অ্যাডভোকেট মুরাদ মোর্শেদ:
সাক্ষ্য আইন হলো সাক্ষ্য ও সাক্ষী সম্পর্কে মূল আইন। আইনটিতে তত্ত্বগত আইনের অনেক বৈশিষ্ট্য থাকলেও লক্ষ্য করার মতো একটি বিষয় হলো – অনেকাংশেই এটি পদ্ধতিগত চরিত্রের আইন। কেননা, ফৌজদারি কার্যবিধি ও দেওয়ানি কার্যবিধিদ্বয়ে আদালতের কাজের পদ্ধতি বর্ণনা করা আছে, এমনকি সাক্ষ্য ও সাক্ষী সম্পর্কেও কমবেশি বলা আছে; কিন্তু এগুলোর আরো বিস্তারিত ও সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যা সেগুলোতে দেওয়া নেই। বিশেষ করে একটি মামলা বা মোকদ্দমায় কীভাবে প্রমাণ করতে হবে, জেরা বা জবানবন্দির ধরণ-বৈশিষ্ট্য কী হবে, একটি ঘটনা বা বিরোধের বিষয়বস্তু নিয়ে আদালত কোন বিষয়গুলো শুনবে আর কোন বিষয়গুলো পরিতাজ্য ইত্যাদির নির্দেশনা বা ব্যাখ্যা নেই। এসমস্ত ঘাটতি পূরণের কাজটিই করেছে সাক্ষ্য আইন। ফলে, এটি একটি পদ্ধতিগত আইন হিসেবেই স্বীকৃত।
১৮৭২ সালে প্রণীত এই আইনটি খুব বড় বা দীর্ঘ নয়। মাত্র ৩ টি খণ্ড আর ১৬৭ টি ধারায় সাক্ষ্য ও সাক্ষী সম্পর্কে প্রায় সব কথাই উঠে এসেছে। এই আইন ফৌজদারি কার্যবিধি ও দেওয়ানি কার্যবিধি উভয়টিতেই পুরো মাত্রায় কাজে লাগে। সাক্ষী ছাড়া মামলা-মোকদ্দমার কোনো গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয় না। মামলার ন্যায়বিচারে সাক্ষ্যই সবচেয়ে বড় সম্বল। একটি আদালতের চেয়ারে বসে শুধুই মামলার বিরোধীয় পক্ষগণের উপস্থাপিত সাক্ষ্যের ভিত্তিতেই একজন বিচারককে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে যেতে হয়। ফলে সাক্ষ্য, সাক্ষী, প্রমাণ, প্রমাণের পদ্ধতি, বিচার্য ঘটনা ইত্যাদি অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আইনে নির্দিষ্ট হওয়াটা অনিবার্য ছিলো। সাক্ষ্য আইন এরই ফসল। সাক্ষ্য আইনে সাক্ষ্যের মৌলিক নীতি ও এর বিভিন্ন তত্ত্বগত ও পদ্ধতিগত উভয়ই বর্ণনা করা আছে। মূল আইনে উক্ত ১৬৭ টি ধারাকে দেখা যায় ৩টি প্রধান অংশে বিভক্ত করাই আছে। সেই অনুযায়ীই এই আইনের ধারা ও বিষয়বস্তুর বিভক্তি আপনাকে মনে রাখতে হবে। সংশ্লিষ্ট একটি ছক দিয়ে রাখলাম নিচে। কুইক ওভারভিউ এর জন্য এটি কাজে দেবে আপনার।
সাক্ষ্য আইনের প্রথম খণ্ডে ধারা ১ থেকে ৫৫ পর্যন্ত আলোচনা বিধৃত আছে মূলত সাক্ষ্য আইনের মৌলিক কিছু বিষয়। এই অংশ থেকে এমসিকিউ প্রশ্ন বেশি না আসলেও এগুলো ভালো করে বুঝে নিতে হবে। এখানে প্রথম অধ্যায়ে ধারা ১ থেকে ৪ পর্যন্ত ‘প্রাথমিক বিষয়’ শিরোনামে কিছু বিষয়ের সংজ্ঞা দেওয়া আছে। অন্যান্য আইনের মতো সংজ্ঞা অংশে অসংখ্য সংজ্ঞা দেওয়া না থাকলেও এটা মনে রাখতে হবে যে, পুরো সাক্ষ্য আইন জুড়েই নানা বিষয়ের সংজ্ঞা বা ধারণাগত ব্যাখ্যা দেওয়া আছে। এই প্রথম অধ্যায়ের ‘ব্যাখ্যা অনুচ্ছেদ’ শিরোনামে ৩ ধারায় যে সমস্ত শব্দের ব্যাখ্যা দেওয়া আছে সেগুলো ভালো করে বুঝে নিতে হবে আপনাদেরকে। ঘটনা বা বিষয়, প্রাসঙ্গিক ঘটনা, বিচার্য বিষয়, দলিল, আদালত ইত্যাদি শব্দের অর্থ শুরুতেই ভালো করে বুঝে নিতে হবে এখানে।
এর দ্বিতীয় অধ্যায়ের মূল শিরোনাম ‘ঘটনার প্রাসঙ্গিকতা’ যার বিস্তৃতি ৫ থেকে ৫৫ ধারা পর্যন্ত। তবে এখানে অনেকগুলো উপশিরোনামে সাক্ষ্য আইনের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ধারণা আলোচিত হয়েছে। যেমন, স্বীকৃতি ও দোষ স্বীকারোক্তি, মৃত্যুকালীন ঘোষণা, আদালতের রায় যখন প্রাসঙ্গিক, চরিত্র যখন প্রাসঙ্গিক ইত্যাদি প্রসঙ্গ।
শুরুতে ১৭-৩১ ধারার বিষয়বস্তুর প্রতি বিশেষ দৃষ্টিপাত করা যেতে পারে। খেয়াল করলে দেখা যায় যে, ১৭-৩১ ধারা পর্যন্ত ধারাগুচ্ছের মূল শিরোনাম ‘স্বীকৃতি’ হলেও, এই শিরোনামের অধীনে ‘স্বীকৃতি’ [Admission] এবং ‘দোষ স্বীকার’ [Confession] – এই দুইটি টপিকে প্রধানত আলোচনা করা আছে। এই দুইটি অংশকে এইভাবে ভাগ করে ফেলা যায় যে,
১. স্বীকৃতির প্রসঙ্গ : ১৭-২৩ ধারা
২. স্বীকারোক্তি বা দোষ স্বীকার প্রসঙ্গ : ২৪-৩১ ধারা
১৭ ধারায় স্বীকৃতির সংজ্ঞা দেওয়া থাকলেও ধারাতে বলা আছে যে, নিচের বা পরবর্তী [১৭ ধারার পরের ধারাগুলোতে] ধারাগুলোতে উল্লেখ আছে, স্বীকৃতি কারা কারা দিতে পারবেন। সেদিক থেকে ১৭ ধারা শুধু এককভাবে না বুঝে ১৮, ১৯ ও ২০ ধারাকে মিলিয়ে পড়তে হবে; তাহলে একটি সামগ্রিক উপলব্ধি তৈরি হবে। এ প্রসঙ্গে আমার লেখা ‘চিরুনি অভিযান’ বইটি থেকে উক্ত প্রাসঙ্গিক অংশের আলোচনা এখানে তুলে দিলাম। দেখুন কাজে লাগে কিনা!
“১৭ ধারামতে, স্বীকৃতি প্রধান বৈশিষ্ট্য
“…
১. স্বীকৃতি মৌখিক বা লিখিত হতে পারে।
২. বিচার্য বিষয় বা প্রাসঙ্গিক বিষয় সম্পর্কে স্বীকৃতি হতে হবে।
ধারা ১৮ থেকে ২৩ পর্যন্ত কোনো ঘটনায় কে বা কারা কারা স্বীকৃতি দিতে পারবেন এবং তা কোন কোন শর্তে বা পরিস্থিতিতে তার বিষয়ে আলোচনা আছে। ১৮, ১৯ ও ২০ ধারা পর্যালোচনা করলে কয়েক ধরনের ব্যক্তির উল্লেখ পাওয়া যায় যারা কিনা এই স্বীকৃতি দিতে পারেন। নিচে সেগুলোর উল্লেখ করে রাখলাম। ধীরে সুস্থে বুঝে বুঝে এইসব ব্যক্তির পরিচয়টা মাথায় গেঁথে রাখুন।
১. মামলার কোনো পক্ষ [ধারা ১৮]।
২. মামলার কোনো পক্ষের প্রতিনিধি [ধারা ১৮]।
৩. প্রতিনিধিত্বমূলক চরিত্রের কোনো বাদী বা বিবাদী [ধারা ১৮]।
৪. মামলার বিষয়বস্তুতে যৌথ স্বার্থ আছে এমন ব্যক্তিগণ [ধারা ১৮]। যেমন ধরুন, এক ভাই তার মায়ের জমি জাল দলিল করে নিজের নামে নিয়েছে। ভাইটির আরো তিনজন বোনের একজন মামলা করেছে সেই ঘটনায়। এবং অপর দুই বোনের সেখানে যৌথ স্বার্থ আছে। জাল দলিল প্রমাণ করতে পারলে অপর ৩ বোনই সেই জমির অংশীদার হবে।
৫. মামলার বিষয়বস্তুতে মামলার পক্ষগণ যাদের কাছ থেকে স্বার্থপ্রাপ্ত হয়েছেন, সেইসব ব্যক্তিগণ [ধারা ১৮]। যেমন ধরুন, আপনি একটি জমি কিনেছেন, কিন্তু জমিটি দখল করেছেন অন্যজন এবং এই ঘটনায় আপনি একটি মামলা করেছেন। তখন উক্ত জমির বিক্রেতাও মামলায় স্বীকৃতি আকারে মৌখিক বা লিখিতভাবে আদালতে তার কথা বলতে পারবেন। কেননা, উক্ত জমি তার কাছ থেকে কিনেই আপনি আপনার মামলার বিষয়বস্তুতে স্বার্থপ্রাপ্ত হয়েছেন।
৬. তৃতীয় যেকোনো ব্যক্তি যিনি মামলার পক্ষদ্বয়ের অবস্থান বা দায় নির্দিষ্ট করার ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক যেমন, মনিবের ক্ষেত্রে তার ভৃত্য, মালিকের ক্ষেত্রে তার এজেন্ট অথবা এর বিপরীতটা, এ রকম আরো বহু ক্ষেত্রের তৃতীয় ব্যক্তি যিনি মামলার সরাসরি পক্ষ নন [ধারা ১৯]।
৭. তৃতীয় যেকোনো ব্যক্তি যার বা যাদের কথা মামলার বিষয়বস্তু সম্পর্কে তথ্য বা মতামত আকারে প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ আছে, তার বা তাদের কথা স্বীকৃতি হিসেবে নেওয়া যাবে [২০ ধারা]।
তো এবার ধারাগুলো পড়ে ফেলুন। ধারাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুধু পড়লেই হবে না, সাথে সাথে উপরে দেওয়া তালিকাটির সাথে মিলিয়ে মিলিয়ে পড়ুন। …” [পৃষ্ঠা ৪২০-৪২১, একটি চিরুনি অভিযান – এমসিকিউ পর্ব]।
এবার, এর দ্বিতীয় অংশে এলে ২৪ ধারা পাওয়া যায় যা কিনা পপুলারলি দোষ স্বীকার এর ধারা হিসেবে পরিচিত। এই অংশে যাবার আগেই একটি বিষয় খেয়াল রাখবেন যে, ২৩ ধারায় দেওয়ানি মোকদ্দমায় স্বীকৃতির প্রাসঙ্গিকতার আলাপ করেই ২৪ ধারায় ফৌজদারি মামলায় যখন দোষ স্বীকারোক্তি অপ্রাসঙ্গিকতা আলোচনা করেছে। তার মানে ২৩ ও ২৪ ধারা দুইটি দুইটি বিষয়ের ডিমার্কেশন লাইন টেনে দিয়েছে। একটি অংশ স্বীকৃতির শেষ ধারা, অন্যদিকে, আরেকটি অংশে দোষ স্বীকার বা স্বীকারোক্তির শুরুর ধারা। আবার এটিকে অন্যভাবেও ভাবা যেতে পারে, একটি অংশ দেওয়ানি সংক্রান্ত, অন্যটি ফৌজদারি মামলা সংক্রান্ত।
দোষ স্বীকার বা স্বীকারোক্তি অংশে অনেকেই হয়তো একটি বিষয় খেয়াল করেন না যে, ২৪ ধারায় যা বলা হয়েছে, তার ঠিক উল্টো বিষয় বর্ণিত আছে ২৮ ধারায়! ২৪ ধারায় বলা আছে একটি দোষ স্বীকার কখন অপ্রাসঙ্গিক, আর ২৮ ধারায় বলা আছে কখন একটি দোষ স্বীকার প্রাসঙ্গিক! এই দুইটি ধারার শিরোনাম ও ধারার মূল বক্তব্য জাস্ট একে অপরের পরিপূরক এবং উল্টো। মানে, ২৮ ধারাতে ২৪ ধারার কথাটিই উল্টিয়ে বলা আছে।
অন্যদিকে, ২৫, ২৬ এবং ২৭ ধারা ধারাবাহিকভাবে মনে রাখার জন্য নিম্নোক্তভাবে মনে রাখতে পারেন।
পুলিশ কর্মকর্তার সামনে দোষ স্বীকার : ২৫ ধারা
পুলিশ হেফাজতে দোষ স্বীকার : ২৬ ধারা
পুলিশ আলামত উদ্ধার করলে : ২৭ ধারা
বোল্ড করা অংশটির তথ্য দিয়ে মনে রাখার চেষ্টা করলে সবচেয়ে ভালো করবেন। এই অংশটির সারসংক্ষেপ একটি চিত্রের মাধ্যমে নিচে তুলে ধরার চেষ্টা করা হলো।
ধারা ৩২ এবং ৩৩ প্রসঙ্গে এবারে সেই মূল বই থেকে আবারো আলোচনা তুলে দিচ্ছি। ধারা ৩২ মূলত মৃত্যুকালীন ঘোষণার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ধারণ করে বলে এটি এই বিষয়ের ধারা হিসেবেই সুপরিচিত। কিন্তু এই দুইটি ধারা মিলে আরো যা যা বলা আছে, সাক্ষ্য আইনে সেগুলোও অতি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা ও ব্যাখ্যা। এটি পড়ার সময় এই দুইটি ধারার বিষয়বস্তুর মূল শিরোনাম বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখতে বলবো; কেননা শিরোনামটি বুঝলেই এটি মনে রাখার ক্ষেত্রে খুব কাজে দেবে। এর মূল শিরোনাম হলো – ‘যেই সকল লোককে সাক্ষী হিসেবে তলব করা যায় না, সেই সকল লোকের বিবৃতি’ — অর্থাৎ, উক্ত লোকেদের বিবৃতির প্রাসঙ্গিকতা বা বিবৃতির পরিণতি। তো, ৩২ ও ৩৩ ধারার আগে আমরা দেখে আসলাম, যারা বিবৃতি বা দোষ স্বীকারোক্তি দিচ্ছেন, তারা সরাসরি হাজির থেকে তা দিচ্ছেন। কিন্তু, যারা হাজির হতে পারবেন না বা অনুপস্থিত, তাদের ক্ষেত্রে কখন কোনো বিবৃতি প্রাসঙ্গিক হতে পারে তারই বর্ণনা এই ৩২ ও ৩৩ ধারায়। খেয়াল করুন যে, বেশ গোছানোভাবেই সাক্ষ্য আইনে এই বিষয়সমূহ একের পর এক আলোচনা হয়েছে। এভাবে বিষয়বস্তুর সাথে সম্পর্কিত একবার বুঝে উঠতে পারলে সাক্ষ্য আইন মনে রাখা, তা ধারাভিত্তিক হোক আর তত্ত্বগত দিক থেকে হোক, পানির মতো সহজ হয়ে উঠবে।যাই হোক, নিচের আলোচনাটি পড়ে নিয়ে মূল ধারা দুইটি আবারো নতুন করে পড়ে নিন, দেখুন নতুন কিছু শিখলেন কিনা!
“… সাধারণভাবে আমরা জানি যে, আদালতে কোনো সাক্ষ্য যিনি দেবেন তা মৌখিক হোক আর লিখিত হোক, তাকে নিজেই আদালতে হাজির থেকে সাক্ষ্য দিতে হয়। কিন্তু এর কিছু ব্যতিক্রম আছে। সেই ব্যতিক্রমটাই এই ধারা দুইটির বিষয়বস্তু। যেই উপশিরোনামের অধীনে এই ধারা দুইটি আছে সেটা এরকম – ‘যেই সকল লোককে সাক্ষী হিসেবে তলব করা যায় না, তাহাদের বিবৃতি’। শিরোনামে তার মানে কথাটা পরিষ্কার যে, যারা সাক্ষী হিসেবে সাধারণভাবে গ্রহণযোগ্য নয়, তাদের কথা বা সাক্ষ্য যখন গ্রহণযোগ্য হয় বা প্রাসঙ্গিক হয় – সে প্রসঙ্গে আলোচনা। ৫ ধরনের মানুষের ক্ষেত্রে তাদের উপস্থিতি ছাড়াও তাদের সাক্ষ্য লিখিত অথবা মৌখিক যেভাবেই থাকুক না কেন তা গ্রহণযোগ্য বা প্রাসঙ্গিক হবে। ৫ ধরনের মানুষ কারা বা ক্ষেত্রগুলো কী কী?
১. মৃত ব্যক্তি
২. নিখোঁজ ব্যক্তি, বা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না এমন ব্যক্তি
৩. সাক্ষ্য দিতে অক্ষম বা অযোগ্য ব্যক্তি
৪. যে ব্যক্তিকে হাজির করা অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ
৫. যে ব্যক্তিকে হাজির করা অত্যন্ত ব্যয়সাপেক্ষ।
তার মানে এই ৫ ধরনের ব্যক্তির ক্ষেত্রে কোনো কারণে তাদের দেওয়া পূর্ববর্তী লিখিত বা মৌখিক বক্তব্য একটি মামলায় প্রাসঙ্গিক আকারে গ্রহণীয় হতে পারে এবং তা সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে, যদিও এই সমস্ত ক্ষেত্রে উক্ত সকল সাক্ষী উপস্থিত নাও থাকে! ক্লিয়ার?কিন্তু এই ৫টি ক্ষেত্রের বর্ণিত লোকেদের সব বিষয়ের বক্তব্যই আদালতে গৃহীত হবে না। এরও নিয়ম রয়েছে। নির্দিষ্ট ৯টি ক্ষেত্রে তাদের সাক্ষ্য তাদের অনুপস্থিতিতেও গ্রহণযোগ্য হবে। সেগুলো হলো –
১. মৃত্যুকালীন ঘোষণা [ যেমন, তার মৃত্যু সম্পর্কে মৃত্যুর আগে আগে বলে যাওয়া কোনো বিবৃতি ]
২. পেশাগত কাজ সম্পর্কিত স্বাভাবিক বিবৃতি [যেমন, একজন হিসাবরক্ষকের কোনো হিসাব সম্পর্কে কোনো বিবৃতি, এমনকি অফিসের হিসাবের খাতা]
৩. নিজ স্বার্থবিরোধী উক্তি [যে উক্তি নিজের স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়, যেমন, কেউ একজন বললো যে সে মি. করিমের কাছ থেকে ১ লক্ষ টাকা ধার হিসেবে নিয়েছিলো। তার এই ধার নেওয়া সম্পর্কে বিবৃতিটি তার নিজ স্বার্থবিরুদ্ধ বক্তব্য]
