সুদীপ দাশ। জন্ম থেকেই এক চোখে দেখতে পান না। পরবর্তীতে নষ্ট হয়ে গেছে দ্বিতীয় চোখটিও। তবে, এই প্রতিবন্ধকতা দমিয়ে রাখতে পারেনি তাকে। সব বাধা পেরিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন তিনি। স্বপ্ন দেখেন বিচারক হবার। আইন বিভাগ থেকে পাস করলেও দেশের আইনই তার স্বপ্নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। একাধিকবার জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের (বিজেএসসি) সহকারী জজ নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণের আবেদন করলেও শেষ পর্যন্ত প্রচলিত আইনের কারণে শ্রুতিলেখক না পেয়ে হল থেকে বেরিয়ে এসেছেন হতাশা নিয়ে। সুদীপ দাশের সঙ্গে ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকমের সহকারী সম্পাদক কাজি ফয়জুর রহমানের একান্ত সাক্ষাৎকারে এবারের ত্রয়োদশ সহকারী জজ নিয়োগ পরীক্ষায় ফের আবেদন করেছেন বলে জানান তিনি। আগামী ৮ নভেম্বর অনুষ্ঠিতব্য প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় অংশ নিতে আবারো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট আবেদন করবেন। আশা করছেন এবার আর তাকে হতাশ হয়ে ফিরতে হবে না।
এ নিয়ে কতবার সহকারী জজ নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণের আবেদন করলেন, এমন প্রশ্নের জবাবে সুদীপ বলেন, ‘২০১৫ সালে স্নাতকোত্তর শেষ করার পর ১১তম সহকারী জজের নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিই। পরীক্ষার আগে প্রবেশপত্র সংগ্রহ করে একজন শ্রুতিলেখকের অনুমতির জন্য বিজেএসসিতে যাই। তবে, সেখান থেকে তাকে বলা হয়, এই পরীক্ষায় প্রতিবন্ধীদের অংশগ্রহণের সুযোগ নেই। কিন্তু আমি থেমে যাইনি পরের বার আবার ১২তম সহকারী জজ নিয়োগের পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য আবেদন করি। এরপর একজন শ্রুতিলেখকের জন্য আবেদন করি। মৌখিকভাবে আমার আবেদন প্রত্যাখ্যান করে বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন। তবে শ্রুতিলেখক পাওয়ায় আবেদন বাতিল হলেও নীরব প্রতিবাদ স্বরূপ দ্বাদশ সহকারী নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করি। এবার ত্রয়োদশ বিজেএস পরীক্ষার জন্যেও আবেদন করেছি, দেখা যাক কি হয়।’
আপনি তো জানেন বিজেএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে আইনি প্রতিবন্ধকতা রয়েছে তবু বারবার কেন আবেদন করছেন জানতে চাইলে সুদীপ দাশ জানান, একটা বিষয় হচ্ছে বিসিএস পরীক্ষায়ও একটা সময় প্রতিবন্ধীদের অংশগ্রহণের সুযোগ ছিল না। স্বপন চৌকিদার নামের একজন উচ্চাদালতে রিট করে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য সে পথ সুগম করেছেন। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে আমি জানি হয়তো এবারও আমি শ্রুতিলেখক পাবো না। হয়তো এবারও পরীক্ষার হলে একঘণ্টা আমি স্বপ্নভঙ্গের আফসোস করব। তবে আমার এই বারবার আবেদন এক ধরনের নীরব প্রতিবাদ বলতে পারেন।
এবারেও যদি পরীক্ষায় অংশগ্রহণে শ্রুতিলেখকের জন্য কর্তৃপক্ষের অনুমতি না পান তাহলে কি করবেন এমন প্রশ্নের জবাবে সুদীপ বলেন, যথাযথ নিয়ম মেনে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট আবেদন করব। আশা করি এবার আর হতাশ হয়ে ফিরতে হবে না। তবে এবার অনুমতি না পেলে হাইকোর্টে দ্বারস্থ হবার প্রস্তুতি নিচ্ছি। আশাকরি উচ্চ আদালতে এর প্রতিকার পাবো। আমার হয়তো বিচারক হবার স্বপ্ন পূরণ হবে না তবে এই লড়াইয়ের জেরে যেন আমার অনুজেরা, যারা কি-না আমার মতো শত প্রতিবন্ধকতা পাড়ি দিয়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণের যোগ্যতা অর্জন করেছে তাদের জন্য যেন আর কোন বাধা না থাকে। তারা যেন শুধুমাত্র দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হবার অজুহাতে স্বপ্ন দেখতে ভুলে না যান।
আরও পড়ুন: আইনের ফাঁদে বাধা পড়েছে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী সুদীপের বিচারক হবার স্বপ্ন
সুদীপের শ্রুতিলেখকের আবেদন নাকচের কারণ হিসেবে জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন থেকে জানানো হয় দেশের প্রচলিত দুটি আইন। সার্কুলারের ছয় নম্বর অনুচ্ছেদের ১৩ ও ২০ নম্বর ধারা এবং ২০০৭ সালে হওয়া বিচারবিভাগ পৃথকীকরণ আইনের ৩ নম্বর অনুচ্ছেদে এই নিয়োগে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের অংশগ্রহণের সুযোগ না থাকার বিষয়টির উল্লেখ রয়েছে। বিষয়টি তাকে মনে করিয়ে দিলে সুদীপ বলেন, প্রতিবন্ধীরা সমাজের বোঝা নয় বরং তারা এখন সমাজের সম্পদ। ইতিমধ্যে সমাজে প্রতিবন্ধীদের সফলতার স্বাক্ষর প্রতিলক্ষিত। সাউথ আফ্রিকায় প্রধান বিচারপতি একজন অন্ধ ছিলেন। যাকে নেলসন ম্যান্ডেলা নিয়োগ দিয়েছিলেন। এছাড়াও ভারতের তামিল প্রদেশ ও পাকিস্তানেও অন্ধ বিচারক নিয়োগ করা হয়েছে। সকল যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও সেটা প্রমাণের সুযোগ না পাওয়ার আফসোস আমার সারা জীবনের। তাহলে আমার ভিতর বিচারিক সক্ষমতা রয়েছে কিনা, তা প্রমাণের সুযোগ কি দেশের আইন আমাকে কখনো দেবে না? ভুলে গেলে চলবে না, মানুষের জন্য আইন, আইনের জন্য মানুষ নয়।