ইমতিয়াজ আহমেদ সজল:
ইসলামি শরয়ি আইনের সকল বিষয় আমাদের দেশীয় আইনের অংশ নয় বিধায় তা সম্পূর্ণ রূপে এখানে প্রযোজ্য নয়। ১৯৩৭ সালের মুসলিম পার্সোনাল ল’(শরিয়ত) প্রয়োগ আইনে যে সকল বিষয় উল্লেখ রয়েছে শুধুমাত্র সেসব বিষয়েই বাংলাদেশের মুসলমানদের জন্য শরয়ি আইন প্রযোজ্য। উত্তরাধিকার সম্পত্তি, বিবাহ, তালাক ও অন্যান্য উপায়ে বিবাহবিচ্ছেদ, অভিভাবকত্ব ও সন্তানের হেফাজত,দেনমোহর ও ভরণ-পোষণ, দান, অছি, ওয়াকফ ইত্যাদি সংক্রান্ত বিষয়ে কোন বিরোধ দেখা দিলে মুসলিম ব্যক্তিগত আইন (শরিয়ত) অনুসারেইতার নিষ্পত্তি হবে। তবে এসকল বিষয়ে শরিয়া আইনের পাশাপাশি বিধিবদ্ধ আইনওরয়েছে। শরিয়া আইনে জাগতিক ও ধর্মীয় বিবেচনায় বিবাহকে অত্যন্ত শক্তিশালী ও গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক বন্ধন হিসাবে দেখা হয়ে থাকে। তবে সে সাথে এ বন্ধন ছিন্ন করারও বিধান রাখা হয়েছে যখন তা হয়ে উঠবে বিভীষিকাময় ও পারস্পরিক কলহ-বিবাদের কারণ। মুসলিম বিবাহবিচ্ছেদের অনেকগুলো পদ্ধতির মধ্যে আমাদের সমাজে তালাকই সবচেয়ে বেশি প্রচলিত। সাধারণত স্বামীদের দিক থেকে তালাক সূচিত হয় এবং ক্ষেত্র বিশেষে (তালাক-এ-তাফবিজ) স্ত্রীদের দিক থেকেও হয়ে থাকে।
শরয়ি আইনে তালাককে বৈধ করা হলেও একে অনুৎসাহিত ও নিয়ন্ত্রিত করা হয়েছে। হাদিছ -এতালাককে ‘শরিয়তে বৈধ কাজগুলোর মধ্যে সবচেয়ে নিন্দনীয়’ হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। পবিত্র কোরআনে তালাক প্রদানের দীর্ঘসময়ও সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি বর্ণিত হয়েছে যা বিভিন্ন ধাপে অত্যন্ত যোক্তিক ও বিবেচনাপূর্ণভাবে গ্রহণের নির্দেশ রয়েছে। কারণ, নির্দিষ্ট সময়-কাঠামো এবং পদ্ধতি মেনেস্বামী-স্ত্রীর মধ্যে একবার তালাক হলেও বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত থেকে ফিরে আসতে পারে, স্ত্রীর ভরণপোষণ,সন্তানের দায়িত্ব ইত্যাদি নিয়ে আলোচনার সুযোগ থাকে।পবিত্রকোরআনেই বলা আছে স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য কলহ নিজেদের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে না পারলে দু পক্ষ থেকে সালিসদার নিয়োগ করে তাদের মাধ্যমে বিরোধ মীমাংসার কথা। সমঝোতা ও মধ্যস্থতার সব চেষ্টা করে, সালিসদারদের বিবেচনায় যখন প্রতিয়মান হবে যে, বিবাহবিচ্ছেদই এ কলহ-বিবাদ থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় তবেই তারা স্বামী-স্ত্রীকে বিচ্ছেদের পথে হাঁটতে বলবেন।তাই তাৎক্ষণিকওঅবিবেক-বিবেচনাপ্রসূত ভাবেতালাকের সিদ্ধান্ত নেয়া স্পষ্টতইশরয়ি বিধানের লঙ্ঘন।
