মনজিলা সুলতানা ঝুমা: সাম্যের কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত চরণ দিয়ে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই “বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর” আরেকটি বিখ্যাত উক্তি “আজকের শিশুরাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ”। নেলসন ম্যান্ডেলা,বলেছিলেন “সমাজ কীভাবে শিশুদের প্রতি আচরণ করে তার মধ্য দিয়ে সমাজের চেহারা ফুটে ওঠে” ঠিক তাই, একটি জাতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হচ্ছে শিশুরা। সুস্থ-সুন্দর পরিবেশে বিকাশ লাভের সুযোগ পেলে, প্রত্যেকটি শিশু ভবিষতে দেশের এক একজন আদর্শ, কর্মক্ষম, সুযোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠবেন। অপরদিকে কোন রাষ্ট্র তার কাঙ্খিত লক্ষ্যে ও কল্যাণ রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারবে না , যতক্ষণ পর্যন্ত সেই রাষ্ট্রে নারীরা পিছিয়ে থাকবে।
বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার এক বিশাল অংশ নারী ও শিশু। এই বিশাল সংখ্যক নারী ও শিশু দেশের গুরুত্বপূর্ণ মানব সম্পদ এবং নারী ও শিশুর উপরই অনেকাংশে দেশের ভবিষ্যৎ নির্ভরশীল। এই নারী ও শিশুরাই সমাজে নানাভাবে সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হয়। এসব নির্যাতনের খবর বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম ও সামাজিক সংস্থার পরিসংখ্যানে যা উঠে আসে তা খুবই কম সংখ্যক। কারণ অধিকাংশ ঘটনাই ভিকটিম নিজে সহ্য করে নেয়। ফলে অপ্রকাশিত থেকে যায়। যে চিত্র উঠে আসে তাও ভয়াবহ।
নারীর ও শিশুর প্রতি সহিংসতার দুই-তৃতীয়াংশই হয় পারিবারিকভাবে। একজন নারী পারিবারিকভাবে মারাত্মক শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হন। অন্যদিকে, শিশুদের প্রতিও পারিবারিকভাবে সহিংসতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমান যুগে শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি অভিভাবকদের আসক্তিও শিশুর প্রতি মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। অনেক সময় অভিভাবকরা সন্তানের উপর অধিকার চর্চা করতে গিয়ে নিজের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়ে সন্তানকে মানসিক নির্যাতন করে থাকেন। স্বামী-স্ত্রীর বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটলেও অনেক সময় সৎ মা অথবা সৎ বাবা কর্তৃক শিশু নির্যাতনের শিকার হয়। কোনো শিশু প্রতিবন্ধী হলে দেখা যায়, সমাজের লোকজনের পাশাপাশি পরিবারের সদস্যদের দ্বারা অবহেলার শিকার হয় যা তাকে মানসিকভাবে চরম হতাশাগ্রস্ত করে।
নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতার বিষয়টি অনেক আগে থেকেই আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আলোচিত হয়ে আসছে। যার ফলে জাতিসংঘ ১৯৭৯ সালে নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপ সনদ এবং ১৯৮৯ সালে শিশু অধিকার সনদ ঘোষণা করেন। বাংলাদেশ এই দুইটি সনদে স্বাক্ষরকারী দেশ। অপরদিকে, স্বাধীনতার পর আমাদের দেশের সংবিধানে নারী ও শিশুদের সম-অধিকার নিশ্চিত করার অঙ্গীকার প্রদান করা হয়। অনেক দেরিতে হলেও এই ২টি আন্তর্জাতিক আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে ও সাংবিধানিক অঙ্গীকার রক্ষায় সরকার ২০১০ সালে পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইনটি প্রণয়ন করেন। এই আইনটি সম্পর্কে এখনও অধিকাংশ মানুষ জানে না। সুতরাং আইনটির ব্যাপকহারে ব্যবহার লক্ষ্য করা যায় না।
এবার আইনটি সম্পর্কে একটি সামগ্রিক ধারণা নেওয়া যাক। এই আইনের ৩ ধারা অনুযায়ী পারিবারিক সহিংসতা বলতে নারী বা শিশুর উপর চার(৪) ধরণের নির্যাতনকে বুঝানো হয়েছে। প্রথমে-শারীরিক নির্যাতন সম্পর্কে বলা হয়েছে। শারীরিক নির্যাতন হচ্ছে এমন কোন কাজ বা আচরণ যার মাধ্যমে নারী বা শিশুর জীবন, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা বা শরীরের ক্ষতি হয় বা সম্ভবনা থাকে। দ্বিতীয়টি হচ্ছে-মানসিক নির্যাতন। মানসিক নির্যাতন হচ্ছে মৌখিক নির্যাতন , অপমান, অবজ্ঞা , ভীতি প্রদর্শন , ব্যক্তি স্বাধীনতায় বাঁধা । তৃতীয়টি হচ্ছে-যৌন নির্যাতন। যৌন নির্যাতন হচ্ছে যৌন প্রকৃতির এমন আচরণ যার দ্বারা নারী ও শিশুর সম্ভ্রম, সম্মান বা সুনামের ক্ষতি হয়। চতুর্থটি হচ্ছে-আর্থিক ক্ষতি। আর্থিক ক্ষতি বলতে বুঝানো হয়েছে সম্পদ বা সম্পত্তি লাভের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা বা নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্র প্রদান না করা।
এই আইনের ১১ ধারা ও পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ ও সুরক্ষা বিধিমালা ২০১৩ এর ৮ বিধি অনুযায়ী সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি বা তাদের পক্ষে কোন প্রয়োগকারী কর্মকর্তা, সেবা প্রদানকারী বা অন্য কোন ব্যক্তি বিধিতে উল্লেখিত ‘চ’ নং ফর্ম পূরণপূর্বক একজন আইনজীবীর মাধ্যমে প্রতিকারের জন্যে আদালতে আবেদন করতে পারেন। এই আইনের ১২ ধারা অনুযায়ী যে স্থানে আবেদনকারী বা প্রতিপক্ষ বসবাস করেন বা পারিবারিক সহিংসতা সংঘটিত হয়েছে বা সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি যেখানে অস্থায়ীভাবে বসবাস করেন , যেকোন একটিতে দায়ের করা যাবে। এই আইনের ২০ ধারা অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ আদেশের আবেদন ব্যতীত, প্রতিটি আবেদন নোটিশ জারীর তারিখ হতে অনধিক ৬০ (ষাট) কার্যদিবসের মধ্যে আদালত নিষ্পত্তি করবেন।
এই আইনের ২১ ধারা অনুযায়ী দাখিলকৃত আবেদন বা কার্যধারার নিষ্পত্তি করবেন জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (জেলার ক্ষেত্রে) বা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (মেট্রোপলিটন এলাকার ক্ষেত্রে)। ২৮ ধারা অনুযায়ী এই আইনের অধীন প্রদত্ত আদেশের বিরুদ্ধে যে কোন সংক্ষুব্ধ পক্ষ আদেশ প্রদানের তারিখ হতে ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বা ক্ষেত্রমত, চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আপীল করতে পারবেন। ২৯ ধারা অনুযায়ী এই আইনের অধীন সংঘটিত কোন অপরাধ আমলযোগ্য, জামিনযোগ্য এবং আপোষযোগ্য হবে।
আইনটি প্রতিরোধমূলক এবং এই আইনে শাস্তির বদলে প্রতিকারের কথা বলা হয়েছে,তারপরও এই আইনের প্রয়োগ খুব একটা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। আইন প্রয়োগের জন্য সর্বাগ্রে যেটা প্রয়োজন তা হলো উক্ত আইন সম্পর্কে সর্বস্তরের জনগণের সচেতনতা। নিজেদের অধিকার সম্পর্কে অনেকেই সচেতন না বলেই বার বার তাদের সাথে একই অপরাধ ঘটে যায়। যেকোনো বয়সের নারী এবং যার আঠারো বছর পূর্ণ হয়নি এরকম কোনো ব্যক্তি এই আইনের অধীনে কী সুরক্ষা পাবেন। রক্তের সম্পর্ক বা বৈবাহিক সম্পর্ক অথবা যৌথ পরিবারের সদস্যের বিরুদ্ধে এই আইন প্রযোজ্য। অর্থাৎ রক্তের সম্পর্ক, বৈবাহিক সম্পর্ক অথবা যৌথ পরিবারে একসঙ্গে থাকা হয় এরকম কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে পারিবারিক সহিংসতার প্রতিকার চেয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। এক্ষেত্রে ভিকটিমকে সার্বিক সহায়তার জন্য রয়েছে উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা এবং তালিকাভুক্ত এনজিওসহ সংশ্লিষ্ট থানার পুলিশ কর্মকর্তা যারা মামলা দায়েরের পূর্বেই ভিকটিমকে এককভাবে অথবা যৌথভাবে সার্বিক সহায়তা করতে পারবেন। পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন তাদের এই ক্ষমতা অর্পণ করেছে।
নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা রোধে পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন বিষয়ে ব্যাপক জনসচেতনতা জরুরি। প্রয়োজন এই আইনের ব্যাপক প্রয়োগ।এই আইনটি যথাযথ প্রয়োগ ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে নারী ও শিশুর উপর পারিবারিক সহিংসতা কমিয়ে নিয়ে আসা যেতে পারে। এই বিষয়ে সরকারি সংশ্লিষ্ট সংস্থার পাশাপাশি বেসরকারি পর্যায়ে যারা নারী ও শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করে থাকেন তারাও বিস্তৃত হারে জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম চালাতে পারেন। তাহলে যাদের দ্বারা এই আইন লঙ্ঘনের সম্ভাবনা রয়েছে অর্থাৎ সম্ভাব্য অপরাধীরাও হয়তো সচেতন হবে। তবে ব্যাপকহারে বাস্তবায়ন শুরু হলে পারিবারিক সহিংসতার নতুন নতুন ধরন চিহ্নিত হবে এবং প্রচলিত আইনে প্রতিকার না থাকলে চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে আইনকে যুগোপযোগী করা যাবে।
অপরদিকে এই আইনটির মাধ্যমে ভিক্টিমেক সুরক্ষা প্রদান , ক্ষতিপূরণ প্রদান করে স্বাভাবিক জীবন-যাপনে ফিরিয়ে নিয়ে আসা যেতে পারে। যাতে আমাদের দেশে নারী ও শিশুর উপর পারিবারিক সহিংসতার হাত থেকে রক্ষা পায়। নারী ও শিশুরা সুরক্ষিত থাকে এবং একটি আধুনিক ও কল্যাণ রাষ্ট্র গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
লেখক- আইনজীবী, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ঢাকা ও খাগড়াছড়ি।