আনোয়ার হোসেন সাগর:
একটি ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই শুরু হয়ে গেল আরেকটি ঘটনা। “মোবাইল কোর্টের সাজা এবার জেলা জজ আদালতে” বা এই জাতীয় অন্য কোন শিরোনামে গত কয়েক দিন যাবৎ বেশ কয়েকটি অনলাইন পত্রিকা সহ বিভিন্ন ধরনের মিডিয়া মাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে। বিভিন্ন ঘটনার মাধ্যমে মোবাইল কোর্ট বা এর পরিচালনাকারী হিসেবে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নামের নির্বাহী কর্মকর্তাগণ যেন থামছেনই না, কোন কোনভাবেই বিতর্কিত হচ্ছেনই। বিগত ০৪ মে, ২০২০ ইং তারিখে কুড়িগ্রাম জেলা ও দায়রা জজ আদালতের ক্যাশিয়ার জনাব মোঃ আনসার আলী ও অফিস সহায়ক জনাব মোঃ মোশারফ আলী আদালতে দায়িত্বে থাকাকালীন (Acting in discharge of official duty) আদালতের অন্যান্য কর্মচারীদের প্রায় ৬ (ছয়) লক্ষ টাকা উৎসব ভাতা ব্যাংক থেকে উত্তোলন করে দু’জনে মিলে রিক্সা যোগে দুপুরের দিকে আদালতে ফিরে আসার সময় মোবাইল কোর্টের নির্বাহী কর্মকর্তা অভিজিৎ চৌধুরী তাদেরকে আটক করেন এবং তারা নিজেদের পরিচয় দিয়ে আদালতের কর্তব্যে থেকে এতগুলো টাকার নিরাপত্তার স্বার্থে দু’জন একত্রে রিক্সায় উঠেছেন বলে নির্বাহী কর্মকর্তাকে অবগত করলেও তিনি অর্থদণ্ড প্রদান করেন মর্মে Rabeya Sultana নামে আদালতের এক কর্মচারীর নিজের Facebook Timeline এর বরাত দিয়ে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট এর একজন বিজ্ঞ আইনজীবী ও বাংলাদেশ বিচার বিভাগের সাবেক বিচারক জনাব, আজিজুর রহমান দুলু এর লেখা Apsnews24.com ও lawlifebd.com নামক অনলাইন পত্রিকায় বিগত ০৫ ও ০৬ মে, ২০২০ ইং তারিখে প্রকাশিত হয়েছে।
দাপ্তরিক দায়িত্ব পালনের সময় কৃত কার্য বা দাপ্তরিক দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কোন সরকারী কর্মচারী (Public Servant) কোন কাজ করলে (Acting in discharge of official duty) তা অপরাধের আওতায় আসে কিনা এবং তা আইনের আওতায় আসলেও তার বিচার মোবাইল কোর্ট করতে পারে কিনা তা আইঙ্গতভাবে দেখার বিষয়। আমাদের দেশে ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় ফৌজদারি আদালত ও ফৌজদারি বিচার পরিচালিত হয় THE CODE OF CRIMINAL PROCEDURE, 1898 অনুযায়ী, আর কোন বিশেষ আইনে বিশেষ কোন বিধান থাকলে সে বিধান অনুসরণীয় হয়। তবে, সেই বিশেষ আইনগুলো কতিপয় ক্ষেত্র ব্যতীত বিভিন্ন পদ্ধতিগত বিষয়ে (In procedural matters) সাধারণত উক্ত THE CODE OF CRIMINAL PROCEDURE, 1898 এর উপরেই নির্ভর করে।
মোবাইল কোর্ট অপরাধ আমলে গ্রহণ করতে পারে কিনা- কোন সরকারী কর্মচারী দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বা দায়িত্ব পালনের সময় অপরাধ বলে কৃত কোন কাজ করলে সরকারের পূর্বানুমতি ব্যতীত কোন আদালত (নিয়মিত আদালত বা ভ্রাম্যমাণ আদালত যাইহোক না কেন) কথিত অপরাধ আমলে গ্রহণ করতে পারবে না। কেননা, THE CODE OF CRIMINAL PROCEDURE, 1898 এর ১৯৭ ধারার (১) উপধারায় বলা হয়েছে, …when any public servant who is not removable from his office save by or with the sanction of the Government, is accused of any offence alleged to have been committed by him while acting or purporting to act in the discharge of his official duty, no Court shall take cognizance of such offence except with the previous sanction of the Government”। আবার (২) উপধারায় বলা হয়েছে, “The Government may determine the person by whom, the manner in which, the offence or offences for which, the prosecution of such …public servant is to be conducted, and may specify the Court before which the trial is to be held.” অর্থাৎ এও বলা হয়েছে যে, কার দ্বারা, কোন প্রক্রিয়ায় ও কোন আদালতে উক্ত সরকারী কর্মচারীর কথিত অপরাধের বিচার অনুষ্ঠিত হবে।