পবিত্রকোরআনের এসব নির্দেশনার আলোকে তাৎক্ষণিক তালাক প্রথা রোধে, তালাক প্রদানে যথেচ্ছাচার ও স্বেচ্ছাচারিতা বন্ধে,পারস্পরিক সমঝোতা ও মধ্যস্থতার সুযোগ সৃষ্টি করতে এবং সালিসি পরিষদের(আরবিট্রেশন কাউন্সিল) মাধ্যমে দাম্পত্য বিরোধ নিষ্পত্তির বিধান করতে মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ, ১৯৬১ তে এ সংক্রান্ত বিধি-বিধান সন্নিবেশিত হয়। এসব বিধিনিষেধ অমান্যে শাস্তিরও বিধান করা হয়।মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশের ধারা ৭ ও ৮ -এ তালাক বা অন্য যেকোন ভাবে বিবাহবিচ্ছেদের পদ্ধতি সম্পর্কে বলা হয়েছে। আইনানুযায়ী,স্বামী বা স্ত্রীযে কেউ তালাক প্রদান বা অন্য কোন ভাবে বিবাহবিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিলে অনতিবিলম্বে তা সংশ্লিষ্ট (স্থানীয় সরকার ইউনিট এর) চেয়ারম্যানকে লিখিতভাবে তালাক বাবিবাহবিচ্ছেদ সম্পর্কে নোটিশ দিবে এবং স্বামী/স্ত্রীকে সে নোটিশের অনুলিপি দিবে। প্রকাশ্যে বা অন্যকোনভাবে তালাক বা বিবাহবিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার না করলে নোটিশ প্রদানের ৯০ দিন পর তালাক কার্যকর হয়ে যাবে। আইনে চেয়ারম্যানকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে যে, নোটিশ প্রাপ্তির ৩০ দিনের মধ্যে তিনিসহ দুপক্ষের দুজন প্রতিনিধি নিয়েপারস্পরিক সমঝোতার লক্ষ্যে একটি সালিসি পরিষদ গঠন করবেন। এ সালিসি পরিষদ স্বামী-স্ত্রীর সমঝোতা ও দাম্পত্য সম্পর্ক পুনঃস্থাপনে প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। এ অধ্যাদেশের অধীন প্রণীত বিধিমালাতে বহুবিবাহ ও খোরপোষ সংক্রান্ত বিষয়ে সালিসি পরিষদের ভূমিকা কী হবে এবং কীভাবে সিদ্ধান্তে পৌঁছবে সে বিষয়ে বলা থাকলেও তালাক বা বিবাহবিচ্ছেদ সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু বলা হয়নি। ফলে,নোটিশ প্রাপ্তির ৩০ দিনের মধ্যে সমঝোতার চেষ্টা করার আইনগত বাধ্যবাধকতা থাকা সত্যেও তালাক বা বিবাহবিচ্ছেদেস্বামী-স্ত্রীর মধ্যস্থতা ও তাদের দাম্পত্য সম্পর্ক পুনঃস্থাপনে সালিসি পরিষদ কার্যকর কোন ভূমিকা রাখতে পারছে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই চেয়ারম্যান সালিসি পরিষদ গঠনের জন্য কাউকে ডাকেন না; আবার অনেক সময় ডাকলেও কোন পক্ষই সাড়া দেয় না। এতে করে নিদিষ্ট সময়ান্তে তালাক কার্যকর হয়ে যায়। যার ফলে ছোট খাট বিবাদ-বিসংবাদ থেকে উদ্ভূত কলহ হর-হামেশাই রূপ নিচ্ছে বিবাহ বিচ্ছেদে এবংসেইসাথে অমীমাংসিত থেকে যাচ্ছেস্ত্রীর দেনমোহর, ভরণ-পোষণ এবং শিশু সন্তানেরঅভিবাবকত্ব ও তত্ত্বাবধানেরমত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো। এসব দাবি নিয়ে তাদেরকে আবার পারিবারিক আদালতের দ্বারস্থ হতে হয়,যা নিষ্পত্তিতে অনেক সময় লেগে যায়। অনেক স্ত্রীই আবার স্বামীদের একতরফা ও অন্যায্য তালাকের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে তাদের ব্যাপারে নারী নির্যাতন ও যৌতুকের অভিযোগ তুলে অপরাধ আদালতের শরণাপন্ন হন। এভাবে চলতে থাকে নানান বিড়ম্বনা আর হয়রানি।
সালিস পরিষদের অকার্যকারিতার ফলে অবাধে বাড়ছে বিবাহবিচ্ছেদের সংখ্যা। ভেঙ্গে যাচ্ছে পরিবার, দেখা দিচ্ছে নানান সামাজিক সমস্যা। গত ৪ জুলাই ২০১৮,শিশু সন্তানদের তত্ত্বাবধান সংক্রান্ত একটি রিটের শুনানিকালে হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ মন্তব্য করেছেন যে– “প্রতিটি বিবাহবিচ্ছেদেই সন্তানেরা ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং তাদের সবার অনুভূতি একই রকম হয়, তারা চান যে তাদের বাবা-মা যেন একসাথে থাকে।”
২০১৮ সালের ২৭ আগস্ট ‘ঢাকায় ঘণ্টায় এক তালাক’ শিরোনামে দৈনিক প্রথম আলোতে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোও প্রকাশিত গত ছয় বছরের বিবাহবিচ্ছেদের তথ্য বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকা শহরে গড়ে প্রতি ঘণ্টায় একটি করে তালাকের আবেদন করা হচ্ছে। তালাকের আবেদন সবচেয়ে বেশি বেড়েছে উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায়—প্রায় ৭৫ শতাংশ। দক্ষিণ সিটিতে বেড়েছে ১৬ শতাংশ।
উক্ত প্রতিবেদনের উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির পক্ষে সাধারণ সম্পাদিকা সীমা জহুর ও আইনজীবী কাজী মারুফুল আলম একটি রিট আবেদন করেন, রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে গত ১৫ এপ্রিল ২০১৯ বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ বিবাহবিচ্ছেদ, সন্তানেরঅভিভাবকত্ব ও তত্ত্বাবধান এবং দেনমোহরের মতো বিষয়ে জটিলতা এড়াতে সালিসি পরিষদের কার্যকারিতা নিয়ে রুল দিয়েছেন। রিট আবেদনকারীপক্ষ জানায়, রুলে পবিত্র কোরআন, আন্তর্জাতিক কনভেনশন ও আইন অনুসারে বিবাহবিচ্ছেদ, দেনমোহর পরিশোধ ও সন্তানের তত্ত্বাবধানের বিষয় নিষ্পত্তিতে এ-সংক্রান্ত সালিস পরিষদের ভূমিকা নিশ্চিতে একটি নীতিমালা করতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়েছে। এ ছাড়া স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদ, ভরণ-পোষণসহ আনুষঙ্গিক পাওনা নিষ্পত্তিতে সালিসি পরিষদের ভূমিকা বাধ্যতামূলক করতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, রুলে তা-ও জানতে চাওয়া হয়েছে।
হাইকোর্টের এ রুল জারির পর সালিসি পরিষদের সম্ভাব্য ভূমিকা ও কার্যকারিতা নিয়ে দেখা দিয়েছে ভিন্ন বিতর্ক। অনেক আইনজ্ঞের মতেই বিবাহবিচ্ছেদ, দেনমোহর ও ভরণ-পোষণ এবং সন্তানের অভিভাবকত্ব ও তত্ত্বাবধানের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর সিদ্ধান্ত সালিসি পরিষদের হাতে ছেড়ে দেয়া ঠিক হবে না। কেননা, সালিসি পরিষদে মূলত চেয়ারম্যানের মতামতের ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। চেয়ারম্যান কোন বিচারিক জ্ঞান সম্পন্ন ব্যক্তি নন। আইনে তাঁর ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা বা দক্ষতার কোন উল্লেখও নেই। তাছাড়া, বর্তমানে স্থানীয় সরকারের সব পর্যায়ে চেয়ারম্যানরা কোন একটি রাজনৈতিক দল থেকে মনোনীত হয়ে নির্বাচিত হন। তাই তাঁদের কাছ থেকে নির্ভুল ও নিরপেক্ষ সিদ্ধান্ত পাওয়ার বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধই থেকে যায়।
এসব বিষয় বিবেচনায় ‘বিচারিক প্রক্রিয়ায় বিবাহ বিচ্ছেদ’ সম্পাদনকেই এখন উত্তম পন্থা বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। অর্থাৎ, বিবাহ বিচ্ছেদে ইচ্ছুক স্বামী বা স্ত্রীকে বিচ্ছেদ ঘটানোর পূর্বেই সম্ভাব্য বিচ্ছেদের কারণ, যোক্তিকতা ও বিচ্ছেদ পরবর্তী বিষয়ের প্রতিকার পার্থনা করে যথাযথ আদালতে আবেদন করতে হবে। আদালত প্রথমে দুপক্ষের প্রতিনিধিদের সহায়তায় বিবাহ বিচ্ছেদে ইচ্ছুক স্বামী-স্ত্রীর মাঝে সমঝোতা ও সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের চেষ্টা করবে, তা সম্ভব না হলে বিচ্ছেদের আবেদন মঞ্জুর করবেন এবং বিচ্ছেদ পরবর্তী পারস্পরিক অধিকার ও দায়-দায়িত্ব সম্পর্কেও সিদ্ধান্ত দিবেন। বিশ্বের যেসব মুসলিম দেশ তাঁদেরব্যক্তিগত আইনে আমূল সংস্কার করেছে যেমন- মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, আলজেরিয়া, লিবিয়া, মরক্কো ও তিউনেশিয়া তারা একতরফা,অবিবেক-বিবেচনাপ্রসূত ও অন্যায্য তালাকের পথ রুদ্ধ করতে এখন শুধুমাত্র ‘বিচারিক প্রক্রিয়ায় বিবাহ বিচ্ছেদ’-এর নিয়ম চালু করেছে।
আমাদের পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ, ১৯৮৫ -এর ধারা ৫ মতে বিবাহ বিচ্ছেদ, দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধার,দেনমোহর, ভরণ-পোষণ এবং অভিভাবকত্ব ও শিশু সন্তানের তত্ত্বাবধান এ পাঁচটি বিষয়ে বিচারের একচ্ছত্র এখতিয়ার দেয়া হয়েছে পারিবারিক আদালতকে। তাইবাংলাদেশের পারিবারিক আদালতগুলোই হতে পারে‘বিচারিক প্রক্রিয়ায় বিবাহ বিচ্ছেদ’সম্পাদনের একমাত্র স্থান। যেখানে পারিবারিক আদালতের বিচারক দুপক্ষের প্রতিনিধিদের নিয়েসালিসি পরিষদ গঠন করে সমঝোতার চেষ্টা করবেন, সমঝোতা সম্ভব না হলে বিচ্ছেদের আদেশ দিবেন এবং দেনমোহর, ভরণ-পোষণ এবং অভিভাবকত্ব ও শিশু সন্তানের তত্ত্বাবধান ইত্যাদি বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিবেন। বর্তমানেও, বাংলাদেশের যেসব স্ত্রীদের তালাক-এ-তাফবিজ এর ক্ষমতা দেয়া হয়নি তারা মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ আইন, ১৯৩৯ -এর অধীন পারিবারিক আদালতের দ্বারস্থ হয়ে কিছু সুনির্দিষ্ট কারণে বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন করতে পারেন, আদালত উপযুক্ত মনে করলে বিচ্ছেদের আদেশ দেন। এভাবে বাংলাদেশেও ‘বিচারিক প্রক্রিয়ায় বিবাহ বিচ্ছেদ’ পদ্ধতি চালু করতে পারলেই বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে যোক্তিকও ন্যায়ানুগ সিদ্ধান্ত গ্রহণেরদ্বার উন্মোচিত হবে। সেই সাথে টিকে থাকবে পারিবারিক বন্ধন, বজায় থাকবে সামাজিক স্থিতিশীলতা, সন্তানরা হারাবে না শান্তির নীড়, স্বজনরা হারাবে না সম্প্রীতি।
লেখক: শিক্ষক, আইন বিভাগ, বাংলাদেশ আর্মি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, কুমিল্লা।