কুমার দেবুল দে :
করোনা পরিস্থিতির চতুর্থ মাস পার করছে বিচারাঙ্গন সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা। করোনা পরিস্থিতির শুরুতে আইনজীবীরা নিজস্ব আইনজীবী সমিতি থেকে সাহায্য প্রত্যাশা করেছিল, আবার অনেকেই সাহায্য প্রার্থনা করেছিলেন আইনজীবীদের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ বার কাউন্সিল থেকে এমনকি আইনজীবীদের জন্য সাহায্য কামনা করা হয়েছিলো মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে। এইভাবে আলোচনা সমালোচনায় আসলো আইনজীবীদের সাহায্য প্রার্থনার বিষয়টি, অনেকে কটু কথাও বলেছেন বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে এইটা নিয়ে, সেই সমালোচনার ভাষা এবং উদ্দেশ্য নিয়েও আইনজীবীদের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়াও হয়।
আইনজীবীদের সাহায্য প্রার্থনার বিষয় নিয়ে একটু পরে আসছি। আগে একটু বলতে চাই আইনজীবীদের সাহায্য চাওয়া নিয়ে কেন সমাজের অন্যান্য ব্যক্তিদের প্রতিক্রিয়া? সাধারণত সমাজের সবাই ধরে নেয় আইনজীবী মানেই আর্থিকভাবে স্বচ্ছল একটা পেশার মানুষ। তাই সমাজের দৃষ্টিতে স্বচ্ছল ব্যক্তিদের সাহায্য চাওয়ার বিষয়টি অনেকের কাছেই স্বভাবত বিরক্তির উদ্রেক করবে এইটাই স্বাভাবিক নয় কি? কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আইনজীবীদের মাঝে স্পষ্টতই কিছু শ্রেণি আছে। একটা শ্রেণি আছে অনেক সিনিয়র, প্রতিষ্ঠিত, অনেক নাম, ডাক, ক্ষমতা আছে আছে আর্থিক বিত্ত বৈভব। আরেকটা শ্রেণি আছে মধ্যম শ্রেণির উপরোক্ত সবগুনেই গুনান্বিত তবে তাও মধ্যম মানের। এদের কারোওরই আর্থিক সাহায্যের প্রয়োজন নেই।
সমস্যা হলো তাদের নিয়ে যাদের ওকালতির বয়স অপেক্ষাকৃত কম, যারা জুনিয়র আইনজীবী হিসেবে খ্যাত, তাদের না আছে বিত্ত, বৈভব, প্রভাব, প্রতিপত্তি আছে শুধু দুচোখে স্বপ্ন, একদিন অনেক বড় হবে, হবে বিত্ত, বৈভব, প্রভাব, প্রতিপত্তি। এদের বিষয়ে সমাজের সাধারণ অংশের কোনো ধারনাই নাই। সমাজ আইনজীবী বলতে বুঝে খ্যাতির সর্বোচ্চ শিখরে অবস্থান করা ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ, ব্যারিস্টার আমীরুল ইসলাম, ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন, এম আমিন উদ্দিন, শ ম রেজাউল করিম প্রমূখদেরকে। কিন্তু একজন জুনিয়র আইনজীবী এবং প্রতিষ্ঠিত আইনজীবীর মাঝখানে আর্থিক বিষয়ে আসমান আর জমিন ফারাক। এইটা সাধারণ জনগণ বুঝেনা।
এই বিষয়ে একটি ছোট্ট গল্পের অবতারণা করছিঃ একদা এক জুনিয়র আইনজীবীর বিয়ের কথা চলছে তাই পাত্রীর বাবা এসেছেন সুপ্রিম কোর্ট বারে পাত্র সম্পর্কে ভালভাবে জানতে। পাত্রীর পিতা পাত্রকে দেখলেন একটা হল রুমে বসে আছেন। তিনি পাত্রের চেম্বার সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বললেন ‘তার কোনো চেম্বার নাই, যেহেতু তিনি নবীন তাই হলরুমে বসেন’। পাত্রীর পিতার পছন্দ হলোনা ব্যাপারটা, তিনি তারপরও পাত্রের গাড়ি আছে কিনা জানতে চাইলে পাত্র জবাব দিলেন তার কোনো গাড়ি নেই শুধু তাই নয় তিনি মেসে থাকেন। এইবার পাত্রীর পিতার থেকে স্পষ্ট “না” এবং তিনি যুক্তি হিসেবে বললেন “আমি আসলে আমার মেয়ের জন্য একজন প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী চাই” বলে বিদায় নিতে চাচ্ছিলেন সেই মুহূর্তে পাত্র বললেন, আমার কাছে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠিত পরিচিত আইনজীবী আছেন এবং চাইলে (পাশের রুমের দিকে ইংগিত করে) দেখে আসতে পারেন। ভদ্রলোক পাত্রের দেখানো রুমে গিয়ে উঁকি মেরে একজন বয়স্ক আইনজীবীকে দেখে পাত্রের কাছে ফেরত আসলেন এবং রাগান্বিত হয়ে বললেন, ‘তুমি আমাকে একজন বুড়ো লোককে দেখিয়ে দিলে মেয়ে বিয়ে দেয়ার জন্য?’
