জহিরুল ইসলাম মুসা:
দেশের কয়েকটি জেলায় চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট অফিস আদেশ জারি করে এন.আই. এ্যাক্ট এর ১৩৮ ধারার মামলার ক্ষেত্রে যাতে তামাদি না হয় সে কারণে ন্যায় বিচারের স্বার্থে ফাইলিং কঠোরভাবে সামাজিক দূরত্ব পালন করে গ্রহণ করে রেজিস্ট্রিভুক্ত করতে নির্দেশ দিয়েছেন।
ঢাকার পাশ্ববর্তী একটি জেলায় সিজেএম স্বাক্ষরিত এমন একটি আদেশ ০৩.০৬.২০২০ তারিখ জারি করা হয়েছে এবং আদেশটি জারির দিন থেকেই কার্যকারিতা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
আমরা বিশ্লেষণ করে দেখবো, সিজেএম স্বাক্ষরিত এই অফিস আদেশটি যথাযথ আইনানুগ ভিত্তির ওপর দাড়িয়ে আছে কি না, আদেশটির কার্যকারিতা কতটুকু, বাস্তবায়িত হলে দেশ্যব্যপী প্যানিক সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা আছে কি না, সর্বোপরি একটা বিশেষ আইনের তামাদির বিষয়ে তিনি অফিস আদেশ জারি করার ক্ষমতা রাখেন কি না।
প্রথমত:
১০ মে ২০২০ তারিখে রেজিস্ট্রার জেনারেল স্বাক্ষরিত বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের ২১৪ নং বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে অধস্তন আদালত এবং ট্রাইবুনালে শুধুমাত্র জামিন সংক্রান্ত বিষয়সমুহ তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভার্চুয়াল শুনানীর মাধ্যমে নিষ্পত্তি করণ বিষয়ে অনুসরণীয় “বিশেষ প্রাকটিস নির্দেশনা” জারি করা হয়। হাইকোর্ট বিভাগের সম্মতিক্রমে প্রাকটিস নির্দেশনাটি জারি করেন বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি। যার লক্ষ্য ছিল, ‘সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা নিশ্চিতকরণ’ ও ‘শারীরিক উপস্থিতি ব্যতিরেকে’ বিচারকার্য পরিচালনা করা। এছাড়া পুরোটাই ভার্চুয়ালি হওয়ার কথা বলা হয়েছে। ৩০ মে ২০২০ তারিখে জারিকৃত ২৩০ নং বিজ্ঞপ্তি পূর্বের জারিকৃত ২১৪ নং বিজ্ঞপ্তির ধারাবাহিকতা, যার মাধ্যমে অতিরিক্ত ৩টি বিশেষ প্রাকটিস নির্দেশনা জারি করা হয়। অন্তর্ভুক্ত করা হয় ‘প্রযোজ্য ক্ষেত্রে অতীত জরুরি বিষয়সমুহ”, ঝুঁকিপূর্ণ ও অসুস্থদের কর্মস্থলে উপস্থিতি থেকে বিরত রাখা হয় এবং ১৫ জুন ২০২০ পর্যন্ত নির্দেশনার কার্যকারিতা দেওয়া হয়।
বর্তমানে অধস্তন আদালত এই বিশেষ প্রাকটিস নির্দেশনা’র ভিত্তিতেইতথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে শুধুমাত্র ভার্চুয়ালি পরিচালিত হচ্ছে। সেকারণ অধস্তন আদালতের এর বাইরে যাওয়ার কোন কোন সুযোগ নাই। সংশ্লিষ্ট জেলার সিজেএম জারিকৃত অফিস আদেশটি যথাযথ আইনানুগ ভিত্তির ওপর দাড়িয়ে নেই, বরং এটি সুপ্রীম কোর্ট কর্তৃক জারিকৃত বিজ্ঞপ্তির লঙ্ঘন। সুপ্রীম কোর্টের নির্দেশনা ভঙ্গ করে মামলা দায়েরের জন্য শারীরিক উপস্থিতির আদেশ তিনি দিতে পারেন না। আমাদের মনে রাখতে হবে, অধস্তন আদালতকে শুধুমাত্র ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে পরিচালনার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
দ্বিতীয়ত:
অফিস আদেশটিতে এন আই এ্যাক্টের মামলা ফাইলিং যাতে তামাদিতে আটকে না যায়, সেজন্য “ন্যায় বিচারের স্বার্থে” “কঠোরভাবে সামাজিক দূরত্ব পালন করিয়া গ্রহণ পূর্বক রেজিস্ট্রি ভুক্ত” করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আমরা জানি, ইতোমধ্যে ফাইলিং এর সময় অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়া এন.আই এ্যাক্টের মামলাগুলো তামাদি এড়াতে অবশ্যই ফাইল করতে হবে আদালত ওপেন হওয়ার প্রথম দিনে, অবশ্যই প্রথম দিনে, দ্বিতীয়-তৃতীয় দিনে যাওয়ার আইনগত সুযোগ নাই। সুপ্রীম কোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী ৩১ মে ২০২০ তারিখকে যদি আমরা আদালত ওপেন হওয়ার প্রথম দিন ধরে নেই, তাহলে তামাদি ইতোমধ্যে পার হয়ে গেছে। বিশেষ আইনের এই তামাদিকে বর্ধিত করার কোন অথোরিটি সিজেএম-এর নাই।
তৃতীয়ত:
অফিস আদেশটি কার্যকারিতা দেওয়া হয়েছে অদ্য ০৩.০৬.২০২০ থেকে। সে হিসাবে, যদি আজকের দিনকে “আদালত ওপেন হওয়ার প্রথম দিন” ধরে নেই তাহলেও আজকে তামাদি শেষ। কালকে মামলা দায়ের কোন আইনগত সুযোগ নাই।
চতুর্থত:
এই আদেশ প্রতিপালিত হলে, সংশ্লিষ্ট জেলাগুলোর জন্য এন.আই এ্যাক্টের তামাদি যে তারিখে শেষ হবে, ঢাকার জন্য বা অন্যান্য জেলার জন্য সে তারিখে শেষ হচ্ছে না। সেই জেলায় যেদিন “আদালত ওপেন হওয়ার প্রথম দিন” ঢাকা ও অন্যান্য জেলার জন্য “আদালত ওপেন হওয়ার প্রথম দিন” অন্য তারিখ, অথচ দেশের সকল অধস্তন আদালত সুপ্রীম কোর্টের একই নির্দেশনার আলোকে পরিচালিত হচ্ছে।
পঞ্চমত:
করোনা ভাইরাসের কারণে আদালত বন্ধ হওয়ার পর “আদালত ওপেন হওয়ার প্রথম দিন” কোনটি সেই ব্যাখ্যা অবশ্যই বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টকে দিতে হবে। বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টকে পরিস্কার করতে হবে এন.আই. এ্যাক্টের ১৩৮ ধারার তামাদির জন্য অফিসিয়ালি “আদালত ওপেন হওয়ার প্রথম দিন” কোন তারিখটি। আদতে, এই আইনগত শূণ্যতা তৈরি হওয়ার ফলে একেক জেলা একেকভাবে চিন্তা করার সুযোগ পাচ্ছে এবং সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, বা নিতে উদ্যত হচ্ছে।
ষষ্ঠত:
এই আইনগত শূণ্যতার জন্য দায়ী পার্লামেন্ট। আমরা সহজ কথায় একে “পার্লামেন্ট’স ফেইলর টু রেসপন্ড ইন ক্রাইসিস” বলতে পারি। আর “আদালত কর্তৃক তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার অধ্যাদেশ, ২০২০” খুবই অদুরদর্শী, অসম্পূর্ণ, যেখানে বেশিরভাগ বিষয় অস্পষ্ট। সেখানে ট্রায়াল, ইনকোয়ারি, এভিডেন্স গ্রহণ, অর্ডার পাস করা, আর্গুমেন্ট শোনা বা রায় প্রদানের বিষয় থাকলেও ফাইলিং বিষয়ে আলাদা পষ্ট কিছুই নাই।
উদ্ভুত পরিস্থিতির মোকাবেলায় নতুন বিশেষ আইন তৈরি করে ক্রান্তিকালীন এই সময়ের জন্য ফাইলিং এর তামাদি বর্ধিত করে প্রচলিত সকল আইনের ওপর প্রাধান্য দিতে হবে। অথবা সংশ্লিষ্ট প্রতিটি আইন সংশোধন করে তামাদি বর্ধিত করতে হবে। এই দুইটি বিষয়ের কিছুই পার্লামেন্ট করে নাই। সব মিলিয়ে এসব কারণে তৈরি হয়েছে legal chaos।
কোন অধস্তন আদালতের উচিত হবে না এরকম স্পর্শকাতর বিষয়ে আইনগত ব্যাখ্যা দেওয়া বা এই legal chaos এর মাঝে এমন কোন কাজ করা যা সরাসরি সুপ্রীম কোর্ট দ্বারা নির্দেশিত হয় নাই।
জহিরুল ইসলাম মুসা: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট
zahirulmusa@gmail.com