রাম চন্দ্র দাশ :
দীর্ঘমেয়াদী অসুস্থতা ও জীবাণুর সাথে বসবাসের কিছু কৌশল মানুষ আদিকাল থেকে অবলম্বন করে আসছে; যা চিকিৎসা বিজ্ঞানও গ্রহন করে নিয়েছে এবং এটিকে আরো বিস্তৃত জ্ঞানে পরিণত করেছে। যেমন আমরা শুনি থাকি “লিভিং উইথ কেন্সার”- যা নিয়ে রীতিমত হাজার হাজার পৃষ্ঠা লিখা হয়েছে। এর মূল বিষয় হলে কারো কেন্সার হয়ে হয়ে গেলে রোগী ও তার পরিবার এবং আত্মীয়-স্বজন কিভাবে (জীবনাচরণ, পথ্য, বিনোদন, মানবিক যোগাযোগ ইত্যাদি) এটাকে মোকাবেলা করবেন। করোনা এরকম একটি দীর্ঘমেয়াদী চ্যালেঞ্জ হিসাবে আমাদের সামনে আজ আবিভর্‚ত হয়েছে; তাই পরিবার থেকে প্রতিষ্ঠান প্রতিটি ক্ষেত্রকে আলাদা বিবেচানা করে এর জন্য সঠিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে পারলে ’করোনার সাথে বসবাসকে’ জীবন ও জীবিকাকে যথাসম্ভব নিরাপদ রাখা যাবে।
আদালত আঙ্গিনা হল এটি পাবলিক প্লেস (এখানে বিভিন্ন ধরনের মানুষের নিয়মিত যাতায়ত), কাজেই করোনার মত একটি অতি-সংক্রামণ রোগের ক্ষেত্রে এই আঙ্গিনাসংশ্লিষ্টদের জীবন ও জীবিকার জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। আমরা যারা পেশাগত কাজে নিয়মিত আদালতে যেতে হবে তারা স্বাভাবিকভাবেই এজন্য চিন্তিত আছি। তাই আদালত আঙ্গিনাকে নিরাপদ রাখার জন্য নীতিনির্ধারক, বিজ্ঞ বিচারক, বিজ্ঞ আইনজীবীসহ অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সকলের জন্য আমার এই ক্ষদ্র ভাবনা ও নিবেদন।
প্রথমত, প্রতিটি আদালতের জন্য করোনা প্রতিরোধ টাস্কফোর্স গঠন : প্রতিটি আদালত আঙ্গিনাকে আলাদা হিসাবে বিবেচনা করতে হবে, কারণ প্রতিটি আদালতের অবয়ব, অবকাঠামো ও পরিবেশ আলাদা। তাই প্রতিটি আদালতের জন্য আলাদা পরিকল্পনা প্রয়োজন; আইনজীবী সমিতি, আইনজীবী-সহকারী সমিতি, আদালতের বিজ্ঞ বিচারক ও কর্মচারী প্রতিনিধি নিয়ে একটি করোনা প্রতিরোধ টাস্ক-ফোর্স গঠন করা যেতে পারে। যারা প্রতিটি আঙ্গিনার জন্য পরিকল্পনা প্রণয়ন, বাস্তবায়ন ও মনিটরিং করবেন। ফলে একটি বাজেট করা প্রয়োজন হবে। উল্লেখ্য যে, যারা একাজে অনেক সময় ও শ্রম দিবেন তাদের জন্য উপযুক্ত সম্মানীর ব্যাবস্থা করা যেতে পারে।
দ্বিতীয়ত, জীবানুমুক্ত করা ও শারিরীক দূরত্ব বজায় রাখা : করোনা প্রতিরোধে এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও চ্যালেঞ্জিংকাজ। আঙ্গিনার প্রতিটি কক্ষ, এজলাস, সেরেস্তা, বিচারকের কক্ষ, সমিতিভবন, চেম্বার, পাঠাগার, রেস্তুরা, রাস্তা, দোকান, ওয়াশরুম, বারান্দাকে প্রতিদিন জীবানুম্ক্তু করা ও ৩-ফুট দূরত্ব বজায় রাখার সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করতে হবে এবং তা দৈনন্দিন মনিটরিং এর ব্যাবস্থা করতে হবে। মনিটরিং এর জন্য আনসার সদস্যদের প্রশিক্ষিত করে কাজে লাগানো যেতে পারে।
তৃতীয়ত, আদালত গেটে নজরদারির ব্যাবস্থা : আদালতের গেটে (দূর থেকে বিশেষ যন্ত্রের সাহায্যে) জ্বর মাপার ব্যাবস্থা করতে হবে। সুনির্দিষ্ট প্রয়োজন ছাড়া কাউকে আঙ্গিনায় প্রবেশ নিরুৎসাহিত করা যেতে পারে। যারা প্রবেশ করবেন তাদের মাস্ক ব্যাবহার আবশ্যকীয় করতে হবে।
চতুর্থত, বয়স্কদের ব্যাপারে আলাদা সতর্কতা : আমরা জানি বয়স্করা এরোগের ক্ষেত্রে বেশি বিপদাপন্ন। বয়স্কদের আদালতে যাতায়াত নিরুৎসাহিত করা যেতে পারে; যাদের প্রয়োজন বেশি তাদের সুরক্ষার ব্যাপারে আলাদা সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন হবে।
পঞ্চমত, হাতধোয়ার সুব্যাবস্থা : বিদ্যমান ওয়াশরুমগুলোতে হাতধোয়া ব্যাবস্থাকে আরো শক্তিশালী করা। এছাড়া আদালতের গেটসহ কিছু পয়েন্টে হাতধোয়ার জন্য কিছু বেসিন (সম্ভব না হলে হ্যান্ড-সেনিটাইজার) ও সাবানের ব্যাবস্থা করা নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ।
ষষ্ঠত, ঢাকনাযুক্ত ডাস্টবিনের ব্যবস্থা করা : আঙ্গিনায় অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট নির্ধারণ করে সবগুলো পয়েন্টে ঢাকনাযুক্ত সহজে ব্যবহারযোগ্য ডাস্টবিনের সেট করতে হবে এবং এগুলোর ব্যাবহারে প্রযোজনীয় ব্যাবস্থা গ্রহন করতে হবে।
সপ্তমত, করোনা প্রতিরোধক আচরণবিধি তৈরি ও শিক্ষা : হাঁচি-কাশি শিষ্ঠাচার (রোমাল/টিস্যু ব্যবহার বা কনুই এর ব্যাবহার, সর্দি-কাশি অবশ্যই ডাস্টবিনে ফেলা ইত্যাদি) শারিরীক দূরত্ব কমপক্ষে ৩ ফুট বজায় রাখা, ২০-সেকেন্ডব্যাপী সঠিকভাবে হাতধোয়ার নিয়মকানুন সম্বলিত একটি আচারণবিধি তৈরি করা ও তার জন্য প্রচারপত্র, বিলবোর্ড ও কাউন্সিলিং এর ব্যাবস্থা করা এবং প্রথমদিকে কয়েকদিন শেখার সুযোগ রাখা এবং সঠিক মনিটরিং করা।
অষ্টমত, এজলাসে ভিড় কমানো : এটি সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং কাজ। এর জন্য কজলিস্ট অনুযায়ী আগেই সময় নির্ধারণ করে দেওয়া; পরের দিনের তালিকা আগের দিন বিকালে জানিয়ে দেওয়া। যেমন, ক্রমিক ১-১০ পর্যন্ত মামলাগুলো ১০:৩০- ১১:৩০ পর্যন্ত সময়ে, ক্রমিক ১১-২০ পর্যন্ত ১১:৩০- ১২:৩০ ঘটিকায় ইত্যাদি। ফলে সংশ্লিষ্ট মামলার আইনজীবী, সহকারী ও মক্কেল যথা সময়ে কক্ষে যেতে পারবেন এবং এটি আদালতের একজন কর্মচারী দ্বারা নিয়ন্ত্রণের ব্যাবস্থা করা যেতে পারে।
নবমত, কজলিস্টে একদিনে কম মামলা রেখে বেশি কাজ সম্পাদনের ব্যাবস্থা : একদিনে বেশি মামলার তারিখ না দিয়ে কম মামলা তালিকায় রাখা; তবে উক্ত মামলাগুলোর যথাসম্বব বেশি কাজ করে মামলার কাজ এগিয়ে নেওয়া। যেমন,নির্দিষ্ট তারিখে একটি মামলার বেশি সাক্ষী একদিনে নিয়ে নেওয়া।
দশমত, মক্কেল ও আসামীর উপস্থিতি জরুরী প্রয়োজন ছাড়া নিরুৎসাহিত করা : এটি একটি কৌশলগত এবং আইনগত বিষয়ও বটে। বেঞ্চ ও বার মিলে এর নীতি ও কৌশল নির্ধারণ করা যেতে পারে, কোন আসামীকে ব্যাক্তিগত হাজিরা থেকে অব্যাহতি দেওয়া, জেল থেকে আসামীকে প্রতি তারিখে না আনা ইত্যাদি। আইনজীবীর চেম্বারে জরুরী প্রয়োজন ছাড়া সাক্ষাৎ নিরুৎসাহিত করা; ফোনে-অনলাইনে প্রয়োজনীয় কিছু কাজ সেরে ফেলা ইত্যাদি। এসব ক্ষেত্রে ফিস আদান-প্রদানে প্রযু্িক্তগত সুবিধা কাজে লাগানো যেতে পারে।
প্রতিটি সমস্যারই বেশকিছু যথোপযুক্ত সমাধান আছে,করোনা তার ব্যতিক্রম নয়। করোনা ঝুঁকি মোকাবেলার জন্যও আমাদের উপযোগী সমাধান খুঁজে বের করতে হবে; ইতোমধ্যে কিছু বেরও হয়েছে। এজন্য প্রয়োজন অব্যাহত ভাবনা, গুরুত্বারোপ, পরিকল্পনা প্রণয়ন ও এর সঠিক বাস্তবায়ন। সঠিক বাস্তবায়ন করতে প্রয়োজন নিয়মতান্ত্রিক মনিটরিং এবং কাজ করতে গিয়ে শেখার মনোভাব। এর ফলে নতুন চিন্তার সংযোজন হবে; বের হবে নতুন পথ এবং করোনা প্রতিরোধে আমরা সফল হবো এই প্রত্যাশা রইলো। সবাই সুস্থ থাকুন।আবার দেখা হবে আদালতের আঙ্গিনায়; মানুষের ন্যায় বিচার নিশ্চিত করার প্রচেষ্টায়।
লেখক- অ্যাডভোকেট, ঢাকা আইনজীবী সমিতি।
Email: ram.chandra.das@gmail.com