মোঃ শহিদুল ইসলাম সজিব:
মানুষের চুড়ান্ত বিচারের একচ্ছত্র ক্ষমতা একমাত্র সৃষ্টিকর্তার, যিনি ওপারে মানুষের প্রতিটা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কাজের হিসাব নিবেন। আর দুনিয়ায় মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করার সেই পরম ক্ষমতার কিছুটা চর্চা করার পবিত্র দ্বায়িত্ব পান বিচারকগণ। তাই বিচারের সময় কতটা সাবধানতা আর বিচক্ষণতা বিচারকগণের অবলম্বন করা উচিত তা বলাই বাহুল্য। বিচারের ক্ষেত্রে “ধর তক্তা মার পেরেক” মানে অযাচিত তাড়াহুড়োর কোন সুযোগ নেই। শতশত বছরে প্রাপ্ত নিগূঢ় অভিজ্ঞতা আর আইনের ক্রমবিকাশের সাথে সময়োপযোগী ভাবনার মিশেলে পরিচালিত হওয়া উচিত যেকোন দেশের বিচার ব্যবস্থা। একজন মানুষকেও যেন অন্যায়ভাবে বিচারের মুখোমুখি না করা হয়, কোন নিরপরাধীকে যেন সাজা শুনতে না হয়, সেটা নিশ্চিত করাই আইন-আদালতের পবিত্র দ্বায়িত্ব। Injustice anywhere is a threat to justice everywhere. কিন্তু কি হচ্ছে মোবাইল কোর্ট নামক আধা-বিচারিক ব্যবস্থায়?
ভ্রাম্যমাণ আদালত এবং এর কার্যক্রম সম্পর্কে দেশের মানুষের বেশ ভালো ধারণা আছে। সহসাই চোখে পড়ে তাদের কর্মতৎপরতা। একঝাকঁ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সর্বদা প্রস্তুত আছেন অপরাধীদের মুহূর্তের মধ্যে সাজা আর জরিমানা প্রদানের আদেশ দেয়ার জন্য। অপরাধীদের বিচিত্র কৌশল আর তথ্য-প্রযুক্তি উৎকর্ষের এই দিনে ভ্রাম্যমাণ আদালতের কিছুটা আবেদন যে আছে সেটা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। তবে এই চাহিদা জুডিশিয়াল অফিসারগণই মিটাতে পারতেন যদি হাইকোর্টের অধীনে যথাযথ পরিকল্পনা নিয়ে আগানো যেত। পাশ্ববর্তী দেশে এ ধরনের এক্সপেরিমেন্ট সফল হয়েছে।
যাই হোক, লেখাটা প্রয়োজনীয়তা কিংবা অপ্রয়োজনীয়তা নিয়ে নয়। সেটা ভিন্ন আলোচনা। আমি সাধারণত পদ্ধতিগত ত্রুটি নিয়ে লিখি, এখানেও কিছু ভয়াবহ পদ্ধতিগত ত্রুটি নিয়েই আলোচনা করবো, আদতে যেটা আইন লংঘন বা অপরাধের পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। বলে রাখা ভালো মোবাইল কোর্ট অর্ডিন্যান্স, যেটি ২০০৯ সালে আইনের মর্যাদা পায়, সংবিধানের সাথে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক। এটি মাসদার হোসেন মামলার আলোকে পৃথক হওয়া বিচার বিভাগের জন্য ভয়াবহ হুমকি। স্বাধীন বিচার বিভাগের ধারনার সাথে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক হওয়ায় এবং নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ পৃথক হওয়ায় মহামান্য হাইকোর্ট ইতিমধ্যে আইনটিকে অসাংবিধানিক ও অবৈধ ঘোষনা করেছেন। কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষের আপিলে বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টের এ্যাপিলেট ডিভিশনে আটকে আছে। এই আটকে থাকার সুযোগে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটগণ তাদের অযাচিত ক্ষমতা প্রয়োগ করে যাচ্ছেন। যাই হোক, এই ক্ষমতা প্রয়োগ করতে গিয়ে তারা বিতর্কিত আইনটির নিজস্ব বিধানও মানছেন না। একে তো মোবাইল কোর্ট আইনটিই বিতর্কিত, সেখানে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটগণ আদেশের সময় এই আইনের বিধানও মানছেন না! শুনতে খারাপ লাগে, আইন মানছেন না স্বয়ং ম্যাজিস্ট্রেট! এমনকি পুলিশ এবং ম্যাজিস্ট্রেট একযোগে অপরাধের বিচারের নামে নিজেরাই স্পস্ট অপরাধ করে যাচ্ছেন।
