মোঃ জাহিদ হোসেন :
“Ignorance of law is no excuse” আইন শাস্ত্রের এই প্রবাদ বাক্যটি শত শত বছর ধরে দেশে দেশে তথা সারা বিশ্বে এক চিরন্তন সত্য বাক্যে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। বাংলায় এই বাক্যটির অর্থ দাঁড়ায় আইনের অজ্ঞতা ক্ষমার অযোগ্য কিংবা আইনের অজ্ঞতা ক্ষমার কোন কারণ হতে পারে না। অর্থাৎ রাষ্ট্র ধরে নিবে যে তার নাগরিকরা রাষ্ট্রে প্রচলিত সকল আইনের বিধি-বিধান সম্পর্কে জানেন। তাই যদিও বাস্তবে আপনি সংশ্লিষ্ট আইন সম্পর্কে না জেনে উক্ত আইনটির কোন বিধি-বিধান লঙ্গন করেন আর পরে যদি আপনি সংশ্লিষ্ট আইনটি সম্পর্কে জানেন না বলে কোন অজুহাত দেখান; তবুও তা রাষ্ট্রের কাছে তা কোন ভাবেই গ্রহণযোগ্য হবে না। ফলে আপনাকে প্রচলিত আইন ভঙ্গ করার কারণে শাস্তি পেতে হবে।
জনসাধারণের আইন জানার প্রয়োজনীয়তা জানার আগে আইন কি তা আমাদের জানা প্রয়োজন। আধুনিক কালে আইন বলতে বুঝায় বিভিন্ন নিয়ম কানুনের সমষ্টি যা মানুষের আচার আচরন নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশে রাষ্ট্র কর্তৃক প্রণয়ন করা হয়ে থাকে। আরো সহজভাবে বললে- আইন কোন কাজটি অপরাধ আর কোন কাজটি অপরাধ না তা খুঁজে বের করে এবং কৃত অপরাধের জন্য শাস্তির বিধান রাখে যাতে করে মানুষ অপরাধ না করে। অর্থাৎ আইন তৈরীর মূল উদ্দেশ্যই হল মানুষকে অপরাধ বিষয়ে সচেতন করা এবং জনগণকে অপরাধ থেকে দূরে রাখা।
কেউ যদি ইচ্ছা করে আইন না মানে তবে রাষ্ট্র আইন মান্য করার জন্য শক্তি প্রয়োগ করে থাকে। অর্থাৎ আইন ভঙ্গ করলে শাস্তি দেয়। তবে একেক দেশের আইন ও আইন ব্যবস্থা একেক রকম হতে পারে। কোন বিষয়ে উপর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা অভিজ্ঞ হবেন এটাই স্বাভাবিক। যেমন ডাক্তার চিকিৎসা বিষয়ে অভিজ্ঞ, আইনজীবী আইন বিষয়ে অভিজ্ঞ, সাহিত্যিক সাহিত্য বিষয়ে জানবেন ইত্যাদি। তবে সব মানুষের সকল বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান রাখা সম্ভব নয়। কিন্তু অন্যান্য বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান না রাখলেও আপনাকে দৈনন্দিন সাধারণ আইন বিষয়ে জানা আবশ্যক।
আমাদের দেশে সর্বোচ্চ আইন হল সংবিধান। আর সংবিধানের প্রস্তাবনার ৪র্থ অংশে একে রক্ষার, সমর্থনের ও নিরাপত্তা বিধানের একটি দায়িত্ব দেশের জনগণের হাতে অর্পণ করা হয়েছে। যা থেকে বুঝা যায় জনসাধারণের আইন-কানুন জানার প্রয়োজনীয়তা কতটুকু। কিন্তু বাস্তবে আমাদের দেশের মানুষের আইন সম্পর্কে জানার তেমন কোন আগ্রহ নেই। অথচ আইনের অজ্ঞতার কারণে সাধারণ মানুষই বেশি বিপদে পড়ে। নির্যাতিত ও প্রতারিত হয় সমাজের প্রভাবশালীদের কাছ থেকে।
আইনের অনুপস্থিতিতে কখনো অপরাধ দমন সম্ভব নয়। একমাত্র আইন অনুযায়ী শাস্তি প্রয়োগের ভয় দেখিয়ে অপরাধ প্রবণদের অপরাধ থেকে দূরে রাখা যায়। ফলে অন্যান্যরা ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পায়। একজন মানুষ যদি প্রতিদিনের আইন সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান না রাখে তবে সমাজে সে তাঁর অবস্থান সম্পর্কেও ধারণা লাভ করতে পারে না। এই সুযোগে অন্যান্যরা তাঁর অধিকার লঙ্ঘন করতে পারে যেকোন সময়। এমন কি আইন না জানার কারণে সে কোন বিষয়ে প্রতিকার পাওয়া যাবে এবং কিভাবে প্রতিকার পাওয়া যাবে তাও উপলব্ধি করতে পারেনা।
আইন না জানার কারণে কেউ কাউকে কোন বিষয়ে ভুল পরামর্শ দিয়ে ভুল পথে পরিচালিত করতে পারে। যার কারণে পরবর্তীতে ঐ ভুলের কারণে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি অপরাধী হয়ে সাজাও ভোগ করতে পারে। উদাহরণ সরূপ বলা যায়- কোন নাগরিক যদি না জানে যে রাষ্ট্রের কাছ থেকে সে কী কী সুযোগ সুবিধা পাওয়ার অধিকারী; তাহলে সে তা দাবি করবে কিভাবে? শাসক শ্রেণী মূলতঃ আইন দিয়েই আমাদের বেশি শোষণ করে থাকে। আর আমরা এই অধ্যায় থেকে বের হতে চাই। তখন জানতে হবে কি আমার আইন, কি আমার অধিকার। প্রয়োজনে শাসককেও তখন চ্যালেঞ্জ করা যাবে। রাষ্ট্রের সাথে ব্যক্তির কি সম্পর্ক অথবা ব্যক্তির সাথে ব্যক্তির কি সম্পর্ক তাও আর অজ্ঞাত থাকবে না। অপরদিকে আইন সম্পর্কে ধারণা না থাকার কারণে একজন নাগরিকের রাষ্ট্রের প্রতি কী কী দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে তাও সে বুঝতে পারে না।
যেমন মামলা-মোকদ্দমার ক্ষেত্রে আমাদের দেশে গরীব ও দুঃস্থ মানুষরা যাতে আইনি সহায়তা পেতে পারে তার জন্য সরকারীভাবে ‘লিগাল এইড’ এর ব্যবস্থা রয়েছে। তাঁরা সরকারের কাছে আবেদন করলে বিভিন্ন মামালায় আইনি সুবিধা পাবেন। কিন্তু এই ক্ষেত্রে সচেতনতার অভাবে তাঁরা তাদের ন্যায্য সুবিধা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন। আইন সচেতনতার মাধ্যমে নাগরিকরা জানতে পারবে পুলিশ, ডাক্তার, ব্যবসায়ী, মালিক ইত্যাদি ব্যক্তি কর্তৃক হয়রানী এড়াতে প্রতিকার কি? কোথায় পাবে এই প্রতিকার? আর এই ক্ষেত্রে তাঁর কী করনীয় আছে?
তাছাড়া আমরা প্রায় দেখি ‘সচেতনতার অভাব রয়েছে’ ‘কিংবা সচেতনতার প্রয়োজন’ ইত্যাদি কথাগুলো ব্যবহৃত হচ্ছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে। এই সচেতনতা অনেক রকমের হতে পারে। তাঁর মধ্যে আমাদের সমাজে যে সচেতনতার অভাবে সাধারণ মানুষ সব চেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়ে তা হল আইনি সচেতনতার অভাব। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় সংশ্লিষ্ট সমস্যার কোন প্রতিকার আছে কিনা, তা কোন না কোন ভাবে বিভিন্ন আইন ও বিধি-বিধানের উপর নির্ভরশীল। তাই আপনি আইন জানলে প্রতারিত হবেন না বা ঠকবেন না।
আবার সংঘটিত অপরাধের বিরুদ্ধে অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমরা আইনের আশ্রয় নিতে চাই না থানা কোর্টের হয়রানী হবে বলে। যার কারণে আমরা এর প্রতিকারও কখনো পাই না। অপরদিকে সমাজে অপরাধের মাত্রা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এইসব ক্ষেত্রে আইন সচেতনতা মানুষকে আইনি পদক্ষেপ নিতে উৎসাহিত করবে।
যাহোক, আমাদের দেশে বেশির ভাগ মানুষ আইন সম্পর্কে জানে না। আইন সম্পর্কে জানার আগ্রহও নেই অনেকের। মনে করা হয় আইন, বিচার, অপরাধ, শাস্তি এসব শুধু আইনের ছাত্র, শিক্ষক ও আইনজীবীদেরই চিন্তা-ভাবনার বিষয়। কিন্তু দেশের সভ্য নাগরিক হিসেবে সবাইকে অবশ্যই দেশের আইন-কানুন মেনে চলতে হয় এবং নিজের প্রয়োজনেই জনগণকে দেশের প্রচলিত আইন সম্পর্কে সচেতন হতে হয়।
সময়ের সাথে সাথে মানুষের জীবন যাত্রা জটিল হওয়ার কারণে অনেক নতুন নতুন আইনের উদ্ভব হচ্ছে। সাধারণ মানুষ ঐসব আইনের আওতায় চলে আসছে এবং তা তাঁদেরকে মানতেও হচ্ছে। কারণ আগেই বলেছি, কেউ আইনের বাহিরে নয় এবং আইনের অজ্ঞতা ক্ষমার যোগ্যও নয়। জনগনের আইন সম্পর্কে জানার অনাগ্রহ সমাজে ভয়াবহ সংকট তৈরী করে। আইন জানার ফলে কেউ কোন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে দূরে থাকতে সচেষ্ট হয়। কখন, কিভাবে দৈনন্দিন আইন সংক্রান্ত কাজগুলো করা যায় তা সহজে অনুধাবন করা যায়। কোন কাজটা বৈধ এবং কোন কাজটা অবৈধ তাও জানা যায়।
আর আমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার পূর্বে অধিকার আদায়ের পন্থা সম্পর্কে অবহিত হওয়া জরুরী। অর্থাৎ প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম পন্থা নীতির মত। এই ক্ষেত্রে শুধু মাত্র অপরাধীকে যেমন শাস্তি দিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়, তেমন আইন সম্পর্কে অজ্ঞতাও সেই শান্তি প্রতিষ্ঠার পথে বাধাস্বরূপ হয়ে দাঁড়ায়।
সর্বশেষে, আইন জানা প্রয়োজন আমার স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের জন্য, আমার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য, হয়রানী ও নির্যাতনের হাত থেকে যথার্থ প্রতিকার পাওয়ার জন্য, আমাদের নাগরিক ক্ষমতা যাচাই ও তা প্রয়োগ করার জন্য।
মোঃ জাহিদ হোসেন : আইনজীবী ও আইন কর্মকর্তা (সিনিয়র অফিসার), অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড