মো: রায়হানুল ওয়াজেদ চৌধুরী:
যুদ্ধের দামামা বাজছে সর্বত্র। আমি প্রস্তুত হয় নাই বলে কি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকব ? তাহলে তো প্রতিপক্ষ আমাকে ঘায়েল করে ফেলবে। সুতরাং নিজেকে বাঁচাতে , আপাতত যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। এটাই তো স্বাভাবিক?
করোনা সংকটে আদালত ২৫শে মার্চ থেকে বন্ধ। কবে নাগাদ এই মহামারী সমাপ্তি হবে সেটাও অনিশ্চিত। এইভাবে দিনের পর দিন রাষ্ট্রের একটি অঙ্গ যেমন বন্ধ থাকতে পারে না, তেমনি বিচার নিষ্পত্তি হওয়ার আগে বিনা বিচারে জেল হাজতে কেউ অভিযুক্ত হয়ে থাকতে পারে না। যা পৃথিবীর সমস্ত সাংবিধানিক আইন, মানবাধিকার আইন, কনভেনশন, প্রটোকল, আর্টিকেল, বিধিমালার চরম লঙ্ঘন শুধু নয় রীতিমতো চপেটাঘাত করা । মোদ্দা কথা হচ্ছে, আইন আদালত বন্ধ রাখা যায় না। আইন আদালতের কার্যক্রম বিহীন সমাজ – দেশ চলতে পারে না। আধুনিক সভ্য সমাজে সেটা চিন্তাও করা যায় না।
মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট হয়তোবা ইত্যকার বিষয় নিয়ে আলোচনা করে শুধুমাত্র হাজতী আসামীর (অভিযুক্ত) জামিনে মুক্তির ব্যবস্থা করতে, সীমিত আকারে কঠোর স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করে সপ্তাহে দুইদিন আদালত খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সুপ্রিম কোর্টের ওই প্রজ্ঞাপনে বার এবং বেঞ্চ কে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল কিভাবে কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মেনে আদালতের কার্যক্রম চলবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে । আদালতের কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর যদি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা সম্ভব না হয়, তাহলে বন্ধ করার ক্ষমতাও দেয়া হয়েছিল সেই প্রজ্ঞাপনে সংশ্লিষ্ট আদালতকে। বার এবং বেঞ্চ বসে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই তীব্র বিরোধিতা শুরু করেন বিজ্ঞ আইনজীবীরা। ঢাকা এবং চট্টগ্রাম বার লিখিত আবেদন করে বন্ধ রাখতে। যার কারণে সুপ্রিম কোর্ট আবার প্রজ্ঞাপন দিয়ে সপ্তাহে দুইদিন বিশেষ কোর্ট খোলা সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখা হয়।
শেষ পর্যন্ত, প্রচলিত আইনি ব্যবস্থায় আদালতের কার্যক্রমে তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার অনুমতি না থাকায়, মহামান্য রাষ্ট্রপতি ৯ই মে ২০’ আদালত কর্তৃক তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারে অর্ডিন্যান্স জারি করেন সুপ্রিম কোর্টের আবেদনে। যার ফলশ্রুতিতে সীমিত আকারে ভার্চুয়ালি আদালতের কার্যক্রম পরিচালনার সিদ্ধান্ত হয়। সেই লক্ষ্যে সুপ্রিমকোর্ট ১০ই মে২০’ ভার্চুয়াল কোর্টের নির্দেশনা জারি করেন।
পরেরদিনই কোন পোর্টাল কিংবা ওয়েবসাইট ব্যবহার না করে সহজেই আদালতের কার্যক্রম পরিচালনার নিমিত্তে আইনজীবী বিচারক ইমেইল আদান-প্রদান এবং ভিডিও কনফারেন্সে সীমিত আকারে ভার্চুয়ালি আদালতের কার্যক্রম পরিচালনার নোটিশ দেয়া হয়েছে বিভিন্ন আদালত থেকে।গতকাল ১২ তারিখ প্রথম দিনেই দেশের বিভিন্ন নিম্ন আদালতের ভার্চুয়াল কার্যক্রমে কয়েকটি জামিন আবেদন শুনানিতে ১৪৪ জন হাজতি আসামির জামিনে মুক্তির আদেশ হয়। সাধিত হয় বিচারব্যবস্থার নতুন যুগান্তকারী মাইলফলক। ন্যায়বিচার মানবাধিকার সুশাসন উচ্চকিত হয়। অন্তত ভার্চুয়াল আদালতের কারণে কিছু মানুষ মুক্তি পেল। মহামান্য হাইকোর্টেও ভার্চুয়াল কার্যক্রম চলছে রিট শুনানি হয়েছে।
কিন্তু এইবারও সীমিত আকারের এই কথিত ভার্চুয়াল কোর্ট নিয়ে নানারকম সমস্যা তুলে ধরে সমালোচনা করছেন বিজ্ঞ আইনজীবীরা ! কয়েকটি বার রীতিমতো ভার্চুয়াল আদালতের কার্যক্রম বয়কট করার ঘোষণা করেছে !