মোবাইল কোর্ট কথিত অপরাধের দায়ে সাজা দিতে পারে কিনা- যেখানে ১৯৭ ধারা অনুযায়ী উক্ত অবস্থায় অপরাধ আমলেই গ্রহণ করতে পারে না, সেখানে সাজা দিবে কী করে? আমলে গ্রহণের পর অভিযোগ গঠন করে বিচার প্রক্রিয়ায় অব্যাহতি, খালাস বা সাজার মাধ্যমে তা নিষ্পত্তি করতে হয়। আর যেখানে আমলেই গ্রহণ করতে পারে না, সেখানে সাজা দেওয়ার প্রশ্নই আসে না।
জেলা প্রশাসক নামে পরিচিত ডিসি (ডেপুটি কালেক্টর) নিজে সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন, ২০১৮ এর ১১ ধারার ক্ষমতা বলে কোন বিজ্ঞপ্তি জারি করতে পারে কিনা- উক্ত আইনের কোথাও জেলা প্রশাসক বা ডিসি (ডেপুটি কালেক্টর) কে এই ধরনের ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। কিন্তু, উক্ত ১১ ধারার ক্ষমতাবলে জেলা প্রশাসক নামে পরিচিত ডিসি (ডেপুটি কালেক্টর) নিজেই বিগত ২৩ এপ্রিল, ২০২০ ইং তারিখে বিজ্ঞপ্তি জারি করেছেন মর্মে জানা যায়। কার ক্ষমতা কে দেখায়!!! ফলে, উক্ত এলাকায় ডিসি (ডেপুটি কালেক্টর) কর্তৃক জারিকৃত বিজ্ঞপ্তি অবৈধ।
কথিত অপরাধ প্রকৃতপক্ষেই অপরাধ কিনা- সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন, ২০১৮ এর ২ ও ৩০ নং ধারায় উল্লেখিত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, জেলার সিভিল সার্জন বা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোন কর্মচারীর উপর অর্পিত কোন দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে কোন ব্যক্তি বাধা প্রদান বা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলে এবং সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূলের উদ্দেশ্যে উক্ত কর্মকর্তা বা কর্মচারীর কোন নির্দেশ পালনে অসম্মতি জানালে উক্ত আইনের ২৫ ধারা অনুযায়ী ঐ ব্যক্তি অনধিক ৩ (তিন) মাস কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ (পঞ্চাশ) হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডিত হবেন। অন্যদিকে, উক্ত আইনের ১১ ধারার ক্ষমতাবলে মহাপরিচালক কোন এলাকাকে বা অঞ্চলকে সংক্রমিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করতে পারেন এবং মহাপরিচালক বা ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মচারী সংক্রমিত স্থানে অন্য কোন ব্যক্তির প্রবেশ নিষিদ্ধ, সীমিত বা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। আদালতের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে যদি একত্রে রিক্সায় বসা অপরাধ হয়, মোবাইল কোর্ট পরিচালনায় সঙ্গীয় বাহিনীর সদস্য হিসেবে পুলিশ সদস্যগণ কর্তৃক গাড়িতে একত্রে বসা বা গাড়ির ড্রাইভারের পিছনে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নামের নির্বাহী কর্মকর্তা বসা অপরাধ নয় কেন? এই প্রশ্ন ঐ নির্বাহী কর্মকর্তাকে জিজ্ঞেস করা হলে যে উত্তর আসবে তা আদালতের দু’জন কর্মচারীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না কেন? দু’পক্ষইতো আইনগত ও দাপ্তরিক কর্তব্যে নিয়োজিত ছিলেন। তাহলে, অপরের বেলায় বিচার করে সাজা প্রদান কেন? চিকিৎসার প্রয়োজনে চিকিৎসকগণ অনেক সময় অসুস্থ ব্যক্তিদের শরীরে স্পর্শ করে চিকিৎসা করছেন, পুলিশের সদস্যগণ আসামিদের ধরতে গিয়ে তাদের শরীরে স্পর্শ করছেন, পুলিশের গাড়িতে অনেক সময় পুলিশ সদস্যগণ একত্রে বসছেন, মোবাইল কোর্ট পরিচালনাকারী নির্বাহী কর্মকর্তাগণও গাড়িতে ড্রাইভারের পিছনের সিটে বসছেন যা তিন ফুট দূরত্বের চেয়ে কম- এসব কিছুই আইনগত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে করতে হচ্ছে, ফলে এগুলো আইনগতভাবে অপরাধের পর্যায়ে আসে না। তাহলে, আদালতের দু’জন কর্মচারীর বেলায় ভিন্নতা কেন? এই দু’জনের বেলায় কি মোবাইল কোর্ট এর নির্বাহী কর্মকর্তা সরল বিশ্বাসে সিদ্ধান্ত দিয়েছে? সিভিল সার্জনকে কারাদণ্ড দেওয়া, সাংবাদিককে কারাদণ্ড দেওয়া, বিজ্ঞ আইনজীবীকে কারাদণ্ড দেওয়া- এই সব কিছুই কি নির্বাহী কর্মকর্তাদের অতি সরলতার বিড়ম্বনা? কবে তাদের বোধ আইনসঙ্গতভাবে ও ন্যায়সঙ্গতভাবে উদয় হবে?
নির্বাহী কর্মকর্তা আইনে সুরক্ষা পাবে কিনা- নির্বাহী কর্মকর্তা আইনে সুরক্ষা পাবে কিনা জানার আগে সরল বিশ্বাস বলতে কী বুঝায় তা জানা দরকার। সরল বিশ্বাস কী বুঝায় তা THE PENAL CODE, 1860 এর ৫২ ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে এভাবে, “Nothing is said to be done or believed in “good faith” which is done or believed without due care and attention.” নির্বাহী কর্মকর্তার উক্ত কার্য উল্লেখিত সরল বিশ্বাসে (In good faith) হয়ে থাকলে মোবাইল কোর্ট আইন, ২০০৯ এর সুরক্ষামূলক ১৪ ধারা তাকে কোন ফৌজদারি অভিযোগ বা দেওয়ানি দায় হতে সুরক্ষা দিবে। কিন্তু, সরল বিশ্বাসে না হলে? সরল বিশ্বাসে না হলে তার এরূপ কার্য অপরাধের সামিল হবে, দণ্ডমূলক আইনে উল্লেখিত বিভিন্ন অপরাধমূলক ধারাকে আকর্ষণ করবে, যেমন THE PENAL CODE, 1860 এর ২১৯, ২২০ ইত্যাদি ধারা যেখানে “সরল বিশ্বাস অমান্যকারী”র বা “জেনে-শুনে আইন ভঙ্গ করে সিদ্ধান্ত প্রদানকারী”র অনধিক ৭ (সাত) বছর কারাদণ্ডের বা অর্থদণ্ডের অথবা উভয় দণ্ডের বিধান করা হয়েছে। তাছাড়া, মানহানির কারণে ক্ষতিপূরণের দায়ও উদ্ভব হতে পারে। ফলে, উক্ত কর্মকর্তাকে আইন অনুযায়ী অভিযুক্ত করার বা দায়ী করার সুযোগ সৃষ্টি হয়। তবে, সরল বিশ্বাসে হয়েছে কি হয়নি তা পারিপার্শ্বিক অবস্থার উপর নির্ভর করবে। কিন্তু, উক্ত ঘটনায় নির্বাহী কর্মকর্তা সরল বিশ্বাস (Good faith) দাবি করলে তা কতটুকু গ্রহণযোগ্য হবে তা আইনের পাঠকগণ ভালো করেই জানেন।
সংশ্লিষ্ট নির্বাহী কর্মকর্তাকে এখনো আইন অনুযায়ী অভিযুক্ত করা বা দায়ী করা না হলেও উক্ত ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশের সব জায়গায় বিচার বিভাগীয় কর্মচারীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ জন্ম নিয়েছে এবং এরই ধারাবাহিকতায় বিগত ০৫ মে, ২০২০ ইং তারিখে বিচার বিভাগীয় কর্মচারী এ্যাসোসিয়েশন লিখিতভাবে তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে তা প্রকাশ করেছে। শুধু তাই নয়, এই এ্যাসোসিয়েশন উক্ত নির্বাহী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিও জানিয়েছেন মর্মে বিগত ০৬ মে, ২০২০ ইং তারিখে Jagonews24.com ও LawyersClubBanglades.com এ প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়। এখন বিষয়টি কোন পর্যন্ত গড়ায় তা দেখার জন্য অপেক্ষার পালা…।
লেখক- সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (ক্ষমতাপ্রাপ্ত), সিলেট।