তিতাস কান্তি পণ্ডিত:
করোনা পরিস্থিতি, ভার্চুয়াল কোর্ট ও আমাদের ভবিষ্যৎগোটা বিশ্ব যেখানে জ্ঞান, বিজ্ঞান, দক্ষতা ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রায় রকেটের বেগে এগুচ্ছিল সেখানে আমরা গুটি গুটি পায়ে হাটছিলাম। এমনিতেও আমরা প্রথম বিশ্বের দেশগুলো থেকে সব দিক দিয়ে প্রায় ২০-৩০ বছর পিছিয়ে আছি। মানে তারা যেসব উন্নত ফ্যাসন, দক্ষতা, উৎকর্ষতা, প্রযুক্তি ইত্যাদি বাস্তবিক প্রয়োজনে উদ্ভাবন করে ও সেসব ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে পরবর্তী ধাপে যাওয়ার প্রস্তুতিতে থাকে, তার প্রায় ২০-৩০ বছর পর আমাদের দেশে আমরা সেগুলো এডাপ্ট করা শুরু করি। তবে বর্তমান গ্লোবালাইযেসন বা তথ্য প্রযুক্তির যুগে হয়ত বা এই ব্যবধান কিছুটা কমে থাকতে পারে। এই অবস্থায় হঠাৎ করে বিনা নোটিশে কোভিড-১৯ এসে এই পুজিবাদী বিশ্বের উন্নয়নের ঘোড়াটিকে একদম থামিয়ে দিয়েছে। সব মহাপরিকল্পনা গুবলেট করে দিয়েছে। মানুষ এখন সেই আদিম লড়াই অর্থাৎ বেচে থাকার বা টিকে থাকার লড়াই এ ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছে।
স্বাভাবিক অবস্থাতেও ভবিষ্যৎ বিশ্ব টেকনোলজি নির্ভর ছিল আর এখন এই করোনা পরিস্থিতিতে ভবিষ্যৎ বিশ্ব আরো বেশি টেকনোলজি নির্ভর হতে যাচ্ছে। এমনকি করোনা যদি হঠাৎ করে দুনিয়া থেকে নাই হয়ে যায় তারপরও মানুষের এই টেকনোলজি নির্ভরতা কমবে না বরং বাড়বে। বাংলাদেশ সরকার তাই এর গুরুত্ব অনুভব করে ডিজিটাল বাংলাদেশের ঘোষণা আরো আগেই দিয়েছিল। যার ফলশ্রুতিতে আমাদের অর্থনীতি ও সমাজ ব্যবস্থায় ডিজিটাইলেজেসন বা প্রযুক্তি নির্ভরতার ছোয়া লেগেছে মাত্র। এর মধ্যে আমাদের হাজারো সমস্যার মধ্যে এসে হাজির হয়েছে নতুন বৈশ্বিক সমস্যা, করোনা মহামারি। এ অবস্থায় আমাদের টেকিনোলজি নির্ভর হওয়া বা এসব দক্ষতার দিকে জাতিগতভাবে ফোকাস করা ছাড়া আর কোন উপায় নাই। আমরা যদি প্রয়োজনীয়তার সাথে তাল মিলিয়ে নিজেদের পরিবর্তন করতে না পারি তবে প্রথম বিশ্বের সাথে ব্যবধান আরো অনেক বেশি বেড়ে যাবে, যা আমাদের জন্য করোনা পরবর্তী ভবিষ্যৎ বিশ্বের আর্থ সামাজিক বাস্তবতায় সারভাইব করতে হুমকি হয়ে দাড়াবে। করোনা পরবর্তী অবস্থায় বিশ্বব্যাপী অনেক দক্ষতা নির্ভর কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে কিন্তু আমরা দক্ষতার অভাবে বেকার বসে থাকব, মার্কেটে বিদ্যমান সুযোগ গ্রহন করতে পারব না। অর্থাৎ অচল পয়সা হয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রের বোঝা হয়ে যাব।
