শুক্রবার (১৫ নভেম্বর) ছিল ভারতের প্রধান বিচারপতি পদে নিজের কর্মজীবনের শেষ দিন। বিদায়বেলাটিকেও স্মরণীয় করে রাখতে চিরকালীন প্রথা ভাঙলেন দেশটির ৪৬তম প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ। কোনও প্রথাগত বক্তৃতা নেই, নেই বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠান। তাঁর দুই উত্তরসূরি বিচারপতি বোবদে এবং বিচারপতি এন ভি রামানাকে পাশে বসিয়েই বিদায় সম্বর্ধনা গ্রহণ করলেন বিচারপতি রঞ্জন গগৈ।
সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন আয়োজিত একটি বিদায়ী অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়েই কর্মজীবনের শেষ দিন উদযাপন করলেন। অবসর নেওয়ার আগে আরটিআই, অযোধ্যা, রাফাল, শবরীমালার মতো গুরুত্বপূর্ণ মামলার রায় দিয়েছেন রঞ্জন গগৈ।
স্থানীয় সংবাদমাধ্যম আনন্দবাজার পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হয়, তেরো মাস আগে প্রধান বিচারপতি হয়ে তিনি বলেছিলেন, গণতন্ত্রের রক্ষায় সরব বিচারপতি প্রয়োজন। শেষ দিনে তাঁর মন্তব্য, ‘‘বিচারপতিরা কথা বলেন শুধুমাত্র কাজের প্রয়োজনে। অপ্রিয় সত্য শুধু স্মৃতিতেই থাকা উচিত।’’
প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার আগে তদানীন্তন প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রর বিরুদ্ধে বেনজির সাংবাদিক বৈঠক করেছিলেন তিনি, আরও চার প্রবীণ বিচারপতিকে সঙ্গে নিয়ে। দীপক মিশ্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি মোদী সরকারের পক্ষে স্পর্শকাতর মামলা বিশেষ কয়েক জন বিচারপতির কাছেই পাঠাচ্ছেন। আইনজীবী মহলে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল, দায়িত্বে এসে তিনি পরিস্থিতি বদলাবেন।
সেই তিনি— প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈয়ের বিদায়লগ্নে আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণের মন্তব্য, ‘‘২০১৮-র জানুয়ারির সেই সাংবাদিক বৈঠক বিরাট প্রত্যাশা তৈরি করেছিল। অথচ সব রাজনৈতিক স্পর্শকাতর মামলার ফয়সালা সরকারের পক্ষেই হয়েছে। প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগ উঠেছে। ইতিবাচক প্রভাব না-রেখে তিনি বিদায় নিচ্ছেন। গোজ উইথ এ হুইম্পার।’’
আইনজীবীদের মতে, রাফাল মামলা-সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারকে মুখবন্ধ খামে নোট পেশ করতে দেওয়ার রীতিও প্রধান বিচারপতি হিসেবে গগৈ চালু করে গেলেন।
সুপ্রিম কোর্টেরই এক মহিলা কর্মী প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগ এনেছিলেন। তার তদন্তে প্রধান বিচারপতিই অন্য বিচারপতিদের নিয়ে কমিটি তৈরি করেন। সেই কমিটি প্রধান বিচারপতিকে ‘ক্লিনচিট’ দিয়ে জানায়, অভিযোগে সারবত্তা নেই। কিন্তু কেন সারবত্তা নেই, তদন্তে কী মিলেছে, তার কিছুই জানানো হয়নি।
এ বিষয়ে বিধি সেন্টার ফর লিগ্যাল পলিসির রিসার্চ ডিরেক্টর অর্ঘ্য সেনগুপ্ত বলেন, ‘‘এই মামলার যে ভাবে বিচার হয়েছে, তা দুর্ভাগ্যজনক। এতে আদালতের প্রতি মানুষের আস্থা ধাক্কা খেয়েছে। কাউকে দোষী সাব্যস্ত করতে হলে বা নির্দোষ বলতে হলে যে প্রক্রিয়া রয়েছে. সেই প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি।’’
সন্ধ্যায় সমস্ত হাইকোর্টের ৬৫০ জন বিচারপতি ও ১৫ হাজার বিচারবিভাগের কর্মীকে ভিডিয়ো-কনফারেন্সে বিদায়ী বার্তাও দিয়েছেন। জানিয়েছেন, তাঁর একটা অংশ সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে মিশে থাকবে।
প্রধান বিচারপতি পদে শেষ সপ্তাহে রাম মন্দির থেকে শবরীমালা, রাফাল তদন্ত থেকে আরটিআই-এর আওতায় প্রধান বিচারপতির দফতর নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ রায় দিয়েছেন বিচারপতি গগৈ। কিন্তু সবেতেই ‘সব দিক রক্ষা করার’ অভিযোগ উঠেছে। রামমন্দির মামলায় তিনি প্রমাণের থেকে বিশেষ সম্প্রদায়ের ধর্মীয় আস্থাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে।
অর্ঘ্য সেনগুপ্ত বলেন, ‘‘উনি যখন এসেছিলেন, তখন দু’টি প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল। এক, আদালত সরকারের পকেটে বলে মানুষের মনে যে ধারণা ঢুকে গিয়েছিল, তা তিনি কাটাতে পারবেন। দুই, উনি নিজেই বলেছিলেন, গণতন্ত্রে সরব বিচারপতিও প্রয়োজন। আশা করা হয়েছিল, এঁর কাজ নতুন পথ দেখাবে। সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকছে।’’
গৌহাটি হাইকোর্টের বিচারপতি থাকার সময় রঞ্জন গগৈয়ের সামনে প্রায়ই হাজির হতে হত মিজোরামের তৎকালীন অ্যাডভোকেট জেনারেল বিশ্বজিৎ দেবকে। তাঁর বক্তব্য, ‘‘আদালতের নির্দেশ মানায় কোনও গাফিলতি হলে তিনি মুখ্য সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব বা ডিজিকে ডেকে পাঠাতে দ্বিধা করতেন না।’’
অর্ঘ্যর পর্যবেক্ষণ, ‘‘গত ২০ বছরে বিচারবিভাগ সরকারের কাজে হস্তক্ষেপ করেছে, মানুষের আস্থা কমেছে। কিন্তু বিচারপতি গগৈ বিচারবিভাগকে গণ্ডির মধ্যে রেখেছেন, সরকারের কাজে হস্তক্ষেপ করেননি। তাঁর রায়ে সেই ধারাবাহিকতা বজায় ছিল।’’
শেষ দিনে মাত্র কিছুক্ষণের জন্য এক নম্বর এজলাসে বসেছিলেন প্রধান বিচারপতি। সঙ্গে ছিলেন ভাবী প্রধান বিচারপতি শরদ বোবদে। প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব নেওয়ার আগে রাজঘাটে গিয়ে মহাত্মা গাঁধীকে শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন গগৈ। প্রধান বিচারপতির চেয়ারে শেষ বার বসার পরেও রাজঘাটে গিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ। রাজঘাটে এসে গান্ধীজিকে স্মরণ করে রঞ্জন গগৈ লেখেন, “বাপুজীর কাছে আমি এসেছি তাঁর আশীর্বাদ প্রার্থনা করতে এবং তাঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করতে।”