মোবাইল কোর্ট আইনের মাধ্যমে অভিযুক্তদের সাজা প্রদানের ক্ষেত্রে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের কিছু অত্যাবশকীয় শর্ত পালন করতে হয়। সংশ্লিষ্ট আইনের ৫, ৬, ৭ ধারায় সেসব পদ্ধতির কথা বলা আছে। যেগুলো যথাযথ ভাবে পূরণ না করলে কোনভাবেই প্রদত্ত আদেশ আইনসিদ্ধ হয় না। সচরাচর যেগুলো তারা মানেন না বা মানতে চান না। অন্যসব বাদ দিলেও কিছু বিষয় না বললেই নয়।
নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটগণ কেবল মোবাইল কোর্ট আইনে প্রদত্ত সিডিউলভূক্ত অপরাধগুলোর বিচার করার জন্য ক্ষমতাপ্রাপ্ত। সিডিউলভূক্ত অপরাধের বাইরের কোন অপরাধের বিচার করার এখতিয়ার তাদের নেই। কিন্তু হর হামেশাই তারা এই বিধানের তোয়াক্কা না করে তফশীলভূক্ত অপরাধের বাইরেও তাদের লম্বা হাতখানা ঢুকিয়ে দেন। বুঝে, না বুঝে তারা দেশের বিচার ব্যবস্থায় বিতর্ক সৃষ্টি করে চলেছেন। মহামান্য হাইকোর্ট বারবার তাদের এখতিয়ার বিহীন কার্যক্রমের লাগাম টেনে ধরতে নানান ধরনের নির্দেশনা প্রদান করলেও কিছুতেই তারা থামছেন না।
নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট যাকে সাজা দিতে চাচ্ছেন তাকে অবশ্যই নিজের দোষ স্বীকার করতে হবে। অভিযুক্ত ব্যক্তি যদি সেচ্ছায় দোষ স্বীকার না করেন তাহলে ম্যাজিস্ট্রেট কোনভাবেই তাকে সাজা শোনাতে পারবেন না। কেন এমন বিধান? সুস্পষ্ট কারণ আছে। মোবাইল কোর্ট ব্যবস্থায় অভিযুক্তের আত্মপক্ষ সমর্থনের কোন সুযোগ থাকে না। কিন্তু আইনের গুরুত্বপূর্ণ নীতি হচ্ছে যার বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হচ্ছে তাকে অবশ্যই আত্মপক্ষ সমর্থনের যথেষ্ট সুযোগ দিতে হবে। সংবিধানের ৩৫ ধারায় স্পষ্ট বলা আছে, কাউকেই তার নিজের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে বাধ্য করা যাবে না। আর আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে কাউকে সাজা দিলে সেটা কোনভাবেই বিচার প্রক্রিয়ার সাথে সমান্তরালে যায় না। কুখ্যাত অপরাধীকেও তার পক্ষে কৌশলী নিয়োগের সুযোগ দিতে হবে।
সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদে আইনের আশ্রয়লাভের অধিকার, ৩৫ অনুচ্ছেদে বিচার ও দন্ড সম্পর্কে রক্ষণ বিষয়ে বলা আছে। মোবাইল কোর্ট নামক ব্যবস্থায় যেহেতু বিচারের সাধারণ নিয়মগুলো মানা হয় না, সেহেতু অভিযুক্ত ব্যক্তি স্বেচ্ছায় তার দোষ স্বীকার করলেই তাকে সাজা দেয়া যাবে। দোষ স্বীকার বাস্তবিক অর্থেই করতে হবে, কোন রকম চাপ কিংবা হটকারিতা করে স্বীকারোক্তি আদায় করা যাবে না। কিন্তু নির্বাহী এই বিশেষ আদালতের বিরুদ্ধে অধিকাংশ সময়ে অভিযুক্তের স্বীকারোক্তি আদায়ে অযাচিত হস্তক্ষেপ আর জোর জবরদস্তির অভিযোগ আছে। এমনকি