আইন-আদালত মানবাধিকার রক্ষা করতে বিজ্ঞ আইনজীবীরা যেখানে প্রতিবাদ সংগ্রাম আন্দোলন করবেন, সেখানে এই ভূমিকা পালন নিশ্চয়ই প্রশ্নবিদ্ধ !
অথচ বিজ্ঞ আইনজীবীরা শপথ নিয়েছিলেন,”আমি………. সশ্রদ্ধচিত্তে শপথ করিতেছি যে, আইনজীবীরূপে আমি আমার পেশার সুউচ্চ মান ও মর্যাদা সমুন্নত রাখিব; একই সঙ্গে আত্মমর্যাদাবোধ ও এই পেশার প্রতি যথাযথ নিষ্ঠাবান থাকিব এবং পেশাদারী আচরণ ও নৈতিক মানদন্ড অনুসরণ করিয়া চলিব। সংবিধানের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধানকে আমার পবিত্র কর্তব্য মনে করিব এবং বাংলাদেশের জনগণের অভিপ্রায়ের অভিব্যক্তিস্বরূপ ইহার শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখিতে সচেষ্ট হইব। সংবিধানের পরিপন্থী কোন কর্মকান্ডের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করিব না। মানবাধিকার রক্ষায় আমি হইব একজন সদাপ্রহরী এবং এমন একটি সমাজ বিনির্মাণের লক্ষ্যে নিজেকে নিয়োজিত রাখিব যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক,অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার সুনিশ্চিত হইবে।”
আফসোস শপথবাক্য বেমালুম ভুলে, আদালত বন্ধ রাখতে নিজের মতো করে অনেকটা আত্বকেন্দ্রীক সমালোচনা করা হচ্ছে। নিরপেক্ষতা না রেখে নিজের মতো করে ব্যাখা মন্তব্য করা হচ্ছে সোস্যাল মিডিয়ায়।
সুপ্রিম কোর্টের ১৩ এপ্রিলের প্রজ্ঞাপনে বার এবং বেঞ্চ বৈঠক বসে কোনো সিদ্ধান্ত দেওয়ার আগেই সপ্তাহে দুইদিন কোর্ট খোলা সিদ্ধান্ত বিজ্ঞ আইনজীবীরা বিরোধিতায় স্থগিত করা হয়েছে করোনা ভাইরাস আক্রান্ত তথা প্রাণ রক্ষা করতে। এখন ভার্চুয়াল কোর্টের কার্যক্রম অনেক বিজ্ঞ আইনজীবীরা বোঝেন না ইত্যকার বিষয় নিয়ে ভার্চুয়াল কার্যক্রম এর শুধু বিরোধিতাই নয় রীতিমতো বয়কটের ঘোষণা !
এই আধুনিক যুগে দেশের আদালতের কার্যক্রমে তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার সময়ের দাবি এবং প্রত্যাশিত ছিল। করোনা সংকট এই দাবির কাজটি এগিয়ে দিল। সীমিত আকারে ভার্চুয়াল কোর্টের কার্যক্রম শুরু হল । যদিও আমি চললান কার্যক্রমকে ভার্চুয়াল আদালত বলতে নারাজ। কারণ প্রকৃত ভার্চুয়াল কোর্টের কার্যক্রম এর তেমন কিছুই এখানে হচ্ছে না। একবারেই প্রাথমিক কয়েকটি কাজ হচ্ছে। বড়জোর ” নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো” এইরকম একটা কার্যক্রম বলা যায়। যেখানে ইন্টারনেট ব্যবহারে মেইলের আদান-প্রদান এবং ভিডিও কনফারেন্স করা হচ্ছে।
সীমিত আকারে ভার্চুয়ালি এই কাজটির ও যারা বিরোধিতা করছেন তাদের কাছে আমার প্রশ্ন, যদিও আদালতের কার্যক্রমের সাথে জড়িত ব্যক্তিগণের কিছু প্রাক প্রস্তুতি এবং প্রশিক্ষণের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে সেটা আশা করা কতটা যৌক্তিক ? এমনতো না যে আইনজীবীদের কেউ ভার্চুয়াল কাজটি করতে পারেন না। আমার তো মনে হয় বেশিরভাগ আইনজীবী পারবেন।
জরুরী ভিত্তিতে শুধুমাত্র হাজতী আসামীর জামিন শুনানি করতে স্ক্যান-মেইল-ভিডিও কনফারেন্স এই কথিত ভার্চুয়াল কার্যক্রম। যা মোবাইলে করা সম্ভব। এই কাজটি করতে কি প্রশিক্ষণ কর্মশালা প্রয়োজন ?
বর্তমান ডিজিটাল সময়েও, দেশের প্রথম শ্রেণীর নাগরিক এবং উচ্চতর ডিগ্রিধারী ব্যক্তিগণের ইমেইল আইডি থাকবে না , স্মার্টফোন ব্যবহার করবেন না। এটাও কি বিশ্বাস করতে হবে? এটা কি ব্যক্তিগত অদক্ষতা নয়? আচ্ছা বুঝলাম, তারপরও অনেকেই পারবেন না। কিন্তু ওনারা কারো কাছে হেল্প নিয়ে তো কাজটা করতে পারেন ?
সীমিত আকারে কাজটা তো আর সবার নাই । মক্কেলের জন্য সেবা দিতে ইচ্ছুকদের কাছে কাজটি জটিল কোন সমস্যা হওয়ার কথা না। সুতরাং ওনাদের করতে দিন। আর সেটাও যদি না পারেন তাহলে ভেবে দেখলে, এই আদালতে শুধু একা আইনজীবীই যাবার অধিকার রাখি না। দেশের প্রতিটি নাগরিকের যেকোন নাগরিক আইনজীবীর সাহায্য ছাড়াই এই আদালতে যাবার অধিকার আছে। এবং সাংবিধানিক পদ বা অফিস বা আদালত হিসাবে একজন বিচারক কখনো তার কাজ বন্ধ রাখুক এটা একজন আইনজীবী হিসাবে শপথ গ্রহন করার কারনে চাইতে পারেন না। আদালতের বিচার কজের মূলতবি হতে পারে কিন্ত কখনো বন্ধ হতে পারে না। আদালত বন্ধ বলে প্রকারান্তে সংবিধানের বিচার বিভাগের কার্যক্রম বন্ধ রাখতে পারেন না।
বিচার বিভাগ কে বাঁচাতে, মানবাধিকার ও সুশাসন সমুন্নত রাখতে, আপাতত ভার্চুয়াল কোর্টের কার্যক্রম যা হচ্ছে তাই মানিয়ে নিয়ে করোনা সংকট রুখে দাঁড়াতে হবে। বর্তমান সময়ে “ঢাল নেই তলোয়ার নিধিরাম সর্দার” এর মতো তথ্য প্রযুক্তি বিহীন আইনজীবী যেন না হই।
লেখক- অ্যাডভোকেট, জজ কোর্ট, চট্টগ্রাম।
ইমেইল : ll.braihan@gmail.com