নিজেকে আইন পরিবারের একজন মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র। পৈতৃকসূত্রে আমিও এ পরিবারেরই একজন।
আজ শনিবার (৭ ডিসেম্বর) জাতীয় বিচার বিভাগীয় সম্মেলন-২০১৯ এ প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত এ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মাত্র সাড়ে তিন বছরে জাতিকে একটি সংবিধান দিয়েছেন। সে সংবিধানে মানুষের বিচার পাওয়ার অধিকারের কথা বলা আছে। বঙ্গবন্ধু সংবিধানে মানুষের মৌলিক অধিকার এবং আইনের কথা স্পষ্ট করে বলে গেছেন।
তিনি বলেন, ‘শান্তি ও উন্নয়নের জন্য ন্যায়বিচার’ এই প্রতিপাদ্যে আজকের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। প্রতিপাদ্যটি খুবই যুগোপযোগী। ১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর দেশে আইনের শাসন অনুপস্থিত ছিল।
দেশে আইনের শাসন নিশ্চিত করার প্রত্যয় ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সব নাগরিক যাতে আইনের আশ্রয় লাভের সুবিধা পায়-সেটা আমরা নিশ্চিত করতে চাই এবং সেটা আমরা করবো।’
তিনি বলেন, ‘আমরা সবসময় একটা জিনিস বিশ্বাস করেছি যেহেতু আমাদের সংবিধানে বলা আছে আইনের আশ্রয় লাভে সবার সমান অধিকার। আমরা তাতে বিশ্বাস করি। সবারই ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে।’
বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের আস্থা অনেক বেড়েছে মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘অনেকগুলো রায় খুব দ্রুত দেওয়ার ফলে আমি বলবো বিচার বিভাগের ওপর মানুষের আস্থা-বিশ্বাস অনেক অনেক বেড়ে গেছে। সেজন্য আপনাদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।’
বিচার বিভাগের প্রশংসা করে তিনি বলেন, ‘অনেকগুলো সাহসী পদক্ষেপ, যেমন জাতির পিতার হত্যাকারীদের বিচারের রায় দেওয়া। অনেক বাধা ছিল। সেই বাধা অতিক্রম করে এই রায় দেওয়া হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হয়েছে এবং এরকম বহু ঘটনা। সন্ত্রাসী, জঙ্গিবাদ, তারপর কিছুদিন আগে আপনারা দেখেছেন যে একটা ছাত্রীকে কীভাবে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো। সেই বিচারের রায়, নুসরাত হত্যার কথা আমি বলছি। একেকটা দৃষ্টান্ত।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘সরকারি সম্পত্তি রক্ষা, ইভটিজিং প্রতিরোধ, পাবলিক পরীক্ষায় অসদুপায় বন্ধ, যানবাহন সংক্রান্ত অপরাধ নিয়ন্ত্রণ, পরিবেশবিরোধী অপরাধ প্রতিরোধ, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও ভেজালবিরোধী অভিযান পরিচালনায় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পরিচালিত মোবাইল কোর্ট অত্যন্ত জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। সাধারণ মানুষ তাৎক্ষণিক বিচার পাওয়ার ফলে বিচারিক কার্যক্রমের প্রতি তাদের আস্থা বেড়েছে।’
প্রধানমন্ত্রী জানান, ২০০৯-২০১৮ পর্যন্ত সময়ে ১০ বছরে ৪ লাখ ১১ হাজার ৭৭৮টি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়েছে। যার মাধ্যমে ১০ লাখ ১০ হাজার ৩৩৪টি মামলা নিষ্পত্তি করা হয়েছে এবং ২৯২ কোটি টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে। ২০১৮-১৯ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত ৩২ হাজার ৮৮০ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, মূলত লঘু প্রকৃতির অপরাধ প্রতিরোধে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার ফলে বিচার বিভাগের উপর চাপ হ্রাস পায় এবং মানুষ স্বস্তিবোধ করে। মোবাইল কোর্টকে আরও কার্যকর ও ফলপ্রসূ করা সম্ভব হলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা, অপরাধ প্রতিরোধ এবং জনস্বার্থ বিশেষভাবে রক্ষিত হবে।
বিচারকদের বেতন বৃদ্ধি, আলাদা বেতন কাঠামোসহ বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি এবং বিচার বিভাগের উন্নয়ন ও আধুনিকায়নের বিভিন্ন সময় আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।
বিচার বিভাগের সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে এবং অবকাঠামোগত সঙ্কট নিরসনে আমরা ৬৪টি জেলায় আধুনিক বহুতল চিফ জুডিশিয়াল আদালত ভবন নির্মাণের উদ্যোগ; ২৮টি জেলায় আনুষঙ্গিক সুবিধাসহ জেলা জজ আদালত ভবনের ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ’ শীর্ষক প্রকল্প গ্রহণ; সম্প্রতি সরকার অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ পদমর্যাদার বিচারকদের জন্য ১২৮টি গাড়ি ক্রয়ের অনুমোদন; বিচারকদের আবাসন ও গাড়ি সুবিধাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাদির কথা উল্লেখ করেন শেখ হাসিনা।
বিচারকদের জন্য গাড়ি ঋণ নগদায়নের বিষয়টি সরকারের সক্রিয় বিবেচনাধীন রয়েছে বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী।
মামলা ব্যবস্থাপনায় আরও গতিশীলতা আনার লক্ষ্যে ই-জুডিশিয়ারি কার্যক্রমের মাধ্যমে দেশের সব আদালতকে আইসিটি নেটওয়ার্কের আওতায় আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ই-জুডিশিয়ারি চালু করা গেলে মামলা জট কমবে।
জনসাধারণকে জাতীয় হেল্প লাইন ১৬৪৩০ নম্বরে টোল ফ্রি কলের মাধ্যমে বিনামূল্যে আইনি পরামর্শ দেওয়ার কথা উল্লেখ করেন তিনি।
বিচার বিভাগে মহিলা বিচারপতি নিয়োগের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘পাকিস্তান আমলে একটি আইন ছিল, সেটা হলো কোনো মহিলা বিচারপতি হতে পারবে না। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু নারীদের বিচারপতি করার সুযোগ করে দিয়েছেন। এরই ধারাবাহিকতায় রাষ্ট্রপতি প্রথমে একজন নারী বিচারপতি নিয়োগ দিয়েছিলেন। প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে নারী পুরুষের সমান অধিকার থাকতে হবে। তাছাড়া সমাজ এগোতে পারবে না।’
সম্মেলনে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আনিসুল হক ও সচিব গোলাম সরোয়ার। স্বাগত বক্তব্য রাখেন রেজিস্ট্রার জেনারেল মোহাম্মদ আলী আকবর।
সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ও হাইকোর্টের বিচারপতি এবং সারাদেশ থেকে আগত বিচারকগণ এ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।
দিনব্যাপী এই সম্মেলনে বিচার সংক্রান্ত কাজ ডিজিটালকরণ, কার্যকর আদালত প্রশাসন পরিচালনাসহ বিভিন্ন প্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হবে। সুপ্রিম কোর্টের আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগ এবং সারাদেশের নিম্ন আদালতের বিচারকগণ সম্মেলনে অংশ নেন।