স্বীকারোক্তি আদায়ের বিশেষ কাগজে অভিযুক্তের স্বাক্ষর নেয়ার সময় তাকে বলা হয় না যে দোষস্বীকারের কাগজে সে স্বাক্ষর করছে। অথচ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের অবশ্য কর্তব্য হচ্ছে অভিযুক্তকে স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে বলা যে, সে দোষ স্বীকার করবে কিনা, খুব সতর্কতার সাথে তাকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলতে হবে, দোষ স্বীকার করতে তিনি বাধ্য নন। কোন রকম জোর জবরদস্তি কিংবা ছলনা করে না বুঝিয়ে স্বাক্ষর করিয়ে নিলে সেটা কোনভাবেই দোষস্বীকারোক্তি মর্মে গন্য হবে না।
মোবাইল কোর্ট অর্ডিনান্সের মাধ্যমে বিচার করতে হলে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে অবশ্যই ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকতে হবে। এর অর্থ হচ্ছে, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে অপরাধটি সংগঠিত হতে হবে। কোনভাবেই এই শর্তভঙ্গের সুযোগ নেই। কিন্তু আমরা সচারাচর দেখতে পাচ্ছি, পুলিশ অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে হাজির করছেন! আর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মহা-সমারোহে উক্ত অভিযুক্তকে বিভিন্ন মেয়াদে মূহুর্তের মধ্যে সাজা দিয়ে কারাগারে পাঠিয়ে দেন। কোন আইনে তারা এমনটা করেন? এই বিষয়ে বিস্তর আলোচনা জরুরী। কারন এখানে পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেট দু’পক্ষই আইন অমান্য করে দন্ডনীয় অপরাধ করছেন।
প্রথমে পুলিশের বিষয়ে আসা যাক। আসামী গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধি’র ৬০, ৬১ এবং ১৬৭ ধারা পুলিশকে অনুসরণ করতে হয়। সাধারণত পুলিশ আসামী গ্রেপ্তার করে দুই ভাবে; আদালত থেকে এরেস্ট ওয়ারেন্ট পেয়ে এবং আমলযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে ওয়ারেন্ট ছাড়া যে কোন মাধ্যমে খবর পেয়ে। আদালত থেকে ওয়ারেন্ট পেয়ে গ্রেপ্তার করলে আসামীকে কোন রকম বিলম্ব ছাড়া যত দ্রুত সম্ভব আদালতে হাজির করতে হবে। অন্যদিকে আদালতের এরেস্ট ওয়ারেন্ট ছাড়া কাউকে গ্রেপ্তার করলে ২৪ ঘন্টার মধ্যে আসামীকে এখতিয়ারাধীন ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট হাজির করতে হবে। এখানে ম্যাজিস্ট্রেট বলতে ফৌজদারী কার্যবিধি বলতে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বুঝায়। কোনভাবেই নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট হাজির করা যাবে না। পুলিশ কোন আইনে, কিসের ভিত্তিতে আসামীকে ধরে সরাসরি নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে নিয়ে যায়? নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কোন আইনে, কোন ক্ষমতায় এভাবে নিয়ম বহির্ভূতভাবে উপস্থাপিত আসামীকে সাজা প্রদান করেন? তিনি কি আইন জানেন না? নাকি জেনে বুঝেই এমনটা করেন? অবশ্য তিনি আইনের লোক না। নাও জানতে পারেন। বিচার করার খায়েশ মানুষের পুরনো প্রবৃত্তি। তাই বলে এমন বেপরোয়া ভাবে? এটা বিচার না, বিচার বিভাগের গালে চপেটাঘাত!
