইব্যুনাল বিলুপ্তির সুপারিশ জানায়। পাশাপাশি এ সংক্রান্ত গেজেট নোটিফিকেশন জারির এখতিয়ার প্রদান করে আইন মন্ত্রণালয়কে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৯ সালের ২৪ জুন এ সংক্রান্ত খসড়া তৈরি করে আইন বিভাগ।
খসড়ায় বলা হয়েছে, বর্তমানে সারা দেশে ৪১টি ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনাল বিদ্যমান রয়েছে। গত ৩১ মার্চ ’১৯ পর্যন্ত করা মামলার সংখ্যা ২ লাখ ৯৭ হাজার ৭০২টি। এক জেলায় একটি পৃথক আদালত হওয়ার ফলে জেলাভিত্তিক মামলার সংখ্যা ২০ থেকে ৩০ হাজার। এ কারণে এক একটি মামলার শুনানির তারিখ ক্ষেত্রমতে ছয় মাস বা এক বছর পর পর ধার্য করা হয়। ফলে মামলা নিষ্পত্তিতে বিলম্ব হচ্ছে, যা বিচার প্রার্থী ও জনগণের দুর্ভোগের কারণ। ফলে এ সংক্রান্ত আইনের যুগোপযোগী সংশোধন করা হলে ভূমি জরিপ আদালত সংক্রান্ত মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করা সম্ভব হবে এবং বিচারপ্রার্থী জনগণের দুর্ভোগ লাঘব হবে।
এই প্রতিবেদনের আগে ভূমি মন্ত্রণালয়, আইন মন্ত্রণালয়, আইন কমিশন ও সংসদীয় কমিটির মধ্যে পরস্পর আলোচনা ও সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেন, এই আইনের অধীন মামলাগুলোতে কারো নামে ভুল, কারো দাগ নম্বরে ভুল অর্থাৎ রেকর্ড সংশোধন। কিন্তু মামলার সংখ্যা অধিক হওয়ায় শুধুমাত্র ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালের পক্ষে মামলা নিষ্পত্তি করা সম্ভব হচ্ছিল না। ফলে মামলার ব্যাপক জটের সৃষ্টি হয়, যা এখনো বিদ্যমান। এর থেকে উত্তরণের জন্য মামলাগুলোকে সহকারী জজ বা সিনিয়র সহকারী জজ পর্যায়ে নিষ্পত্তি করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এর জন্য আইনে সংশোধনী আনার পক্ষে মত দেন সভায় আইনমন্ত্রী।
আর ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী বলেন, জনগণের হয়রানি ব্যতীত যাতে সেবা পায় সেটাই সরকারের মূল উদ্দেশ্য। তাই জনবান্ধব একটি পদ্ধতি অবলম্বন করাই শ্রেয়। এসব ছোটখাট ত্রুটি নিরসনে ‘দি স্ট্রেট অ্যাকুইজিশন অ্যান্ড টেনানন্সি অ্যাক্ট, ১৯৫০ এর ধারায় সংশোধন প্রয়োজন হলে তাই করতে হবে। কারণ এটি ব্রিটিশ সরকারের আইন। সেখানেও বর্তমানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আইনে সংশোধন করে আধুনিকায়ন করেছেন। শ্রীলঙ্কায় আইনটি সংশোধন করে উন্নত করা হয়েছে। সে আলোকে আমাদের দেশেও আইনটি সংশোধন করা হলে জনগণের তথা দেশের সাধারণ মানুষ উপকৃত হবে।
মন্ত্রী বলেন, জরিপের সময় বিভিন্ন ভুলের কারণে বেশ কিছু সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। যেমন, সরকারি সম্পত্তি ব্যক্তি মালিকানায়। একইভাবে ব্যক্তি মালিকানার সম্পত্তি সরকারি মালিকানায় দেখানো হয়েছে। তবে জমি সংক্রান্ত তথ্যাদি ঠিক আছে।
সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল বলেন, সেকশন ১৪৫জি অনুযায়ী আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে যে খসড়া উপস্থাপন করা হয়েছে সেটি বর্তমান প্রেক্ষাপটে খুবই গ্রহণযোগ্য এবং সেভাবে এসআরও করা যেতে পারে।