বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস কমিশন (বিজেএস) পরিক্ষায় অংশ নিলেন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী সুদীপ দাস। তবে কোনো প্রশ্নের উত্তর লিখতে পারেননি তিনি। শুধু হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর আর পরীক্ষার ওএমআর সীটে প্রয়োজনীয় তথ্য পূরণ করে পুরো এক ঘন্টা সময় হলেই বসে ছিলেন সুদীপ। শুক্রবার বিকাল সাড়ে তিন টায় শুরু হয় জুডিসিয়াল পরিক্ষা। আধা ঘন্টা আগেই রাজধানীর খিলক্ষেত থেকে চাচাতো ভাই এর সঙ্গে পরিক্ষা কেন্দ্র সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুল এন্ড কলেজে হাজির হন সুদীপ। গেটের কাছে আসতেই তাকে ঘিরে ধরে কৌতুহলী অনেক পরিক্ষার্থী। এ সময় অনেকেই তার সঙ্গে সেলফি তুলতে ব্যাস্ত। এরপর গেট থেকে এক পরিক্ষার্থীর সহায়তায় তিনি পরিক্ষার হলে প্রবেশ করেন।
হার না মানা সুদীপ দাস বলেন, পরীক্ষা হলে শিক্ষক ও এক পরিক্ষার্থীর সহায়তায় পরিক্ষার ওএমআর সীট ও হাজিরা খাতা স্বাক্ষর করেন। হল শিক্ষক খুবই আন্তরিক ও অমায়িক ছিলেন। তিনি বলেন, পরিক্ষায় অংশ নিতে পেরে আনন্দিত হলেও হলের ভিতর পুরো এক ঘন্টা মনো কষ্টে কাটিয়েছি। প্রশ্নের উত্তর জানা স্বত্বেও শুধু মাত্র দৃষ্টিহীণতার কারণে লিখতে পারিনি। তবে কিছু সময় নিজেকে অনেক ছোট মনে হয়েছে। পরক্ষণেই আবার মনে হয়েছে, আমার এ লড়াইতো শুধু আমার জন্য নয়। আমার এ লড়াই আমার অনুজদের জন্য। তিনি আরো বলেন, আমি হয়তোবা কখনো বিচারক হতে পারব না। তবে আমি বিশ্বাস করি, আমার অনুজরা একদিন শ্রুতি লেখকের মাধ্যমে পরীক্ষায় অংশ নিতে অনুমতি পাবেন। এবং তারা পরিক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বিচারক হবেন।
এর আগে, সুদীপ দাস চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শ্রুতি লেখকদের সহায়তায় আইনে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করেন। এরপর ২০১৭ সালে ১১তম সহকারী জজ নিয়োগ পরীক্ষায় আবেদন করেন। পরিক্ষায় অংশ নেয়ার জন্য প্রবেশপত্রও পান। কিন্তু শুধু দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হওয়ার কারণে পরীক্ষা দিতে পারেনি সুদীপ। কিন্তু তিনি থেমে যাননি । ফের ২০১৮ সালে ১২তম সহকারী জজ নিয়োগের পরীক্ষায় অংশ নেয়ার জন্য আবেদন করেন। যথাসময়ে প্রবেশ পত্র পান। সে বার তিনি একজন শ্রুতি লেখকের জন্য আবেদন করেন বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনে(বিজেএস)। কিন্তু মৌখিকভাবে তার সে আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়। তবে শ্রুতি লেখক না পাওয়ায় আবেদন বাতিল হলেও নীরব প্রতিবাদ স্বরূপ ১২তম সহকারী জজ নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নেন সুদীপ দাস। গতকাল শুক্রবার ১৩ তম বিজেএস পরীক্ষা। এই পরিক্ষাতেও তিনি অংশ নেন। শ্রুতি লেখকের জন্য আবেদন করে ছিলেন বিজেএসে। কিন্তু বিজেএস শ্রুতি লেখকের অনুমতি দেননি। হাইকোটেও বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের (বিজিএস) ১৩তম পরীক্ষাসহ (নৈর্ব্যক্তিক ও লিখিত) সব ধরনের পরীক্ষায় দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য শ্রুতিলেখক চেয়ে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেছিলেন। কিন্তু বৃহস্পতিবার হাইকোর্ট ওই রিট আবেদন কার্যতালিকা (কজলস্ট) থেকে বাদ (আউট অব লিস্ট) করে আদেশ দেন।
কথা হয় সুদীপ দাশের সঙ্গে। তিনি জানান, জন্ম থেকেই তিনি এক চোখে দেখতে পান না। ১০০ ওয়াটের টেবিল ল্যাম্প চোখের সামনে নিয়ে লেখাপড়া করতেন তিনি। বাল্বের প্রচণ্ড তাপে মাথা গরম হয়ে যেত। মাথায় খুব যন্ত্রণা করত। কিছুদিন পর নষ্ট হয়ে যায় তার দ্বিতীয় চোখটিও। তবুও তিনি লেখাপড়া থামাননি। তার পিতা রেলওয়ে কর্মকর্তা প্রদীপ চন্দ্র দাশ। স্কুল শিক্ষিকা মাতা মিরা দাশের দ্বিতীয় সন্তান সুদীপ। গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহ জেলার নান্দাইল উপজেলার চণ্ডীপাশা গ্রামে। তার পিতা প্রদীপ চন্দ্র দাস রেলওয়ের নিরীক্ষক ছিলেন। পিতার কর্মস্থল চট্টগ্রাম হওয়ায় সেখানেই সুদীপ দাসের লেখাপড়া। ২০০৭ সালে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের লতিফপুর আলহাজ্ব আব্দুল জলিল উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, ২০০৯ সালে উত্তর কাকতলী আলহাজ্ব মোস্তফা হাকিম ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন। সেখানে তিনি ২০১৪ সালে অনার্স ও ২০১৬ সালে মাস্টার্স শেষ করেন।