৪. গণস্বার্থ বা কোনো প্রথার অস্তিত্ব সম্পর্কে বিবৃতি
৫. আত্মীয়তা বা সম্পর্ক প্রসঙ্গে কোনো উক্তি বা বিবৃতি
৬. পারিবারিক দলিল বা কোনো উইলে দেওয়া বিবৃতি
৭. স্বত্ব সৃষ্টিকারী দলিলে বিবৃতি
৮. জনতা কর্তৃক কোনো বিবৃতি যদি তা কোনো মোকদ্দমায় প্রাসঙ্গিক হয়।
৯. একই বিষয়ে একই পক্ষবৃন্দের মামলায় পূর্বের কোনো মামলায় প্রদত্ত সাক্ষ্য বা বিবৃতি। [ধারা ৩৩ মোতাবেক]
৯টি কারণের ৯ নং টি ধারা ৩৩ সম্পর্কিত। ধারা ৩৩ এর মূল কথা এটাই যে, কখনো পূর্বে আদালতে দেওয়া বিবৃতি প্রাসঙ্গিক হবে যদি পরবর্তী আরেকটি মামলা উক্ত একই পক্ষবৃন্দের ভেতর বা একই বিষয়বস্তু নিয়ে অন্য কোনো কারণে অনুষ্ঠিত হয়। সেক্ষেত্রে ধরুন যে, আগে দেওয়া সাক্ষী ব্যক্তিটি মারা গেছেন বা নিখোঁজ বা তাকে আনা ব্যয় অথবা সময়সাপেক্ষ ইত্যাদি – তাহলে আগের মামলায় দেওয়া সাক্ষ্য পরবর্তী মামলায় উক্ত সাক্ষীর অনুপস্থিতিতেও গ্রহণীয় বা প্রাসঙ্গিক হবে।
উপরোক্ত বর্ণিত ৫টি ক্ষেত্র মনে রাখতে হবে এবং যেই ৯টি ক্ষেত্রে উক্ত ৫টি ক্ষেত্রের লোকের সাক্ষ্য গ্রহণীয় সেই ৯টি ক্ষেত্র মনে রাখতে হবে।
এছাড়া বিশেষ অবস্থায় বিবৃতি সাক্ষ্য আইনে কখন কিভাবে প্রাসঙ্গিক তা আলোচনা করা আছে ৩৪ থেকে ধারাগুলোতে। এর ভেতর অন্তত মনে রাখেন যে, হিসাবের খাতা [৩৪ ধারা মোতাবেক], সরকারি রেকর্ড [৩৫ ধারা মোতাবেক], ম্যাপ বা নকশা ইত্যাদি [৩৬ ধারা মোতাবেক] এগুলো সাক্ষ্য হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। কোনো বিবৃতির যে অংশ প্রমাণ করিতে হইবে শিরোনামে ধারা ৩৯ একবার দেখে নেবেন।” [পৃষ্ঠা ৪২৮-৪২৯, একটি চিরুনি অভিযান – এমসিকিউ পর্ব]।
এর বাইরে ৪০ ধারাটি খুব ভালো করে বুঝে রাখবেন। ‘বিশারদের অভিমত’ সম্পর্কে ৪৫-৫১ পর্যন্ত বিশেষত ৪৫ এবং ‘চরিত্র যখন প্রাসঙ্গিক’ সম্পর্কে ৫২-৫৫ পর্যন্ত প্রতিটি ধারাই গুরুত্বপূর্ণ। আলোচনার বিস্তৃতি কমানোর জন্য আমরা এখানে চরিত্র সম্পর্কে [চরিত্র নিয়ে টানাটানি! :)] সামান্য আলোচনা করবো। এটা নিয়ে একবার দুইবার পড়েই শিক্ষার্থীগণ ভুলে যান বারংবার।
এখানে মোট ৪টি ধারা। ৫২, ৫৩, ৫৪ এবং ৫৫। এই ধারাগুলোর ভেতরে শুরুর এবং শেষের ধারা দুইটি, তথা ৫২ ও ৫৫ ধারা দেওয়ানি মোকদ্দমার বিষয়ে বলেছে। অন্য ধারা দুইটি তথা ৫৩ ও ৫৪ ধারা দুইটি ফৌজদারি মামলা সম্পর্কে বলেছে।
একজন সাক্ষী বা বাদী বা বিবাদীর চরিত্রের কথা সাক্ষ্য আইনে এলো কেন? কীভাবে এলো? ধরুন, ক একজন চোর। কিন্তু, সে চোর বলেই সে কোনো বিচার প্রার্থনা থেকে বঞ্চিত হবে না। আবার, পূর্বে চোর ছিলো বলেই সে আসামি হিসেবে তার আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হবে না। আবার, একজন ব্যভিচারি লোক যদি জমির দখল নিয়ে বা স্বত্ব নিয়ে কোনো মোকদ্দমা করে বা সেই মোকদ্দমার প্রতিপক্ষ বা বিবাদী হয়, ব্যভিচারি হবার কারণে সেই তথ্য এই মোকদ্দমায় কোনোভাবেই প্রাসঙ্গিক নয়। কেননা, এটি একটি দেওয়ানি মোকদ্দমা এবং দেওয়ানি মোকদ্দমায় চরিত্র কখনো প্রাসঙ্গিক নয়। অর্থাৎ, আদালত আন্দাজে আন্দাজে চরিত্র নিয়ে কথা শুনবে না। আরেকটু ক্যাজুয়ালি বললে এভাবে বলা যায় যে, চরিত্র নিয়ে আজাইরা কথা আদালত শুনবেন না।
আবার, আরেকটি কথা আপনারা জানেন যে, একজন অভিযুক্তকে বিচার শেষ হবার আগেই কোনোভাবে তাকে দোষী হিসেবে বলা যায়না। তো, একজন অভিযুক্তকে বিচার চলাকালীন তাকে যে বিষয়ে অভিযুক্ত করা হয়েছে তাকে সেই বিষয়ে খারাপ চরিত্রের অধিকারী বলা যাবে না যতক্ষণ না পর্যন্ত তা প্রমাণ হচ্ছে। এটাই সাধারণ নীতি। আবার, এমন হতে পারে যে একজন অভিযুক্ত ব্যক্তি দোষী সাব্যস্ত হলো। ধরা যাক, চোর বলে সাব্যস্ত হলো এবং বিচারে দণ্ডিত হয়ে শাস্তি ভোগ করে আবারো চুরিতে ধরা পড়লে তখন পূর্বতন সেই দণ্ডটি বা সেই কারণে খারাপ চরিত্রটি পরের বিচারে প্রাসঙ্গিক হতে পারে। কিন্তু, আগে চুরি করে দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলো বলেই পরের বার তার আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার নষ্ট হয়ে যায় না।
এভাবেই চরিত্র প্রসঙ্গ নানা ব্যবহারিক কারণে ও ঘটনায় পূর্বে বারংবার হাজির হয়েছিলো বলেই, আইনবিদগণ সাক্ষ্য আইনে এই বিধানসমূহ যুক্ত করেছেন যে, চরিত্র কখন প্রাসঙ্গিকভাবে আদালতে উত্থাপন করা যাবে, কখন যাবে না। যাইহোক, নিচের চার্টটি সংগ্রহে রাখুন বা ভালো করে বোঝার চেষ্টা করুন।
ধন্যবাদ। সব্বার প্রস্তুতির শুভকামনা রইলো।
লেখক : আইনজীবী ও ‘আইনের ধারাপাত’ সিরিজ গ্রন্থের লেখক এবং ফাউন্ডার : juicylaw.com