পুলিশ আসামীকে গ্রেপ্তার করে আইন অমান্য করে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট আসামীকে সোপর্দ করে সুস্পষ্ট অপরাধ করছে। পুলিশ আইন, ১৮৬১ সালের ২৯ ধারায় এ ধরনের আইনের লংঘন শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এছাড়াও দন্ডবিধি’র ২২০ ধারায় পুলিশের বিরুদ্ধে চার্জ আনা যেতে পারে। যেখানে বলা আছে কোন ব্যক্তি যদি যে পদমর্যাদা বলে কোন ব্যক্তিকে বিচারে প্রেরণ করার বা আটকে সোপর্দ করার আইনানুগ ক্ষমতা লাভ করে, সে পদমর্যাদায় অধিষ্ঠিত ক্ষমতা লাভ করে, সে পদমর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়ে, সে ক্ষমতা প্রয়োগ পূর্বক দুনীতিমূলকভাবে বা দুরভিসন্ধিমূলকভাবে কাউকে বিচারে বা আটকে সোপর্দ করে বা আটক করে রাখে, এবং এইরূপ কাজ দ্বারা সে আইন বিরুদ্ধ কার্য করছে বলে জানা সত্ত্বেও তা করে, তবে সে ব্যক্তি সাত বৎসর পর্যন্ত যেকোন মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদন্ডে অথবা অর্থ দন্ডে অথবা উভয়বিধ দন্ডেই দন্ডিত হবে।
অন্যদিকে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এখতিয়ার বহির্ভূতভাবে বিচারিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে গুরুতর অপরাধ করছেন। তারা দন্ডবিধির ২১৯ ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করছেন। এই ধারায় বলা আছে, কোন ব্যক্তি যদি কর্মচারী হিসেবে কোন বিচার বিভাগীয় কার্যক্রমের কোন পর্যায়ে কোন রিপোর্ট, আদেশ, রায় দুর্নীতিমূলকভাবে বা দুরভিসন্ধিমূলকভাবে প্রণয়ন করে বা ঘোষণা করে, যা আইন বিরুদ্ধ বলে সে জানে, তবে সে ব্যক্তি সাত বৎসর পর্যন্ত যেকোন মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদন্ডে অথবা অর্থদন্ডে অথবা উভয়বিধ দন্ডেই দন্ডিত হবে। এছাড়াও অবৈধ আটকের অভিযোগ তো স্পটভাবে করা যায়। যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া ছাড়া কোন নাগরিককে ৫ মিনিট আটকে রাখারও অধিকার কারো নেই।
আরেকটি খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়; শিশু আইন ২০১৩ এর ১৬ ধারায় অপরাধের সাথে জড়িত শিশুর বিচার কেবল শিশু আদালতই করবে বলা থাকলেও মোবাইল কোর্ট নামক সাজার স্প্রিন্টার মেশিন শিশুদেরও রেহাই দিচ্ছে না। হাজার হাজার শিশু এই অযাচিত এখতিয়ারবিহীন কোর্টের রায়ে কারাগারে। সম্প্রতি মহামান্য হাইকোর্টের নজরে বিষয়টি আসলে মহামান্য হাইকোর্ট মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে সাজাপ্রাপ্ত সব শিশু আসামিকে বিচার পদ্ধতির ত্রুটির কারনে ছেড়ে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। মহামান্য হাইকোর্টের নজরে না আসলে হাজার হাজার শিশু ভুল বিচারের স্বীকার হয়ে জেলেই পচে মরতো। হাইকোর্টের নজরে আসার আগেই যে অসংখ্য অন্যায় হয়ে যাচ্ছে, তার বিচার কে করবে? এই লাগামহীনতার রশি টাঁনবে কে?
পদ্মা-মেঘনা বিধৌত চর এলাকা নিয়ে শরীয়তপুর জেলা। এখানকার নদী তীরবর্তী মানুষের প্রধান পেশা মৎস্য শিকার। বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে সরকার মা ইলিশ আহরণে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে সরকারের এই পরিকল্পনা সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু স্থানীয় জেলেদের নির্দিষ্ট ঐ সময়ে বিকল্প কর্মসংস্থান অথবা পর্যাপ্ত ভর্তুকির বিষয়টিও সরকারের মাথায় থাকা উচিত। এ বছর এই নিষেধাজ্ঞার সময়টিতে যা হয়েছে তা নজিরবিহীন। প্রায় ১৯০০ জেলে এবং ইলিশ ক্রেতা-বিক্রেতা-বহনকারীকে জেল হাজতে প্রেরণ করা হয়েছে। স্বাভাবিক সময়েও যেখানে কারাগারে ধারন ক্ষমতার কয়েকগুন হাজতী-কয়েদী থাকে, সেখানে হুট করে অতিরিক্ত ১৯০০ লোক’কে জায়গা দেয়া কারা-কর্তৃপক্ষের জন্য অসম্ভব হয়ে যায়। বাধ্য হয়ে পাশ্ববর্তী অন্যান্য জেলার কারাগারে আসামীদের প্রেরণ করতে হয়েছে। সেখানেও ইতিমধ্যে ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত হাজতী-কয়েদী আছে। পাঠকদের মনে প্রশ্ন আসতে পারে এই আলোচনার সাথে মোবাইল কোর্টের কি সম্পর্ক? সম্পর্ক আছে। এই যে ১৯০০ মৌসুমী আসামী জেলে ঢুকলো এদের সবাই মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে সাজা প্রাপ্ত। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে, এদের অধিকাংশকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অথবা সহকারী কমিশনার (ভূমি) এর কাছে হাজির করলে সংশ্লিষ্ট নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তাদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দিয়ে কারাগারে প্রেরণ করেছেন যা কোনভাবেই তারা করতে পারেন না। এই বিপুল সংখ্যক আসামী কবে নাগাদ আপিলের সুযোগ পাবে আর কবে নাগাদ জামিনের আবেদন করতে পারবে তাও অনিশ্চিত। অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে প্রদত্ত সাজার বিরুদ্ধে আপিল করতে হলে আদেশের সহিমোহরী নকল প্রয়োজন। সেটা তুলতে আসামী পক্ষের রীতিমতো যুদ্ধজয় করতে হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে নকল পেতে এক থেকে দেড় মাস এমনকি তারও বেশি সময় লেগে যায়। অথচ আসামীর ন্যায়সঙ্গত অধিকার যথাসম্ভব দ্রুত রায়ের নকল পাওয়া। ইতিমধ্যে বিষয়টি হাইকোর্টের নজরে আসলে মহামান্য হাইকোর্ট ৫ কর্মদিবসে রায়ের নকল প্রদানের জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। ইচ্ছাকৃতভাবে এমন অহেতুক বিলম্বের পরে আবার আসে শুনানির জন্য নির্ধারিত দিনের প্রসঙ্গ। অতিরিক্ত জেলা মেজিস্ট্রেট আদালতে বিচারক এক দিন বসলে চারদিন বসেন না। শুনানির নির্ধারিত দিনে কোর্ট না উঠলে আবার অনিশ্চিত অপেক্ষা। এক ধরনের ফাঁদে আটকে যায় বিচার প্রার্থীর ভাগ্য। এক কথায় বিচারের নামে প্রহসন চলছে এই মোবাইল কোর্ট ব্যবস্থায়।
শেষ করবো আলোচ্য বিষয়ের সাথে প্রাসঙ্গিক একটা বিশেষ মামলায় হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণ এবং নির্দেশনার মাধ্যমে যেখানে মহামান্য হাইকোর্ট রীতিমতো অন্যায় আদেশ প্রদানকারী সংশ্লিষ্ট নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এবং এ কাজে সহযোগিতাকারী সংশ্লিষ্ট থানার ওসি’কে অন্যত্র বদলীর নির্দেশ দিয়ে চরম ভৎসনা করেছেন। The state VS UNO of Sakhipur, Tangail & another, 2017 (1) LNJ 239, এই মামলায় পুলিশ সাব্বির শিকদার নামের এক স্কুল ছাত্রকে ফেসবুকে স্থানীয় সাংসদকে হুমকি দেয়ার অভিযোগে গ্রেপ্তার করে টাংগাইলের সখিপুর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা রফিকুল ইসলামের কাছে হাজির করে। রফিকুল ইসলাম আসামীকে তথ্য প্রযুক্তি আইনে দুই বছরের সাজা দিয়ে কারাগারে প্রেরণ করেন। ঠিক কোন ধারায় সাজা দিয়েছেন তা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব জানতেন না! কতটা হাস্যকর! ঘটনাটি দেশের অধিকাংশ জাতীয় দৈনিকে স্থান পায়। ২০১৬ সালের ২০ সেপ্টেম্বর দি ডেইলি স্টারে’র একটা সংবাদকে নজরে এনে মহামান্য হাইকোর্ট স্ব-প্রনোদিত হয়ে রুল জারি করে মামলার নথিসহ সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং থানার ওসি’কে তলব করেন। হাইকোর্ট এ ধরনের আদেশ কেন অবৈধ হবে না জানতে চান। এরপরেই শুরু হয় নানান নাটক। নথি টেম্পারিংসহ পুরো আইনটাই বদলে ফেলার গভীর ষড়যন্ত্র শুরু হয়। তথ্য প্রযুক্তি আইন হয়ে যায় মাদব দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন। মোবাইল কোর্ট আইনের ৫, ৬, ৭ ধারায় বিচার পদ্ধতি সম্পর্কে যেই স্পষ্ট বিধান আছে তার কিছুই এখানে মানা হয় নি।
অভিযুক্ত পুলিশ আর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শপথপূর্বক আলাদা আলাদা বক্তব্য পেশ করেন। তারা তাদের বক্তব্যে জাতীয় পত্রিকার সংবাদ মিথ্যা ও বানোয়াট দাবী করেন। তারা জানান, আসামী সাব্বির সিকদারকে সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট ১০০ গ্রাম গাজাঁসহ হাতেনাতে ধরে সাজা দিয়েছেন। তথ্য প্রযুক্তি আইনে সাজা দেননি। অথচ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাহেব আদেশের দিন সাংবাদিকদের জানান, স্থানীয় সাংসদকে ফেসবুকে হুমকি দেয়ায় আসামী সাব্বিরকে তথ্য প্রযুক্তি আইনে সাজা দেয়া হয়েছে। সাংবাদিকরা কোন ধারায় সাজা দিয়েছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন “এ মূহুর্তে মনে নেই”! ২০১৬ সালের ২৪৫ নং মামলাটির নথি পর্যালোচনায় মহামান্য হাইকোর্ট দেখতে পান পুলিশ একটি কম্পিউটার টাইপড অভিযোগ এবং একটি কম্পিউটার টাইপড সিজার লিস্ট করেছেন। অথচ মোবাইল কোর্ট পরিচালনার সময় আস্ত কম্পিউটার নিয়ে অভিযানে যাওয়া অসম্ভব। স্বাভাবিকভাবেই মহামান্য হাইকোর্টের সন্দেহের উদ্রেক হয়। আর যেই তারিখে অভিযান পরিচালিত হয়েছে দাবি করা হয়েছে সেই তারিখে কথিত আসামী গ্রেপ্তার হয়ে পুলিশের হেফাজতে ছিলো। সাজানো অভিযানের দুই দিন আগেই সাব্বিরকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে যায়। তাহলে কিভাবে তাকে ম্যাজিস্ট্রেট অভিযান পরিচালনা করে ১০০ গ্রাম গাজাঁসহ গ্রেপ্তার করে সাজা দিলেন?
শেষমেষ মহামান্য বিচারপতি এম. এনায়েতুর রহিম তার জাজমেন্ট প্রকাশ করেন, যেখানে তিনি বলেন,
‘On careful examination of the above provisions of the Mobile Court Ain, 2009 it is crystal clear that the Magistrate who is empowered for holding a Mobile Court under the Mobile Court Ain, 2009 must take cognizance of the alleged offence instantly at the spot provided the same has been committed or unfolded in his presence and the said Magistrate is also empowered to convict the accused and award the prescribed sentence to him if he pleads guilty. Cognizance of the offence has to be taken by the concerned Magistrate instantly on the spot and lodgment of written complainant with the Magistrate is not at all required. There is no scope to convict a person under the Ain, 2009 who was apprehended or arrested or detained by the police prior to his trial that is before commencement of Mobile Court proceeding. And if anyone is convicted in the aforesaid manner, the whole proceeding of the Mobile Court will be vitiated and the order of conviction is illegal and without jurisdiction.’
এ আদেশে মহামান্য হাইকোর্ট নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এবং ওসি’কে চরমভাবে ধিক্কার জানান। তাদের দূরে কোথাও বদলী করতে সরকারকে নির্দেশ দেন। এমন সাজা পেয়েও যদি এদের বোধদয় না হয়, তাহলে হতাশ হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। একই ধরনের অন্যায় বিচার এখনো হরহামেশাই করা হচ্ছে। মহামান্য হাইকোর্ট বারবার সতর্ক করার পরেও এমনটা চলতে থাকলে হয়তো যেকোন সময় কোন অন্যায় আদেশ দেয়া নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কিংবা পুলিশের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অপরাধের চার্জ আনারও প্রয়োজন দেখা দিতে পারে। ভিকটিম নিজে কিংবা যেকোন নাগরিক (কার্যবিধি’তে বাধা না থাকলে) অথবা বিজ্ঞ চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯০(১)(গ) তে চাইলে স্বপ্রণোদিত হয়ে সংশ্লিষ্ট নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এবং পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনতে পারেন। দেশের কিছু জেলার বিজ্ঞ চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ইতিমধ্যে পুলিশকে সাবধান করে চিঠিও দিয়েছেন যাতে তারা আসামী ধরে আইন অমান্য করে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট উপস্থাপন না করে। সতর্ক বা সাবধান করা এক ধরনের সংকেত। সংকেতের গণনা শেষেই ঝড় আচড়ে পড়ে। শুভবুদ্ধির উদয় হোক। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় সব বাধা দূর হোক।
লেখক: আইনজীবী, শরীয়তপুর জজ কোর্ট; ই-মেইল: mdshahidulislam0038@gmail.com
বিশেষ দ্রষ্টব্য: এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম -এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।