মোঃ ফরিদুজ্জামান:
পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ , ১৯৮৫ এর ০৫ ধারার বিধান বাংলাদেশে সব ধর্মের নারী-পুরুষের ওপর সমানভাবে প্রযোজ্য। এই ধারায় পাঁচ প্রকারের বিরোধের বিচার করা হয়। বাংলাদেশের সব ধর্মের মানুষ পারিবারিক আদালতে বিচার চাইতে পারেন। বিচার করার সময় আদালত সংশ্লিষ্ট ধর্মের প্রচলিত বিধান অনুসারে বিচার করেন।
কোন হিন্দু পুরুষ মারা গেলে তার সম্পত্তি এবং নাবালক সন্তানদের দেখাশোনার দায়িত্ব আসে প্রথমত তার বিধবা স্ত্রীর ওপর। হিন্দু আইনে অভিভাবক তিন ধরনের। স্বাভাবিক অভিভাবক, পিতা কর্তৃক নিযুক্ত অভিভাবক এবং আদালত কর্তৃক নিযুক্ত অভিভাবক।
পিতার অবর্তমানে মা স্বাভাবিক অভিভাবক। অবৈধ সন্তানের মাও তার স্বাভাবিক অভিভাবক। মা পুনরায় বিয়ে করলেও শুধুমাত্র সেই কারণে তিনি তার নাবালক সন্তানের অভিভাবকত্ব হারান না। তবে মা তাদের স্বাভাবিক অভিভাবক হবেন না যদি পিতা জীবদ্দশায় অন্য কোনো ব্যক্তিকে উইলের মাধ্যমে নাবালকদের অভিভাবক নিয়োগ করে যান। উইলের মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত অভিভাবক মা অপেক্ষা বেশি অগ্রগণ্য হবেন। আবার ওই দুই ধরণের কোনো প্রকার অভিভাবক না থাকলে আদালত নাবালকের নিকটবর্তী আত্মীয়দের মধ্য হতে কাউকে অভিভাবক নিযুক্ত করতে পারেন। আদালত কর্তৃক কোন ব্যক্তি অভিভাবক নিযুক্ত হলে সেক্ষেত্রে নাবালক ২১ বছর পূর্ণ হলে সাবালক হয়।
স্বাভাবিক অভিভাবক আইনসঙ্গত প্রয়োজনীয় কারণে নাবালকের মঙ্গলার্থে নাবালকের সম্পত্তি হস্তান্তর করতে পারেন অথবা দায়বদ্ধ করতে পারেন। আইনসঙ্গত কারণ এবং নাবালকের সম্পত্তির মঙ্গলার্থে বলতে কি বুঝায় সে সম্পর্কে প্রিভি কাউন্সিলে উত্থাপিত হনুমান প্রসাদ বনাম মোসাম্মদ বাবুই (১৮৫৬) ৬.এম.এই.এ.৩৯৩ মামলার রায়ে বিশ্লেষন করা হয়। সেই মামলার রায়ের পর্যবেক্ষনে বলা হয় যে, যদি স্বাভাবিক অভিভাবক বা কার্যত অভিভাবক আইনসঙ্গত প্রয়োজন বা নাবালকের সম্পত্তির মঙ্গলার্থে ব্যতীত নাবালকের স্বার্থ পরিপন্থী অন্য কোন কারণে নাবালকের পক্ষে তার সম্পত্তি বিক্রয় বা অন্য কোন প্রকারে হস্তাস্তর করে তবে নাবালক যখন সাবালক হবেন তার তিন বছরের মধ্যে ঐ প্রকার হন্তান্তর রদের জন্য মামলা করতে পারে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশের পারিবারিক আদালতসমূহে হিন্দু পিতা মারা গেলে বিধবাগণ স্বামীর অনুপস্থিতিতে অভিভাবক হওয়ার জন্য আবেদন করেন। কিন্তু যেহেতু তিনি মৃত স্বামীর স্থলে স্বাভাবিক অভিভাবক, সেহেতু তার কি এরূপ দরখাস্ত করার প্রয়োজন আছে? আইনসঙ্গতভাবে মায়ের আলাদা দরখাস্ত দিয়ে নাবালকের শরীর ও সম্পত্তির অভিভাবক হওয়ার প্রয়োজন নেই। কিন্তু বাংলাদেশের পারিবারিক আদালতসমূহে এরূপ দরখাস্ত গ্রহণ করা হয়। মা বাদী হিসেবে দরখাস্ত করেন। বিবাদী করা হয় মৃত ব্যক্তির মা –বাবা, ভাই-বোনদের। প্রায় ক্ষেত্রেই এরূপ দরখাস্ত এতরফাসূত্রে নিষ্পত্তি করা হয়। কারণ বিবাদীগণ হয়তোবা এরূপ দরখাস্ত সম্পর্কে আদালতের সমন পান না অথবা পেলেও প্রয়োজন অনুভব করেন না আদালতের চৌকাঠ মাড়ানোর।
এ ধরণের দরখাস্তে বিধবা দাবী করেন স্বামীর পরিত্যক্ত সম্পত্তি নিজের জীবন পরিচালনা ও সন্তানদের লেখাপড়া ও জীবন ধারণের জন্য বিক্রয় করা অতি প্রয়োজন। কিন্তু রেজিস্ট্রি অফিসার আদালতের আদেশ ব্যতীত বিক্রিত সম্পত্তির রেজিস্ট্রি করে দিচ্ছেন না মর্মে বাদীপক্ষ আদালতে দাবী উত্থাপন করেন। সুতারং বোঝা যায় এ ধরণের দরখাস্তের একমাত্র উদ্দেশ্য সম্পত্তি হস্তান্তর। কিন্তু রেজিস্ট্রেশন আইন, ১৯০৮ এ যুগান্তকারী সংশোধনী আনার পর এখন হিন্দু নারীকে অভিভাবক হিসেবে প্রমাণ করার জন্য আদালতে আসার প্রয়োজন নেই। তারপরেও তাদের বাধ্য করা হয়। এক্ষেত্রে বলে রাখা ভাল যে, রেজিস্ট্রি অফিসারদের এ ব্যাপারে যথাযথ প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা জরুরি হয়ে পড়েছে।
অথচ নাবালকের অধিকার বিষয়ে আইনের বিধান ভিন্ন কথা বলে। অভিভাবকত্ব ও প্রতিপাল্য আইন, ১৮৯০ এর ০৬ ধারায় বলা হয়েছে যে, সংশ্লিষ্ট নাবালক যে আইনের অধীন, সে আইনে বৈধ কোন শরীর বা সম্পত্তির অথবা উভয়ের অভিভাবক নিযুক্তির কোন ক্ষমতাকে সরিয়ে নিতে বা খর্ব করতে এই আইনের কোন কিছু ব্যাখ্যা করা যাবে না। তারপরেও অনেকে নিজেদের ব্যক্তিগত আইনে স্পষ্ট বিধান থাকলেও অত্র আইনের ০৭ ধারা অনুসারে আদালতের মাধ্যমে নাবালকের শরীর ও সম্পত্তির অভিভাবক হওয়ার জন্য দরখাস্ত দাখিল করেন। কিন্তু এই ধারায় পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করা আছে কোন্ কোন্ পরিস্থিতিতে এরূপ দরখাস্ত করা যাবে। সেখানে বলা আছে যে, আদালত কোন নাবালকের কল্যাণের জন্য তার শরীর ও সম্পত্তির অথবা উভয়ের জন্য একজন অভিভাবক নিয়োগ করতে পারেন। এই ধারার বিধান স্বাভাবিক অভিভাবক না থাকলে বা থাকলেও তার অযোগ্যতা আদালতের সামনে উঠে আসলে কেবল তখনই ব্যবহার করা যাবে। একইসাথে আদালতকে সাবধান করা হয়েছে। যেমন রাশিদা বেগম বনাম সাহেরা দীন (১৯৬০), পি.এল.ডি, ১৯৪২ মামলার রায়ে বলা হয় যে, যদি আদালত মনে করেন যে, নাবালকের ব্যক্তিগত আইন আছে এবং নাবালকের শরীর এবং সম্পত্তি উভয় সম্পর্কেই অভিভাবক নিয়োগ প্রয়েজনীয় নয় সেক্ষেত্রে আদালত এই আইনের ১৭ ধারার বিধান অনুসারে অগ্রসর না হয়ে দরখাস্ত খারিজ করে দেবেন। আর যদি দরখাস্ত গ্রহণ করা হয় তবে আদালতএক্ষেত্রে আইনের ৮ ও ১০ ধারার বিধান মেনে কোন্ কোন্ ব্যক্তিকে অভিভাবক নিয়োগ দেয়া উচিৎ আর নাবালকের কোন্ কোন্ বিষয়ে অভিভাবকের দায়িত্ব দেয়া উচিৎ সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।
এরূপ দরখাস্ত করার বিধান সিভিল রুলস এন্ড অর্ডারস এর বিধি ৭৭৪(২৬) এ-ও বলা আছে। উপরের আলোচনা হতেই বোঝা যায় যে, আদালতে দেয়ার কথা দরখাস্ত। অথচ বিজ্ঞ আইনজীবীগণ দাখিল করেন নিয়মিত মোকদ্দমা। যা আইনের বিধানের বাইরে।
কেন মা স্বাভাবিক অভিভাবক হওয়া স্বত্বেও এমন দরখাস্ত দাখিল করার সিদ্ধান্ত নেন? বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে বিষয়টা পরিষ্কার হবে। সাধারনভাবে মা যদি স্বাভাবিক অভিভাবক হওয়ার পরেও নাবালকের আইনসঙ্গত প্রয়োজন বা নাবালকের সম্পত্তির মঙ্গলার্থ ব্যতীত নাবালকের স্বার্থ পরিপন্থী অন্য উদ্দেশ্যে নাবালকের পক্ষে তার সম্পত্তি বিক্রয় করেন তবে নাবালক সাবালক হওয়ার তিন বছরের মধ্যে এই প্রকার হস্তান্তর রদের জন্য মোকদ্দমা দায়ের করতে পারেন। এক্ষেত্রে মা একধরণের নিরাপত্তাহীণতা অনুভব করেন এবং ভাবেন যে, আদালতকে অবহিত না করে নাবালক সন্তানের সম্পত্তি বিক্রয় করলে তিনি ভবিষ্যতে বিপদে পড়তে পারেন। সে কারণেই হয়তো স্বাভাবিক অভিভাবক হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের পারিবারিক আদালতসমূহে মা এরূপ দরখাস্ত দাখিল করেন। কারণ আইনে বলা আছে যে, আদালত নিযুক্ত অভিভাবক নাবালকের পক্ষে কোন হস্তান্তর করতে চাইলে আদালতের আগাম অনুমতি নিতে হবে। অনুমতি দেয়ার সময় হস্তান্তরের আইনত প্রয়োজন আছে কিনা এবং প্রস্তাবিত হস্তান্তর নাবালকের হিতার্থে হবে কিনা ইত্যাদি বিষয় বিবেচনা করে আদালত অনুমতি দেন। সেকারণেই এইসব হস্তান্তর সাধারনত নাবালক সাবালক হয়েও রদ করতে পারে না। তবে আদালত হতে যদি কেউ প্রতারণামূলকভাবে অনুমতি নিয়ে থাকে, তবে সেই ক্ষেত্রে হস্তান্তর রদের মোকদ্দমা চলবে।
নাবালিকা কন্যার শরীর ও সম্পত্তির অভিভাবকত্বের বিষয় বর্তমানের আদালতসমূহে বিতর্কের বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে। হিন্দু আইনে নাবালক পুত্রের মত নাবালক কণ্যা মৃত পিতার সম্পত্তি থেকে কোন অধিকার পায় কিনা? বাংলাদেশের দায়ভাগ অনুসারী হিন্দুরা উত্তরাধিকারী নির্ণয়ে তিন প্রকারের শ্রেনী তৈরী করেছেন। যারা সপিণ্ড, সকূল্য ও সমানোদক নামে পরিচিত। তারা শর্তসাপেক্ষে মৃত ব্যক্তির সম্পত্তিতে অংশ পায়। এই তিন শ্রেনীর মধ্যে অগ্রাধিকার পান সপিণ্ডগণ। ৫৩ জন সপিন্ডের মধ্যে ০৫ জন মহিলা আছেন। এই ০৫ জনের মধ্যে কণ্যা একজন। সুতরাং নাবালক পুত্রের ন্যায় নাবালিকা কণ্যার জন্যও মাকে অভিভাবকত্ব চাইতে হবে। কিন্তু বিজ্ঞ আইনজীবীগণ তা চান না। তারা বলেন কন্যাগণ মৃত পিতার সম্পত্তিতে অধিকারী নয় যেখানে নাবালক পুত্র আছে। এটা নিঃসন্দেহে বৈষম্যমূলক সামাজিক মনস্তত্ব। আইনে এমন বিধান নেই। আইনে বলা আছে যে, কোন পুরুষ যখন সম্পত্তি পায় তা সে মহিলা অথবা পুরুষ যার নিকট হতেই পাক না কেন, সে ঐ সম্পত্তিতে সম্পূর্ণ স্বত্ব পায়। কিন্তু যখন কোন মহিলা উত্তরাধিকারী হিসেবে সম্পত্তি পায় তা পুরুষ বা মহিলা যার নিকট হতেই হোক না কেন তাতে সে জীবনস্বত্ব পায়। যদি নাবালিকা অবিবাহিতা হয়, তবে তার জীবন ধারণের খরচসহ বিয়ের খরচ আছে। সুতরাং মা অবশ্যই নাবালিকা কন্যার শরীর ও সম্পত্তির জন্য পারিবারিক আদালতে এরূপ দরখাস্ত করতে পারেন। যদিও দরকার ছিল না। কিন্তু অধিকাংশ দরখাস্তে দেখা যায় মা শুধুমাত্র নাবালক পুত্রের পক্ষে বাদী হয়ে দরখাস্ত দায়ের করেন। নাবালিকা কন্যার পক্ষে বাদী হয়ে দরখাস্ত করেন না।
এবার আসা যাক আদালতের আদেশে নাবালকের সম্পত্তি হস্তান্তরের বিষয়ের দিকে। অধিকাংশ দরখাস্ত একতরফাসূত্রে নিষ্পত্তি হওয়ায় বিচারপ্রার্থী হিন্দু সম্প্রদায় আদেশ পান তুলনামূলক কম সময়ে। যেক্ষেত্রে মা নাবালক সন্তানের শরীর ও সম্পত্তির অভিভাবকত্ব বিষয়ে আদালতের আদেশ পান, সেক্ষেত্রে আদালত আদেশে নির্দেশ দেন যে, নাবালক সাবালক না হওয়া পর্যন্ত মা তার বা তাদের শরীর ও সম্পত্তি দেখাশোনার জন্য অভিভাবক নিযুক্ত হলেন। নিযুক্ত অভিভাবককে বলা হয় দরখাস্তের তপশীলে বর্ণিত সম্পত্তির বাৎসরিক আয়-ব্যয়ের হিসাব আদালতে জমা দিতে।
তারপর যদি নাবালকদের মা তাদের কল্যাণার্থে আদেশপ্রাপ্ত সম্পত্তি বিক্রয় করতে চান তবে আদালতের অনুমতি নেয়ার জন্য আবার দরখাস্ত দিতে হয়। এই দরখাস্ত এবং দরখাস্তের সমর্থনে মায়ের জবানবন্দীসহ সংশ্লিষ্ট এলাকার জমির বর্তমান বাজারমূল্যের তালিকা চাওয়া হয়। সেই সাথে দেখা হয় এরূপ সম্পত্তি বিক্রয় নাবালকের জন্য কতটুকু আইনসঙ্গত ও প্রয়োজনীয়। আদালত স্ববিবেচনায় সিদ্ধান্ত নেন কী পরিমাণ জমি বিক্রয়ের অনুমতি দেয়া উচিৎ। এভাবে বাংলাদেশের দায়ভাগ মতের অনুসারী হিন্দু সম্প্রদায় বিধবাদের অধিকার দিয়েছেন।
সুতরাং বাংলাদেশের আইনে হিন্দু নারী ও নাবালিকা কন্যার জন্য স্পষ্ট বিধান থাকলেও তা হরহামেশা অবহেলা করা হয়। এর ফলে আদালতে অহেতুক মামলার সংখ্যা বাড়ে। বিচারপ্রার্থী মানুষের আর্থিক ও মানসিক ভোগান্তি বাড়ে। বিচারকবৃন্দের কর্মঘন্টার বেশ কিছু সময় অপচয় হয়। একারণে আইন অঙ্গনের সাথে জড়িত সংগঠনগুলোর উচিৎ বাংলাদশের সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়কে আইন জানার ক্ষেত্রে আধুনিক ধ্যান ধারণার সাথে পরিচয় করানো। বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেক উচ্চ শিক্ষিত প্রতিনিধি আছেন। তাঁরা বিভিন্ন উচ্চ পর্যায়ে নীতি নির্ধারণী ফোরাম কাজ করছেন। সম্মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া এই বিচারহীণতার সংস্কৃতি ও বৈষম্য হতে নারীদের বের করে আনা সম্ভব নয়। বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা সময়ের দাবী।
লেখক: সহকারী জজ, ঝিনাইদহ।