মীর আব্দুল হালিম:
কোভিড-১৯ এর কারণে বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে জীবন ও জীবিকার উপর ব্যাপক প্রভাব পড়ে। সরকারী পদক্ষেপ, লকডাউন, মহামারী ঘোষণা বা চলাচলের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ এবং আদালত বন্ধ থাকার প্রভাব, তামাদি আইনের মাধ্যমে বেঁধে দেয়া সময়সীমার উপরেও নেতিবাচক প্রভাব রাখবে। আদালত খোলার পরপরই নতুন মামলা দায়ের, আপিল, রিভিউ, রিভিশন ও নানারকম দরখাস্ত দাখিল করার জন্য তামাদি আইনে বারিত হওয়ার সম্ভাবনা শতভাগ অর্থাৎ নির্দিষ্ট সময়ে উক্ত বিষয়াদি দাখিল করতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে মামলা করার অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা জেগেছে।
এই জাতীয় আইনি অসুবিধা দূরীকরণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ পদক্ষেপ নিয়েছে। যুক্তরাজ্য করোনাভাইরাস আইন ২০২০ প্রণয়নের মাধ্যমে অন্যান্য বিষয়ের সাথে তামাদি বিষয়গুলো সমাধান করেছে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ সমূহ যেমন ভারত ও পাকিস্তান তাদের সর্বোচ্চ আদালতের মাধ্যমে সাময়িক নির্দেশনা জারি করেছে। আমাদের দেশেও এরকম পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য নতুবা হাজার হাজার মানুষ তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে পারে যা কাম্য নয়।
তামাদি আইন ও বিলম্ব মার্জনা?
তামাদি আইন বিভিন্ন ধরণের মামলা, আপিল ও দরখাস্ত সমূহের জন্য একটি সময়সীমা নির্দিষ্ট করে যার মধ্যে একজন সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি বিচারের জন্য আদালতের দ্বারস্থ হতে পারেন। তামাদি আইনের ধারা ৩ অনুসারে সময়সীমা শেষ হওয়ার পরে যদি দাবি দাখিল করা হয়, তবে আদলত প্রতিকার দিতে অস্বীকৃতি জানাতে পারে। ৫ ধারাতে আদালত সন্তোষজনক হলে বিলম্ব মার্জনা করে মামলা, আপিল বা দরখাস্ত গ্রহণ করতে পারে। আদালতের সন্তুষ্টি বিষয়টি অনেক ব্যাপক এবং অনেক তর্ক সাপেক্ষ বটে। বর্তমানে অচলাবস্থা ৫ ধারার অধীন ব্যতিক্রম হিসেবে ব্যবহার করা যাবে কিনা তা সমাধান জরুরি। ৪ ধারা অনুসারে নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে সাধারণভাবে আদালত বন্ধ থাকলে যেদিন খুলবে সেদিনই মামলা দায়ের করতে হবে। মামলা দায়েরের প্রস্তুতির জন্য প্রয়োজনীয় বিষয়াদি যেমন পক্ষসমূহের উপস্থিতি, আইনজীবীর উপস্থিতি, সত্যায়িত নকল কপি ইত্যাদির নানারকম অপারগতার কারণে মামলা, আপিল, রিভিউ ও রিভিশন তামাদি দোষে দুষ্টু হতে পারে, বিশেষ করে চেক ডিজাইনার এর মামলাগুলি ঝুঁকিতে রয়েছে। সাধারণ মানুষের বিচারের অধিকার এবং আইনজীবিদের বিভিন্ন রকম হয়রানি থেকে সুরক্ষার জন্য আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ অপরিহার্য। তামাদি আইন ১৯০৮ এসব সমস্যার সমাধান দিতে সক্ষম কিনা এবং এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট বা সরকার কর্তৃক কোন নির্দেশনা নির্দেশনার প্রয়োজন আছে কিনা তা কর্তৃপক্ষকে ভেবে দেখতে হবে। বাংলাদেশ সরকার এবং সুপ্রিম কোর্ট এই পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত হতে পারে এবং শত শত মামলা, আপিল ও দরখাস্তগুলি শীঘ্রই দায়েরের অপেক্ষায় রয়েছে এমন আদালতগুলিতে আইনি অসুবিধা দূরীকরণের জন্য নতুন আদেশ বা নির্দেশনা প্রয়োজনীয়।
ভারতে গৃহীত ব্যবস্থা
ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট ২৩ মার্চ/২০ তারিখে সকল সাধারণ ও বিশেষ আইনের অধীনে চলমান তামাদি বিষয়ক সময়সীমা পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত স্থগিতের নির্দেশ দিয়েছে যা মার্চ ১৫, ২০২০ থেকে কার্যকর হয়েছে। প্রধান বিচারপতি এস এ বব দের নেতৃত্বে সুপ্রিম কোর্ট স্বপ্রণোদিত (Suo Moto) আদেশ প্রদান করেন। রিট পিটিশন (সিভিল) নং ৩/২০২০ । সুপ্রিম কোর্টের উক্ত বেঞ্চ সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদের অধীনে বিশেষ ক্ষমতা প্রয়োগে সাধারণ ও বিশেষ আইনে সময়ের যে সীমাবদ্ধতা রয়েছে তা সাময়িক সময়ের জন্য তুলে দিয়ে দেশজুড়ে মামলা, আপিল ও অন্যান্য দরখাস্ত সমূহ দাখিল করার বিষয়ে সহজীকরণ করা হয়েছে। এই আদেশটি সমস্ত উচ্চ আদালত এবং অধীনস্ত আদালত/ ট্রাইব্যুনালের বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ভারতীয় সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদ অনুসারে সুবিচারের স্বার্থে মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট অর্পিত ক্ষমতা অনুসারে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিতে পারে।