আমাদের আগের থেকেই হাজারো সমস্যা। যেমনঃ ট্রাফিক জ্যাম, ভংগুর চিকিৎসা ব্যবস্থা, রাজধানীতে আবাসিক ও বাণিজ্যিক স্পেসের উচ্চ মূল্য, উচ্চ ব্যয়, অনিয়ন্ত্রিত বাজার, খাদ্যে ভেজাল, গোটা দেশের সব খাতে উচ্চ রাজধানী নির্ভরতা, দীর্ঘ মামলাজট ইত্যাদি। করোনার স্থবিরতায় এসব সমস্যা এখন নিয়ন্ত্রণের প্রায় বাহিরে চলে যাচ্ছে। এ অবস্থায় সরকার ও উচ্চ আদালত প্রায় নিরুপায় হয়ে, বিচার ব্যবস্থা স্বাভাবিক রাখতে আপদকালীন ব্যবস্থা হিসেবে আমাদের বৃটিশ আমলের আইন ব্যবস্থায় ভার্চুয়াল কোর্ট চালু করেছে। বৃটিশ আমলের একটি ব্যবস্থা যার এই ২০২০ সালে এসেও তেমন একটা বাস্তবিক উন্নয়ন ঘটেনি, এমন ব্যবস্থাকে রাতারাতি পরিবর্তন করে নিখুত ডিজিটাল সার্ভিস নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। শুরুতে সমস্যা থাকবে ৯৯ শতাংশ। কারন আমাদের এই বিষয়ে দক্ষ জনবল নেই, দেশের বেশিরভাগ আইনজীবীরা প্রযুক্তির ব্যবহারে অভ্যস্ত নয়, দেশের সব প্রান্তে ইন্টারনেট ও বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা খুব একটা ভাল নয় প্রভৃতি। তারপরও আমাদের এই ভার্চুয়াল কোর্ট ব্যবস্থাকে স্বাগত জানানো উচিৎ। সমস্যার ভেতর দিয়ে যেতে যেতে নিজেদের আপডেট করে আমরা যদি এর সাথে খাপ খাইয়ে এই ব্যবস্থাটাকে একটা শক্তিশালী কার্যকর ব্যবস্থায় পরিণত করতে পারি তাহলে বিচার প্রার্থী, আইনজীবী, বিচারকসহ সবার জন্যই এটা কল্যাণকর হবে। আর ভার্চুয়াল কোর্টকে আমি আপদকালীন ব্যবস্থা হিসাবে দেখছি না বরং এটাই ভবিতব্য। সত্যিকার অর্থে আজ হোক বা কাল হোক, আমরা চাই বা না চাই, এই ব্যবস্থায় আমাদের যেতেই হবে এবং সেটা এই স্বল্প পরিসরে নয়, সমগ্র বিচার ব্যবস্থা ডিজিটাইলেজেসনের আওতায় আসবে। কারন নেসেসিটি ইজ দ্যা মাদার অব ইনভেনসন এন্ড নেসেসিটি নোওজ নো ল’।
দুঃখজনক হলো আমাদের আইনজীবী সমাজের কিছু কিছু অংশ বাস্তবতা না বুঝে তাদের অজ্ঞতার জন্য এই ভার্চুয়াল কোর্ট ব্যবস্থার বিরোধিতা করছে। আমার মনে হয় এদের একটি অংশ প্রযুক্তির ব্যবহারে অজ্ঞ হওয়ায় মানষিক নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। আরেকটি অংশ যারা পড়াশোনাবাদ দিয়ে সিন্ডিকেট নির্ভর আইনব্যবসা করে আসছিলেন তারাও মানষিক নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন, যে তাদের এতদিনের গড়া সিন্ডিকেট ও কুক্ষিগত ক্ষমতা ভেস্তে যাবে ভেবে। কিছু আইনজীবী সেফটি কনসার্ন। তাদের যুক্তি বিচারকরা নিরাপদে থাকলেও আইনজীবীদের অকালতনামা, বেইলবন্ড ইত্যাদি আনতে তো বাহিরে যেতেই হচ্ছে। যুক্তি ঠিক আছে কিন্তু এর জন্য তো ভার্চুয়াল কোর্টের বিরোধিতা করার কিছু নেই। বরং আইনজীবীরা সংশ্লিষ্ট আইনজীবী সমিতিকে তাদের ওয়েবসাইট আধুনিক করে ডিজিটাল অকালতনামা সহ প্রয়োজনীয় কাগজাদি ডিজিটাল পেমেন্টের মাধ্যমে সরবরাহের ব্যবস্থা করে এসব ডিজিটাল কাগজ যেন কোর্টে গৃহীত হয় তার ব্যবস্থা করার জন্য সুপারিশ করতে পারে। আইনজীবীদের আরেকটি অংশ আছে যাদের তেমন ক্রিমিনাল/জামিন এর প্র্যাকটিস নেই। তারা এই ভার্চুয়াল ব্যবস্থায় বৈষম্যের স্বীকার হবেন ভাবছেন এবং এই শ্রেণীর আইনজীবীদের সংখ্যাই বেশি। এই করোনা পরিস্থিতিতে আগামী ১-২ বছরের জন্য জামিন/জরুরী ক্রিমিনাল ম্যাটার ছাড়া অন্যসব সাধারন ম্যাটারগুলার বাজার মন্দা থাকবে। তাই বলে বৈষম্য ঠেকাতে যেয়ে তো জরুরী বিচারপ্রার্থীদের বঞ্চিত করা চলে না। আর ভার্চুয়াল হোক বা প্রচলিত কোর্ট হোক, চালু হয়ে গেলেও করোনা পরবর্তী অর্থনৈতিক অবস্থায় একদম জরুরী বিষয় ছাড়া কোন বিষয়ে মানুষজন মামলা-মোকদ্দমা করতে আসবে না। কারন মানুষের পকেটে তখন স্বাভাবিক জীবন যাপনের খরচেরই ঘাটতি থাকবে। এই অবস্থায় সব আইনজীবী জামিন/ক্রিমিনাল মামলায় ঝাপিয়ে পড়লেও ম্যাটারের চেয়ে আইনজীবী বেশি হয়ে যাবে।
এই শ্রেণীর আইনজীবীরা আমার দেখা মতে মেধাবী হয়। তাই এই অবস্থায় টিকতে হলে তাদের মেধার চর্চা করে বিকল্প পথ খুজে নিতে হবে। একটা ক্রাইসিস শত শত প্রচলিত পথ/সুযোগ বন্ধ করে দিলেও হাজার হাজার নতুন পথ/সুযোগের সৃষ্টি করে থাকে। আমাদের সেই নতুন পথ/সুযোগ খুজে নিয়ে সেটা গ্রহন করার মত মুক্ত মানষিক অবস্থায় থাকতে হবে।
করোনা যেমন আমাদের সামনে বড় এক ক্রাইসিস ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে এসেছে তেমনি একইসাথে অনেক সুযোগের দ্বারও উন্মুক্ত করেছে। গোটা বিশ্বের অর্থনীতি, উন্নয়ন এখন স্থবির৷ এই অবস্থায় প্রথমত আমাদের বাচতে হবে। তারপর টিকে থাকার জন্য আমরা যদি প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করে নিজেদেরকে প্রযুক্তি নির্ভর টেকসই অবস্থায় নিতে পারি তবে উন্নত বিশ্বের সাথে ব্যবধান অনেকাংশে কমে আসবে। আমাদের আরও বেশি প্রযুক্তি নির্ভর টেকসই ই-কমার্স ব্যবস্থায় যেতে হবে। ভার্চুয়াল কোর্ট একটা আনকোরা শুরুমাত্র। এটা দিয়ে তেমন কিছু হবে না। গোটা বিচার ব্যবস্থা টেকসই ডিজিটাইলেসনের আওতায় আসতে হবে। প্রচলিত বিচার ব্যবস্থার সাথে সমন্বয় করে ডিজিটাল ব্যবস্থা এমনভাবে ডেভেলপ করতে হবে যেন বিচার ব্যবস্থার অপ্রত্যাশিত ত্রুটিগুলো কমে আসে এবং বিচার প্রার্থীদের বিচার পাবার প্রক্রিয়া আরও সহজ ও স্বচ্ছ হয়। একবিংশ শতাব্দীতে এসে মামলার কোন পক্ষকে শুধু হাজিরা দেবার জন্য ৩-৪ ঘন্টার জ্যাম ঠেলে কোর্টে আসার অথবা পঞ্চগড় বা টেকনাফ থেকে শুধু একটা এফিডেভিটে সহি করার জন্য তো ঢাকায় হাইকোর্টে আসার প্রয়োজন নেই। বিকল্প ডিজিটাল ব্যবস্থা চাইলেই গড়ে তোলা যায়। সিভিল মামলার আদালতের সমন ব্যবস্থাও এই একবিংশ শতাব্দিতে এসে বৃটিশ আমলীয় ব্যবস্থায় চলছে যেটা শুধু হাস্যকরই নয়, বিচারপ্রার্থীদের সাথে রাষ্ট্রিয়ভাবে ক্রাইম করা হচ্ছে বলে আমার মনে হয়। একটা সিভিল মামলায় পক্ষগনের প্রতি সমন জারী হয়ে মামলাটির বিচারকাজ শুরু হতেই ৪-৫ বছর লেগে যায় এমনসব অগণিত নজির আমাদের দেশে রয়েছে। একটা সিভিল মামলায় একজন আইনজীবী বাদীর সমগ্র ঘটনার উল্লেখ করে প্রায় ১২-৩০ পাতার এক আরজি দাখিল করে কোর্টে মামলা দায়ের করেন। তারপর বাদীর সাক্ষী শুরু হলে সেই ১২-৩০ পাতার গদ, বাদী কোর্টে এসে আইনজীবীরা সহযোগীতায় মৌখিভাবে উপস্থাপন করে, আর জজ সাহেব তা লিখেন। আর এই গোটা প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে বিভিন্ন তারিখ পরতে পরতে কমপক্ষে ১-২ বছর চলে যায়। তারপর শুরু হয় বিবাদী পক্ষের জেরা। যেখানে বাদী তার বক্তব্য আইনজীবীর মাধ্যমে লিখিত আকারে কাগজপত্রসহ হলফ করে বা সত্যপাঠ দিয়ে আদালতে দাখিল করে সেখানে একই জিনিস ১-২ বছর ব্যয় করে জজ সাহেবকে দিয়ে লিখিয়ে নেয়া বৃটিশ আমলের জন্য ঠিক হলেও এই একবিংশ শতব্দীতে এসে বিচারপ্রার্থীদের প্রতি রীতিমত ক্রাইম করা হয়। চাইলেই সাক্ষ্য আইন আপডেট করা যায়। কিন্তু বিচারপ্রার্থীদের নিয়ে ভাববার কেউ নেই। এই করোনা এমন অনেক বিষয় নিয়ে আমাদের ভাবতে সময় করে দিয়েছে। কিন্তু আমরা তো আমাদের কমফোর্ট জোনে থাকতে অভ্যস্ত হয়ে আছি। আমরা ইনোভেসন চাই না, পরিবর্তন চাই না। চাই শুধু পুরোনো অভ্যস্ত ব্যবস্থায় চেয়ার গরম করে অন্যের হক মেরে খেতে। তাই প্রকৃতি সব কিছুর নিয়ন্ত্রণ এখন নিজ হাতে নিয়ে নিয়েছে। এই করোনা পরিস্থিতিতে যারা তাদের কমফোর্ট জোন থেকে বের হতে পারবে না, মেধার চর্চা করবে না, পরিবর্তনকে মেনে নিতে পারবে না, ইগো নিয়ে পরে থাকবে তাদের ধ্বংস অনিবার্য।
পরিশেষে কবির ভাষায় বলতে চাই, দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা, শুধিতে হইবে ঋণ। বৃটিশ আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা ধরে রেখে আমরা দীর্ঘদিন মানুষকে ঠকিয়ে সরকারী চেয়ার গরম করে তৃপ্তির ঢেকুর গিলেছি। এখন কাজ করার পালা। মানুষ যে মানুষের জন্য সেটা উপলব্ধি করবার পালা। তাই সবাই মিলে আমাদের, ইতিবাচক পরিবর্তনকে আলিংগন করে একে অপরকে সহযোগীতা করে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার মহাসুযোগকে লুফে নিতে হবে। সরকারী বেসরকারী প্রতিটি সেক্টরে আমূল পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুতি ও উদ্যোগ নিতে হবে। নিজেদেরকেও যতটা পারা যায় প্রযুক্তির সাথে খাপ খাইয়ে নিতে হবে।
লেখক- আইনজীবী, ঢাকা জজ কোর্ট, ঢাকা।