আইনুল ইসলাম বিশাল:
বেশ কিছুদিন যাবৎ আইনজীবী সুরক্ষা আইন প্রণয়নের জন্য আইনজীবী ও শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের একটি বড় অংশ লেখালেখি করে আসছে এবং বিভিন্ন আলোচনায় বিষয়টি তুলে ধরছে। সময় যতই গড়িয়ে যাচ্ছে এই দাবির প্রতি আইনজীবী ও শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের সমর্থনও বাড়ছে আর সমসাময়িক সময়ে আইনজীবী ও শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের প্রতি পুলিশ ও মোবাইল কোর্টের বিচ্ছিন্ন কয়েকটি বিরূপ আচরণ, বেশ কিছু সন্ত্রাসী হামলা এবং রাজনৈতিক মামলা দিয়ে হয়রানি করার ঘটনা আইনজীবী সুরক্ষা আইন প্রণয়নের দাবিকে আরো যৌক্তিক করে তুলছে।
আইনজীবীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ও বিচার বিভাগের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখার স্বার্থেই আইনজীবী সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২২ এ নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথকের কথা বলা হলেও, তা মূলত কার্যকর হয় অর্থাৎ, বাংলাদেশের বিচার বিভাগ আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন হয় বা নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক হয় ১লা নভেম্বর ২০০৭ সালে ” মাজদার হোসেন বনাম বাংলাদেশ মামলার রায় কার্যকরের মধ্য দিয়ে। বিচার বিভাগ বলতে কেবলমাত্র বিচারকদেরই বুঝায় না বরং বিচারক ও আইনজীবী উভয় নিয়েই বিচার বিভাগ। দুঃখজনক হলেও সত্য এই যে, উক্ত মামলার রায়ে বিচারকদের বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করা হলেও আইনজীবীদের অবস্থান ও সুরক্ষার বিষয়ে কিছুই বলা হয়নি।
সম্ভবত তখন আইনজীবীদের সুরক্ষার গুরুত্ব উক্ত মামলার আইনজীবীরা উপলব্ধি করতে পারেননি। তবে বিচার বিভাগে আইনজীবীরা যে একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ তা, 30BLD (AD)01 রিপোর্টেড মামলার “A lawyer is an equal partner with the judge in the administration of justice” এই বক্তব্যর মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে যায়। বিচারকদের ন্যায় যদি আইনজীবীদেরও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায় সেক্ষেত্রে বিচার বিভাগের মর্যাদাও বৃদ্ধি পাবে এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতের বিষয়টিকে জাতিসংঘও বেশ গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করে। ২০১২ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে “The indemnity of the judges and the lawyers” নামে একটি রেজ্যলুশন গৃহীত হয়। যেখানে বিচারক ও আইনজীবী উভয়ের স্বাধীনতার কথায় বলা হয়। বিচারক ও আইনজীবীর স্বাধীনতা মানে হচ্ছে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা। আর বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য প্রয়োজন বিচারক ও আইনজীবীদের নিরাপত্তা বা সুরক্ষা। এজন্য প্রয়োজন আইনজীবী সুরক্ষা আইন, আমরা দেখতে পাই “ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮” এর ১৯৭(১) ধারায় ইতিমধ্যে সরকারি কর্মচারীদের সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে কোনো জজ অথবা ম্যাজিস্ট্রেট অথবা সরকার ব্যতীত অপসারণযোগ্য নয় এমন সরকারী কর্মচারীর বিরুদ্ধে সরকারের পূর্বানুমতি ব্যতীত কোন আদালত অভিযোগ আমলে নিবেন না। অর্থাৎ, সরকারী চাকুরিজীবীরা দায়িত্ব পালনের সময় অপরাধ করলে মামলা করার জন্য সরকারের পূর্বানুমতি প্রয়োজন। এছাড়াও ২০১৮ সালে প্রণীত “সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮” এর ৪১(১) ধারায় বলা হয়েছে, অভিযোগ পত্র দাখিলের পূর্বে কোনো সরকারি কর্মচারীকে গ্রেফতার করতে হলে, সরকার বা নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমতি নিতে হবে। উক্ত আইন দুইটিতে সরকারি কর্মচারীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা হয়েছে। বাংলাদেশে বলবৎ এই দুইটি আইনের মাধ্যমে এই বিষয়টিও স্পষ্ট যে সুরক্ষা আইনের বিষয়টি আমাদের দেশের জন্য নতুন কোনো বিষয়ও নয়।
আইনজীবীরা সরকারি কর্মচারী না হলেও বিচার বিভাগের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বাংলাদেশে বর্তমানে বলবৎ আইন, সংবিধান, জাতিসংঘের রেজ্যলুশন, উচ্চ আদালতের বক্তব্য কোনো কিছুই আইনজীবী সুরক্ষা আইন প্রণয়নের অন্তরায় নয়। বরং উপরে উল্লেখিত সকল বিষয় আইনজীবী সুরক্ষা আইন প্রণয়নের পক্ষে। একজন আইনজীবী শুধুমাত্র বিচার বিভাগের অবিচ্ছেদ্য অংশই নই, একজন আইনজীবীর মাধ্যমেই একজন বিচারপ্রার্থী ন্যায় বিচার পেয়ে থাকে এবং সমাজ ও রাষ্ট্রে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হয়। সেই দিক বিবেচনায়ও একজন আইনজীবীর সুরক্ষা নিশ্চিত করার বিকল্প কিছু নেই।এছাড়াও সাম্প্রতিক সময়ে আইনজীবীদের উপরে বিভিন্ন হামলা – মামলা এটাও প্রমাণ করে যে বিচার বিভাগের সুরক্ষার জন্যই আইনজীবী সুরক্ষা আইন প্রয়োজন।
আইনুল ইসলাম বিশাল: শিক্ষানবিশ আইনজীবী, ঢাকা আইনজীবী সমিতি