সিরাজ প্রামাণিক: বিয়ে মানুষের জীবনের সবচেয়ে সুখকর অনুভূতি ও প্রজন্ম বিস্তারের একমাত্র উপায় হলেও কখনও কখনও তা অভিশাপ রূপে দেখা দেয়। মুসলিম আইনে বিয়ে হচ্ছে ধর্ম কর্তৃক অনুমোদিত একটি দেওয়ানী চুক্তি। বিভিন্ন ধর্মে বিয়ের বিভিন্ন রীতি প্রচলিত। বিয়ে মূলত একটি ধর্মীয় রীতি হলেও আধুনিক সভ্যতায় এটি একটি আইনী প্রথাও বটে। বিবাহবহির্ভুত যৌনসঙ্গম অবৈধ বলে স্বীকৃত এবং ব্যাভিচার হিসাবে অভিহিত একটি পাপ ও অপরাধ।
পাঠক এবার আসল কথায় আসি। রহিম ও রুনা (ছদ্মনাম) একে অপরকে গভীরভাবে ভালবাসে। ভালবাসাকে বাস্তবে রুপ দিতে ওরা পরিবারের অমতে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। প্রেমের টানে রহিমের হাত ধরে ঘর ছাড়ে রুনা। উভয়ের গন্তব্য ঢাকা। ওদের ধারনা কোর্টে উকিলের মাধ্যমে বিয়ে করতে হয়। সুযোগ সন্ধানী এক শ্রেনীর উকিলও এ কাজে সহায়তা করে থাকে। আদালতের নোটারী পাবলিকের কার্যালয়ে গিয়ে ওরা ‘কোর্ট ম্যারেজ’ করে। কিন্তু তখন তারা বিয়ের কাবিন রেজিষ্ট্রি করেনি। বিয়ের কিছুদিন যেতে না যেতেই ওদের দাম্পত্য জীবনে কলহ শুরু হয়। রহিম রুনার সঙ্গে তার বিয়ের কথা পুরোপুরি অস্বীকার করেন। আর এ অজুহাতে রুনাকে মোহরানা, খোরপোষ ও দাম্পত্য অধিকার দিতেও তিনি রাজি নন। অবশেষে বিষয়টি গড়ায় আদালতে। বিয়েটা প্রমাণ করতে রীতিরকম হিমশিম খেতে হয় রুনাকে।
১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইনের বিধান অনুযায়ী প্রতিটি মুসলিম বিবাহ রেজিস্ট্র্রি করা বাধ্যতামূলক। বিবাহ রেজিস্ট্র্রি না করলে স্বামীর সম্পত্তির উত্তরাধিকার, মৃতের সন্তানদের উত্তরাধিকার, খোরপোষ ও মোহরানার অধিকার থেকে ওই নারীকে বঞ্চিত হতে হয়। এছাড়া স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করলে বা প্রথম স্ত্রীর বিনা অনুমতিতে বিয়ে করার উদ্যোগ নিলে স্ত্রী আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারেন বিয়ে যদি রেজিস্ট্রি করা হয়। সুতরাং বিয়ে রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে একজন নারী তার দাম্পত্য জীবনের অনেক জটিলতা থেকে পরিত্রাণ পেতে পারেন এবং অসহায়ত্ব থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারেন।
১৯৭৪ সালের মুসলিম বিবাহ ও তালাক (রেজিস্ট্রেশন) আইনে (সংশোধিত ৮ই মার্চ, ২০০৫) বলা হয়েছে যে, যদি কেউ বিবাহ রেজিস্ট্রি না করেন তাহলে তিনি এ আইনের অধীনে অপরাধ করেছেন বলে বিবেচিত হবেন এবং এ অপরাধের জন্য আইন কর্তৃক নির্ধারিত শাস্তি হচ্ছে দুই বছর বিনাশ্রম কারাদন্ড অথবা আর্থিক জরিমানা যা তিন হাজার টাকা পর্যন্ত হতে পারে অথবা উভয় ধরনের শাস্তিই হতে পারে।
কাবিন রেজিস্ট্র্রির পরিবর্তে কোর্ট ম্যারেজ অধিকতর শক্তিশালী এ ভুল ধারণার ফাঁদে পড়ে অনেক নারী তাদের দাম্পত্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। অথচ বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে ‘কোর্ট ম্যারেজের কোন বৈধতা নেই, এমনকি এর কোন অস্তিত্বও নেই। ২০০ টাকার টাকার নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে নোটারি পাবলিকের কার্যালয়ে কিংবা জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের কার্যালয়ে গিয়ে হলফনামা করাকে বিয়ে বলে অভিহিত করা হয়। অথচ এ্যাফিডেভিট বা হলফনামা শুধুই একটি ঘোষণাপত্র। আইনানুযায়ী কাবিন রেজিস্ট্র্রি সম্পন্ন করেই কেবল ঘোষণার জন্য এ্যাফিডেভিট করা যাবে।
বিশেষ কয়েক শ্রেণীর নারী-পুরুষের মধ্যে এরকম বিয়ের প্রবণতা বেশী দেখা যায়। তন্মধ্যে গার্মেন্টস শ্রমিক, যৌন কর্মী এবং বিশেষ প্রেম-ঘটিত তরুণ-তরুণী। আবেগঘন সিদ্ধান্ত নিয়ে অনেক তরুণ-তরুণীর ভুল ধারণা হয় যে, শুধুমাত্র এ্যাফিডেভিট করে বিয়ে করলে বন্ধন শক্ত হয়। কাজী অফিসে বিয়ের জন্য বিরাট অঙ্কের ফিস দিতে হয় বলে কোর্ট ম্যারেজকে অধিকতর ভাল মনে করে নিম্নবিত্ত শ্রেণীর নারী-পুরুষেরা। অন্যদিকে যৌনকর্মীরা অনেক সময় ঠিকানা বদল করে স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে অবস্থানের সুবিধার কথা বিবেচনা করে কোর্ট ম্যারেজে উৎসাহ হয় অধিক। অনেকে এ্যাফিডেভিটের মাধ্যমে বিয়ে সম্পাদন করে একাধিক বিয়ের কথা গোপন করার জন্য। কোন মেয়ের অভিভাবককে জিম্মি করে টাকা আদায় কিংবা সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন করার জন্যও অনেক সময় এ্যাফিডেভিটের মাধ্যমে ভূয়া বিয়ের দলিল তৈরী করা হয়। এ দলিল তৈরী করা খুব সহজেই সম্ভব এবং এসব ক্ষেত্রে হলফনামা প্রার্থীকে নোটারি পাবলিকের কাছে হাজির হতে হয় না। এর ফলে ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়েদের ক্ষেত্রে বয়স বাড়িয়ে দেয়ার সুযোগ থাকে। এছাড়া নারী ও শিশু নির্যাতন মামলা থেকে রক্ষার জন্য আসামী পক্ষের এরকম হলফনামা তৈরীর প্রবণতা দেখা যায়।
মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার এক কেস স্টাডিতে দেখা যায়, সনাতন ধর্মে বিশ্বাসী সাথী ও বিদ্যুৎ (ছদ্মনাম) এফিডেভিটের মাধ্যমে বিয়ে সম্পাদন করে। তাদের সংসারে একটি কন্যা সন্তানও রয়েছে। কিন্তু ঘটনা পরষ্পর তাদের দাম্পত্য জীবন বেশী দূর এগোয়নি। পরে তারা স্বেচ্ছায় বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটাতে নোটারি পাবলিকের কার্যালয়ে একটি হলফনামা সম্পাদন করেন। হলফনামাটি একটি সাব-রেজিস্ট্র্রি অফিসে রেজিস্ট্র্রি করে। কিন্তু বিবাহ বিচ্ছেদের এ ধরণের দলিল রেজিস্ট্র্রি করা ও এ্যাফিডেভিট করা সম্পূর্ণ বে-আইনী। হিন্দু আইনে বিবাহ বিচ্ছেদ বলে কিছু নেই। সঙ্গত কারণে বিবাহ বিচ্ছেদ চাইতে হবে পারিবারিক আদালতে। খ্রিষ্টান আইনেও বিবাহ একটি চুক্তি, যা ভঙ্গ করা যায় না। ১৮৬৯-এর বিবাহ বিচ্ছেদ আইন অনুযায়ী খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীরা বিয়ে বিচ্ছেদের জন্য আদালতে যেতে পারেন।
বিয়ে রেজিষ্ট্রেশন হচ্ছে সরকারের নির্ধারিত ফরমে লিখিত বর ও কনের বিয়ে সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় তথ্যাবলী সম্বন্ধে আইনগত দলিল যা কাজী অফিসে সংরক্ষিত থাকে। সরকার কাজীদের বিয়ে রেজিষ্ট্রি করার জন্য অনুমতি বা লাইসেন্স দিয়ে থাকেন। আইনানুযায়ী বিয়ের আসরেই বিয়ে রেজিস্ট্র্রি করতে হয়। বিয়ের আসরে সম্ভব না হলে বিয়ে অনুষ্ঠানের দিন থেকে ১৫ দিনের মধ্যে কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ে রেজিস্ট্র্রি করতে হয়। কাজীকে বাড়িতে ডেকে এনে অথবা কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ে রেজিস্ট্র্রি করা যায়। এছাড়াও কাবিননামার সকল কলাম পূরণ করার পর বর, কনে, উকিল, সাক্ষী ও অন্যন্যা ব্যক্তিগণের স্বাক্ষর দিতে হয়।
ইসলাম ধর্মে বিবাহ নিবন্ধন আইন থাকলেও হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ক্ষেত্রে বিবাহ নিবন্ধন আইন ছিল না। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বিবাহ নিবন্ধনের বিধান ঐচ্ছিক রেখে হিন্দু বিবাহ নিবন্ধন আইন তৈরী হওয়ায় এখানেও অনেক জটিলতা দেখা দিয়েছে। বর্তমানে বিদেশ ভ্রমণ, অভিবাসন, চাকুরী বদলী ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিবাহ সম্পর্কিত দালিলিক প্রমাণ একটি অপরিহার্য বিষয়। প্রতারণার সুযোগ বন্ধ করা এবং হিন্দু নারীদের সামাজিক ও আইনী সুরক্ষা সৃষ্টির লক্ষ্যে হিন্দু বিবাহ আইন ঐচ্ছিক না রেখে বাধ্যতামূলক করা সমীচীন।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। Email: seraj.pramanik@gmail.com