সৌদি আরবে নারী গৃহকর্মী না পাঠানোর দাবি উঠেছে জাতীয় সংসদে। সংসদের প্রশ্নোত্তরে অংশ নিয়ে জাতীয় পার্টির দুই জন এবং গণফোরামের একজন সংসদ সদস্য সৌদি আরবে বাংলাদেশি গৃহকর্মীদের ওপর যৌন নির্যাতনসহ অত্যাচারিত হওয়ার কথা উল্লেখ করে মঙ্গলবার (১২ নভেম্বর) নারীকর্মী না পাঠানোর দাবি তোলেন।
জবাবে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ সৌদি আরবে নারী গৃহকর্মীদের সমস্যার বিষয়টি নিয়ে সরকার চিন্তিত উল্লেখ করে তাদের প্রশিক্ষণসহ নানাবিধ সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে পাঠানোর উদ্যোগের কথা জানান। আর একেবারেই সম্ভব না হলেও তখন না পাঠানোর বিষয়টি বিবেচনা করা হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
প্রশ্নোত্তরে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য এবং সাবেক শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হব চুন্নু সৌদি আরবে বাংলাদেশি নারী গৃহকর্মীদের ওপর নির্যাতনের প্রসঙ্গটি তোলেন। প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী ইমরান আহমদের কাছে এক সম্পূরক প্রশ্ন করতে গিয়ে চুন্নু বলেন, সৌদি আরবে গৃহকর্মীদের ওপর নানা ধরনের অত্যাচার ও যৌন নির্যাতন করা হয়। এটা একটা স্বীকৃত বিষয় যে অনেক নারী কর্মী নির্যাতনের কারণে পালিয়ে যায়। তারা জেলে যাচ্ছে, বাংলাদেশে ফেরত আসছে। বহির্বিশ্বে নারী কর্মী পাঠানো নিয়ে নানা প্রশ্ন আসছে। নারী কর্মীদের যৌন নির্যাতন বন্ধ করে ইজ্জত-সম্মানের মধ্যে চাকরিসহ বেতন নিশ্চিত করার পদক্ষেপ জানতে চান।
জবাবে ইমরান আহমদ বলেন, গৃহকর্মীর বিষয়ে আপনারা যতটা চিন্তিত তার থেকে বেশি সরকার চিহ্নিত। এ ব্যাপারে অনেক পদক্ষেপ ইতোমধ্যে নেওয়া হয়েছে। কয়েকদিন আগে ঢাকাস্থ সৌদি আরব দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্সকে ডেকেছিলাম। সেখানে এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আমাদের সৌদি আরবে যে রাষ্ট্রদূত রয়েছে তাকেও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে ওই দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এগুলো তোলার জন্য। আগামী ২৬-২৭ নভেম্বর জয়েন্ট টেকনিক্যাল গ্রুপের একটি বৈঠক সৌদি আরবে অনুষ্ঠিত হবে। সেখানেও এই প্রশ্নগুলো তোলা হবে।
মন্ত্রী বলেন, নির্যাতনের যে ক্লেইম আছে—কেন নির্যাতন হয়, আমরা এখান থেকে মহিলাদের কোনও ধরনের ব্রিফিং না দিয়ে পাঠাই। কোনও প্রশিক্ষণ না দিয়ে তাদের পাঠানো হয় সেটা আমাদের দেখতে হবে। এর কারণে সিদ্ধান্ত নিয়েছি গৃহকর্মী পাঠাতে হলে ন্যূনতম একমাসের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। পাশাপাশি আইনের ব্যবস্থাসহ ওদের অধিকার ও প্রটেকশনের বিষয়ে অবহিত করার কাজ শুরু করেছি। আশা করছি, এই সমস্যার সমাধান হবে।
প্রশিক্ষণ দিয়ে নারী শ্রমিক পাঠানোর বিষয়ে মন্ত্রীর বক্তব্যের জবাব ও সম্পূরক প্রশ্ন করতে গিয়ে গণফোরামের সংসদ সদস্য সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ বলেন, নির্যাতন বন্ধে আমরা প্রশিক্ষণ দিয়ে সৌদি আরবে পাঠাবো, কিন্তু বাংলাদেশ থেকে তো তাদের নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। নিয়ন্ত্রণ তো করবে ওরা (সৌদি আরবে)। আর ওরা কীভাবে কন্ট্রোল করে সেটা আমিও জানি আপনিও জানি। কাজেই আমার অনুরোধ থাকবে সমাজকে বাঁচানোর জন্য এবং এই দেশের মান মর্যাদা ও ঐতিহ্য রক্ষার স্বার্থে মহিলা শ্রমিক না পাঠিয়ে দ্বিগুণ পুরুষ শ্রমিক পাঠানো হোক। এতে দেশের মান-ইজ্জত বাঁচবে। আমাদের পারিবারিক পরিবেশও সুন্দর থাকবে। না হলে আমাদের দাসত্বের বাংলাদেশে পরিণত হতে হবে।
জবাবে মন্ত্রী বলেন, সৌদি আরব, মালয়েশিয়া বা যেকোনও দেশেরই শ্রমবাজার বলেন, তাদের চাহিদা অনুযায়ী কর্মী পাঠাতে হয়। না হলে পাঠানোর দরকার নেই। কেউ না চাইলে তো মানুষ ঠেলে পাঠানো যাবে না। আমাদের চেষ্টা থাকবে মহিলারা যেন সম্মানজনকভাবে চাকরি করতে পারেন। আর একেবারেই যদি সম্ভব না হয় তাহলে আমরা না পাঠানোর চিন্তা করবো।
দেশের স্বার্থেই বিদেশে শ্রমিক পাঠানো হয় উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, দেশের স্বার্থেই বিদেশে শ্রমিক পাঠানো হয়। এজন্য আপনাদের বলবো বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করবেন। কোনও পরামর্শ থাকলে তা দেবেন। নারী শ্রমিকরা যাতে লাঞ্ছিত হয়ে ফিরে না আসে তার জন্য কোনও পরামর্শ থাকলে দেন। আমরা বিবেচনা করবো।
সম্পূরক প্রশ্নের জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, বলা হচ্ছে রিক্রুটিং এজেন্সি বিদেশে কর্মী পাঠায়। তাহলে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বটা কী? মা-বোনদের আমরা পাঠিয়ে দিচ্ছি। ওই খান থেকে যৌন নির্যাতনসহ নানা রকম অন্যায় অত্যাচারের শিকার হয়ে অবশেষে লাশ হয়ে ফিরে আসছেন তারা। এদের প্রত্যেকের পোস্টমর্টেমে লেখা থাকে স্বাভাবিক মৃত্যু। সকলেই একই রকম রিপোর্ট। এটা তারা (সৌদি আরব) করে। ওখানে পোস্টমর্টেম যে হয় সেটাও বাংলাদেশ দূতাবাস দেখে না। মন্ত্রণালয় কোনও পদক্ষেপ নেয় না। রিক্রুটিং এজেন্সিরা পাঠিয়েই খালাস। এভাবে আমাদের মা বোনদের নিয়ে কী ব্যবসা করতে পারি? স্বাধীন দেশ হিসেবে আমাদের সম্মান আছে, ইজ্জত আছে। মাত্র কয়েকটি টাকার জন্য আমরা দেশটাকে—আমরা তো এখন তলাবিহীন ঝুড়ি নই। কেন কয়েকটি টাকার জন্য তাদের পাঠাতে হবে? অবিলম্বে এটা বন্ধ করতে হবে।
মন্ত্রীকে উদ্দেশ করে ফিরোজ রশীদ বলেন, একেকজন মহিলা ফেরত আসে, আপনি (মন্ত্রী) দেখেন না তাদের ওপর কী অন্যায় অত্যাচার করা হয়? আমাদের ঘরে মা-বোন নেই? কেন কয়েকটি টাকার জন্য তাদের পাঠাবো? আইন সংশোধন করে মহিলাদের সৌদি আরবে পাঠানো সম্পূর্ণ বন্ধ করতে হবে। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, এ বিষয়ে আমাদের দূতাবাসও কোনও পদক্ষেপ নেয় না। মাননীয় মন্ত্রী কোনও খবর রাখেন না। পাঠিয়েছে দালালরা আর উনি (মন্ত্রী) খালাস। দালালরা নিয়ে তাদের হাতে ছেড়ে দিচ্ছেন। বেচাকেনা হচ্ছে দস্তুরমতো। আমরা কেন এটার খবর রাখি না। স্পষ্টভাবে জানতে চাই এটা অবিলম্বে বন্ধ হবে কিনা। মা-বোনদের পাঠিয়ে দেশ বিক্রির টাকা আমাদের দরকার নেই।
জবাবে মন্ত্রী ইমরান আহমদ বলেন, মন্ত্রী বা মন্ত্রণালয় কিছু করে না এটা মাঠের বক্তৃতার মতো। এই হাউজকে জানাতে চাই, যেসব নারী লাশ হয়ে, বা নির্যাতিত হয়ে আসছে-গত কয়েক মাসে ১৬০টি ট্রাভেল এজেন্সির লাইসেন্স স্থগিত করে রেখেছি। তিনটি লাইসেন্স বাতিল করেছি। দোষীদের জরিমানাও করেছি। আমরা জিরো টলারেন্সে আছি। আমরা আইন করে দিচ্ছি, যারা বিদেশ পাঠাবে সৌদি আরবে ওদের কাউন্টার পার্ট রিক্রুটিং এজেন্সির সম্পূর্ণ ডিটেইলস আমাদের দিতে হবে, যেন সৌদি আরবের বিরুদ্ধেও আমরা আইনি ব্যবস্থা নিতে পারি। আমরা যে পদক্ষেপ নিয়েছি তাতে তারা কিছুটা হলেও খুশি হবেন। ফেনী-৩ আসনের মাসুদ উদ্দিন চৌধুরীর প্রশ্নের জবাবে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ জানান, আরব আমিরাতে কর্মী পাঠানোর বিষয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। আশা করছি, খুব শিগগিরই এখানকার শ্রমবাজার নিয়ে দেশবাসীকে সুখবর দিতে পারবো।
সংরক্ষিত আসনের বেগম ওয়াসিকা আয়শা খানের প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী জানান, ১৯৯১ সাল থেকে বিদেশে নারী কর্মী পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়।
মন্ত্রীর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালের জুন থেকে এ পর্যন্ত ৭৪টি দেশে আট লাখ ৬৮ হাজার ৩৬৩ জন নারী কর্মী বিদেশে গেছেন। এর মধ্যে সৌদি আরবে তিন লাখ ৩০ হাজার ৫৯০ জন, জর্ডানে এক লাখ ৫৩ হাজার ২৯১ জন, সংযুক্ত আরব আমিরাতে এক লাখ ২৬ হাজার ১৪৩ জন, লেবাননে এক লাখ ৬ হাজার ৪৪৪ জন, ওমানে ৮৫ হাজার ৯১৪ জন, কাতারে ৩২ হাজার ২৮০ জন, মরিশাসে ১৮ হাজার ৩৩১ জন গেছেন।