পাকিস্তানে গৃহীত ব্যবস্থা
পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্ট তামাদিকাল বর্ধিত করে ২৬শে মার্চ/২০ তারিখে একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে যা তামাদি আইনের ধারা ৪ এর অধীনে সময় গণনায় একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত আদালত বন্ধ থাকবে বলে গণ্য হবে এবং করোনা ভাইরাস মহামারীর কারণে সৃষ্ট জটিলতায় তামাদি আইন দ্বারা কোন মামলা বারিত হবে না। পাকিস্তান সংবিধানের ১৯১ অনুচ্ছেদ এবং সুপ্রিম কোর্ট রুলস ১৯৮০ অনুসারে আদালত এ প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। উক্ত প্রজ্ঞাপনের বিশেষ দুটি দিক হলো নিম্নরুপ ১. তামাদি আইন ১৯০৮ এর ধারা ৪ এর উদ্দেশ্যে আইন বা অন্য কোন আইনের অধীন প্রদত্ত তামাদি আইনের হিসাবের উদ্দেশ্যে, এই আদালতের প্রতিষ্ঠান শাখা, প্রধান আসন এবং শাখা নিবন্ধনসমূহে, ফেডারেল/ প্রাদেশিক সরকার ঘোষিত লকডাউনের কারণে যারা আদালতে যেতে পারছেন না তাদের পক্ষে ২০.০৩.২০২০ থেকে ২১.০৪.২০২০ ( আগে প্রত্যাহার না করা হলে) অবধি বন্ধ থাকবে বলে গণ্য হবে। ২. উপরোক্ত নির্দেশ সত্ত্বেও তামাদি আইনের বিধিবদ্ধ সময়ের মধ্যে দরখাস্ত, প্যাটিশন ও আপিল ইত্যাদি দায়ের করার ক্ষেত্রে কোন নিষেধাজ্ঞা থাকবেনা।পাকিস্তান সংবিধানের ১৯১ অনুচ্ছেদ অনুসারে মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট সংবিধান ও আইনে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে পেশা নিয়ন্ত্রণ ও বিচারিক কার্যপদ্ধতি বিষয়ে নির্দেশনা বা বিধি প্রণয়ন করতে পারে।
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট কি এ জাতীয় ব্যবস্থা নিতে পারে?
বাংলাদেশ সংবিধানে কি একইরকম অনুচ্ছেদ রয়েছে? আমাদের সুপ্রিম কোর্ট কি জাতীয় কোন আদেশ বা প্রজ্ঞাপন জারি করতে পারে? বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১০৭ এ সুপ্রিম কোর্টের বিধি প্রণয়ন ক্ষমতা সম্পর্কে বলা হয়েছে যে সংসদ কর্তৃক প্রণীত যে কোন আইন সাপেক্ষে সুপ্রিম কোর্ট রাষ্ট্রপতির অনুমোদন লইয়া প্রত্যেক বিভাগের এবং অধস্তন যেকোন আদালতের রীতি ও পদ্ধতি নিয়ন্ত্রণের জন্য বিধিসমুহ প্রণয়ন করিতে পারিবেন। অনুচ্ছেদ ১১১ অনুসারে আপিল বিভাগ কর্তৃক ঘোষিত আইন হাইকোর্ট বিভাগের জন্য এবং সুপ্রিম কোর্টের যে কোন বিভাগ কর্তৃক ঘোষিত আইন অধস্তন সকল আদালতের জন্য অবশ্য পালনীয় হইবে।
করোনা ভাইরাস মহামারির কারণে সৃষ্ট অচলাবস্থায় আমাদের মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট আইনি ব্যবস্থা নিতে পারে বলে অনেকের মতো এই লেখক ও মনে করেন। তা হতে পারে বিশেষ প্রজ্ঞাপন কিংবা স্বপ্রণোদিত আদেশ/নির্দেশনা অথবা অন্য কোন উপায়। সর্বোপরি বিচারবিভাগকে ন্যায়বিচারের স্বার্থে একটি উপায় বের করতে হবে।
অস্বাভাবিক এই অবস্থাকে বিবেচনায় নিয়ে সুবিচারের জন্য মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট কোন আইনি উপায় জারি করলে হাজারো মানুষ ভোগান্তি, হয়রানি থেকে বাঁচবে এবং ন্যায় বিচারের অভিভাবক হিসেবে সুপ্রিমকোর্টের মর্যাদা সুপ্রতিষ্ঠিত হইবে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ বার কাউন্সিল, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট বার এসোসিয়েশন সহ সকল আইনজীবী সমিতি সমূহ আইনি বিশ্লেষণের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে নতুবা জনস্বার্থে পেশাগত অবদানের এ সুযোগ হাতছাড়া করার দায় থেকেই যাবে।
(বিশেষ দ্রষ্টব্য: উপরোক্ত বক্তব্য একটি আইনী বিশ্লেষন ও শিক্ষামূলক লেখক এর ব্যক্তিগত অভিমত)
লেখক: অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ও সমন্বয়ক: বাংলাদেশ লিগ্যাল রাইটিং সোসাইটি
ইমেইল: bnm.mir@gmail.com