এইবার পাত্র বললেন, ‘আসলে এই পেশায় প্রতিষ্ঠিত হতে গেলে বুড়ো হতে হয়, এইবার আপনিই ভাবুন প্রতিষ্ঠিত আইনজীবীকে মেয়ে দিবেন নাকি অপ্রতিষ্ঠিত যুবককে মেয়ে বিয়ে দিবেন।’ সেইদিন পাত্র ছেলেটি আসলে সিনিয়র আইনজীবীর রুমের দিকে ইংগিত করেছিলেন। যাই হোক বিয়েটা কিন্তু হয়নি।
এইবার আসি আইনজীবীদের সাহায্য বিষয়ে। করোনাকালীন ও আয় রোজগার বিহীন আইনজীবীদের চতুর্থ মাস চলছে এইরকম আরো কত মাস অনাগত আমরা কেউ জানিনা। আদালত যদিও কিছুটা ভার্চুয়ালি চলছে সেইটা চাহিদার তুলনায় খুবই অপ্রতুল। সত্যিকারের আদালত কবে খুলবে সেই বিষয়েও আমাদের কাছে কোনো ধারণা নাই। আর যাই হোক ভার্চুয়ালি পানি খেয়েতো আর গলা ভিজেনা। আমার মাকে ছোট থেকেই একটা কথা বলতে শুনেছি বসে বসে খেলে নাকি রাজার ভান্ডারও খালি হয়ে যায়।
ধরুন একজন আইনজীবী মাসে গড়ে এক লাখ টাকা আয় করে, তার প্রতিমাসে খরচ হয় নব্বই হাজার টাকা অর্থাৎ যদি সব ঠিক থাকে তার মাসে জমা থাকে দশ হাজার টাকা। ইনকাম বিহীন হলেও কোনো আইনজীবীর কিন্তু সাংসারিক খরচ কমে নাই, শুধু কি তাই কোনো ব্যক্তিরই তা কমেনি। যেহেতু আয় রোজগার নাই এই চার মাসে তার খরচ হয়েছে ৯০০০০×৪ = ৩৬০০০০ টাকা। এইটাকা তিনি খরচ করেছেন তার জমানো টাকা থেকে এবং তার একমাসে যা খরচ হয় তা মেটাতে তার জমানো টাকা খরচ করতে হয় পূর্ববর্তী ৯ মাসের জমানো টাকা থেকে এবং এই পর্যন্ত তিনি ৩৬ মাসের জমানো টাকা খরচ করেছেন। সামনে এইরকম আয় রোজগার বিহীন যতমাস আসবে তাতে প্রতিমাসে খরচ হবে ৯ মাসের জমানো টাকা। এইবার আসি তার কথায় যার জমানো টাকা নাই তার কি হবে? এইবার আপনিই বলুন সাহায্য দরকার কিনা?
দেবুল কুমার দে : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ও সাবেক কার্যকরী সদস্য, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি।