কামরুল হাসান হীরা:
আইনের শাসন বাস্তবায়ন, মানবাধিকার নিশ্চিত এবং রাষ্ট্রের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে আইনজীবীদের অবদান অসামান্য। বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে দেশের সিংহভাগ আইনজীবী ঘরবন্দি। এমনকি, আদালত পাড়ার প্রিয় চেম্বারে যাওয়ার মানসিক শক্তি দিন দিন ক্ষীণ হয়ে উঠছে। দেশের বর্তমান করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসলে হয়তো কিছুটা পরিবর্তন হবে বলে আশা করা যায়। অন্যথায়, সরকারি নির্দেশ মোতাবেক আদালতের স্বাভাবিক কার্যক্রম যথারীতি স্থগিত থাকবে তা একেবারে নিশ্চিত।
করোনা ভাইরাসের কারণে দীর্ঘ দুই মাস বিচার ব্যবস্থায় এক ধরনের স্থবিরতা নেমে এসেছে। ন্যায় বিচার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় বিচার বিভাগের পিছিয়ে পড়ার যে শঙ্কা ছিল তা ভার্চুয়াল কোর্টের মাধ্যমে বিচার অঙ্গনে কিছুটা স্বস্তি ফিরে পেলো। শত ভয় ও আতঙ্কের মাঝে ভার্চুয়াল কোর্টের মাধ্যমে মামলা পরিচালনার যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে তা অবশ্যই প্রশংসনীয়।
ভার্চুয়াল কার্যপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেশের বিচার বিভাগে শুরু হলো এক নতুন অধ্যায়। একই সাথে বিচার বিভাগে তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের পথ আরেকটু সুগম করল। ভার্চুয়াল কোর্ট বর্তমান সময়ে সরকারের একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত বটে ।
অন্যদিকে, ভার্চুয়াল কোর্টের সুবিধা বা অসুবিধা নিয়ে সাধারণ আইনজীবীদের মনে এক ধরনের দুশ্চিন্তা কাজ করছে । আদালত বন্ধ থাকার কারণে আইনজীবী সমিতির লাইব্রেরীও বন্ধ। একই সাথে সাধারণ আইনজীবীরা তাদের নিজস্ব চেম্বার ব্যবহার করতে পারছেন না। চেম্বারবিহীন মামলা পরিচালনা করা সাধারণ আইনজীবীদের জন্য একটি দুঃসাধ্য কাজ। যেকোনো মামলার প্রস্তুতি ও পরিচালনার ক্ষেত্রে লাইব্রেরী বা ল-চেম্বার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মামলা পরিচালনা করতে আইনজীবীদের বিভিন্ন প্রকার বইয়ের প্রয়োজন হয়। বই ছাড়া মামলা পরিচালনার কথা কল্পনাও করা যায় না।
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির বর্তমান সভাপতি অ্যাডভোকেট এ এম আমিন উদ্দিনের ভাষায় বলা যায় “মানুষের আহার যেমন জরুরী, আইনজীবীদের জন্য বই তেমনি জরুরী।“ কেননা আইন ও আইনের বই আইনজীবীদের প্রধান অস্ত্র। বর্তমান পরিস্থিতিতে ভার্চুয়াল কোর্ট যতটা গুরুত্বপূর্ণ তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ আইনের বই। কত জন আইনজীবীর নিজস্য চেম্বার আছে বা কতজন আইনজীবীর পর্যাপ্ত আইনের বই আছে তার হিসাব বরাবরই অজানা। কার্যক্ষেত্রে, বেশিরভাগ আইনজীবী মামলার শুনানি অন্তে নতুন নতুন বই কিনে নিজেদের জানার পরিধি বৃদ্ধি করেন। তদ্ব্যতীত, সাধারণ আইনজীবীরা বার সমিতির লাইব্রেরীর উপর অতিমাত্রায় নির্বরশীল। তাই, ভার্চুয়াল কোর্ট পরিচালনার সাথে সাথে ভার্চুয়াল লাইব্রেরীর উপর গুরুত্ব দেওয়া অতীব জরুরী।
ইহা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে, দেশের এহেন পরিস্থিতিতে বিচার বিভাগ ইন্টারনেট সেবা (ভিডিও কনফারেন্স) কাজে লাগিয়ে মামলা পরিচালনা করতে পারছে। সেক্ষেত্রে, বাংলাদেশ বার কাউন্সিল বা সুপ্রিম কোর্ট বার বা জেলা বার সমিতিগুলো কেন যুগোপযোগী অনলাইন লাইব্রেরী সেবায় পিছিয়ে আছে তার সমাধান খোঁজা খুব জরুরী।
উপরন্তু, বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে আইনজীবী সমিতির লাইব্রেরী সেবার মান কতটা উন্নত তা পাশের দেশ ভারত, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া এবং সিঙ্গাপুরের দিকে লক্ষ্য করলে বুঝা যায়। এ সকল দেশের সাধারণ আইনজীবীগণ নিজেদের ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে অনলাইন লাইব্রেরী বা ই-লাইব্রেরী সেবা পাচ্ছেন। সত্যি বলতে বাংলাদেশেও ই-লাইব্রেরী সেবার প্রচলন আছে। বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের জাজেস লাইব্রেরী অনেকটা আধুনিক ই-লাইব্রেরীর মতন। যেখানে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকরা নিজেদের ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে ই-লাইব্রেরী সেবা নিচ্ছেন।
সে হিসাবে আমাদের দেশের আইনজীবী সমিতির লাইব্রেরী সেবা অনেকটাই পুরাতন নিয়মে সীমাবদ্ধ। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ঢাকা আইনজীবী সমিতির লাইব্রেরীতে সর্বমোট বইয়ের সংখ্যা প্রায় ১৯,০০০ বা তার চেয়ে কিছু বেশি। এসকল বইয়ের মধ্যে বেশিরভাগ বইয়ের এক বা একধিক অনুলিপি রয়েছে। তার মধ্যে এমন অনেক বই আছে যা পড়া, ফটোকপি করা কিংবা প্রয়োজনে আদালতে উপস্থাপন করার মতন উপযুক্ত না। এছাড়াও, অনেক বইয়ের মলাট, সূচীপত্র, ভিতরের পাতা ছিন্নবিচ্ছিন্ন কিংবা হারিয়ে গেছে। এর সাথে পৰ্যাপ্ত বইয়ের অভাব ও লাইব্রেরী কর্তৃপক্ষের সীমাবদ্ধতার দরুন অনেক বই সময় নিয়ে পড়া অসম্ভব। উল্লেখ্য যে, ঢাকা বারকে উপমহাদেশের সবচেয়ে বৃহত্তর বার বলা হয়। সে অনুপাতে ঢাকা আইনজীবী সমিতি অনলাইন বা ই-লাইব্রেরী সেবার কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি। তাই বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির যুগে অনলাইন বা ই-লাইব্রেরী সেবার মান উন্নয়ন করা অত্যান্ত জরুরী হয়ে পড়েছে।
এই লক্ষ্য বাস্তবায়নে আইনজীবী সমিতির ওয়েবসাইটে ই-লাইব্রেরী চালু করা প্রয়োজন। ই-লাইব্রেরীর মাধ্যমে বিপুল সংখ্যক বইয়ের সংরক্ষণ করা সম্ভব। যার ফলে, সাধারণ আইনজীবীদের সময় এবং অর্থ দুটোই বাঁচবে। ই-লাইব্রেরী থাকলে আইনজীবীরা নিজ বাসস্থান বা চেম্বারে বসে অনলাইনে বই পড়ার সুযোগ পাবেন। ই-লাইব্রেরী ব্যবহারের ক্ষেত্রে সাধারণ আইনজীবীরা নিজেদের ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে যেকোনো সেবা নিতে পারবেন। এক্ষেত্রে, পাইলট প্রজেক্ট হিসেবে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি ও ঢাকা আইনজীবী সমিতির লাইব্রেরীতে রক্ষিত নতুন ও পুরাতন বইয়ের সংখ্যার উপর ভিত্তি করে স্বল্প পরিসরে অনলাইন লাইব্রেরী সেবা চালু করা যেতে পারে।
অতি প্রয়োজনীয় কিছু বইয়ের মাস্টার কপি; পিডিএফ (PDF) ফাইল বা স্ক্যান কপি করে সীমিত আকারে অনলাইন সেবা শুরু করা প্রয়োজন। ক্ষেত্রবিশেষে, ই-লাইব্রেরীতে আপলোডকৃত পিডিএফ (PDF) বা স্ক্যান করা ফাইল ডিটেক্ট করা থাকলে সহজে কেউ ডাউনলোড বা কপি করতে পারবে না। এই ক্ষেত্রে লাইব্রেরী কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই বিশেষ লক্ষ্য রাখতে হবে। এছাড়া, অনলাইন সেবার পাশাপাশি আইন বিষয়ক গবেষণার জন্য ইলেকট্রনিক ডাটাবেজের সুবিধা রাখা খুবই জরুরী। উক্ত ডাটাবেজে দেশী ও বিদেশী আইন, কেস ডিসিশন, ল-রিপোর্ট, ল-রিভিউ , লিগাল রিসার্চ জার্নাল, ল-ডাইজেস্ট, ই-বুক, কমেন্টারি, ইত্যাদি সহ সকল সেবা নিশ্চিত করা দরকার। একইসাথে, অনলাইন ব্রাউজিংয়ের জন্য অনলাইন ডাটাবেজ যেমন: হেইন-অনলাইন, ল-নেট, লেক্সিস, প্রো-কোয়েস্ট ইত্যাদির ব্যবস্থা করা খুবই দরকারি।
এছাড়াও, অতীতের অনেক মহা মূল্যবান বই বছরের পর বছর লাইব্রেরীতে থাকতে থাকতে পড়ার অনুপোযোগী হয়ে পড়েছে। অনতিবিলম্বে, পুরনো বই গুলোকে স্ক্যান করে পিডিএফ (PDF) ফাইল আকারে অনলাইন বা ই-লাইব্রেরীতে আপলোড করলে অনেক আইনজীবী উপকৃত হবেন। ইহা উল্লেখ্য যে, পুরনো বই রক্ষণাবেক্ষণে অর্থ লগ্নি হলেও অনলাইন ভিত্তিক সফট কপি সংরক্ষণে ঝামেলা নেই বললেই চলে। অনলাইন ভিত্তিক ই-লাইব্রেরী সেবা আইনজীবীদের জন্য সুফল বয়ে আনবে। যার প্রেক্ষিতে দেশের আইন চর্চায় আশানুরূপ পরিবর্তন আসবে বলে প্রত্যাশা করা যায়। ভবিষ্যতে, এই সেবার মান বৃদ্ধি ও ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারলে দেশব্যাপী আইনজীবীদের কাছে ই-লাইব্রেরী সেবার গুরুত্ব বাড়বে। অনলাইন ভিত্তিক ই-লাইব্রেরী তৈরি করতে প্রাথমিক অবস্থায় বিশাল অঙ্কের অর্থ লগ্নি করতে হবে। করোনা ভাইরাসের মত এরকম পরিস্থিতি ভবিষ্যতে আর আসবে কি আসবে না তা বলা অসম্ভব। কিন্তু, ভার্চুয়াল বা ই-লাইব্রেরী সেবা চালু হলে সাধারণ আইনজীবীরা দূর থেকে প্রয়োজনীয় সেবা নিতে পারবেন। সাধারণ আইনজীবীদের বৃহত্তর স্বার্থে অনলাইন ভিত্তিক ই-লাইব্রেরী সেবার উপর অধিক গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।
এমতাবস্থায়, বাংলাদেশ বার কাউন্সিল কর্তৃপক্ষ, সুপ্রিম কোর্ট বার ও জেলা বার সমিতি কর্তৃপক্ষ এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছার উপর নির্ভর করে ই-লাইব্রেরীর ভবিষ্যৎI অনলাইন ভিত্তিক ই-লাইব্রেরী চালু করা সময়ের দাবিI ই-লাইব্রেরী চালু হলে একটি বই হাজার হাজার আইনজীবী একসাথে এবং একই সময়ে পড়তে পারবে। এই লক্ষ্য বাস্তবায়নে, বাংলাদেশ বার কাউন্সিল কর্তৃপক্ষকে সবার আগে এগিয়ে আসতে হবেI
লেখক: পিএইচডি গবেষক ও বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী।