আবদুল্লাহ আল মামুন :
এক.
আব্দুল কাদেরের আজ খুব ভালো লাগছে। সকাল থেকে যা যা চেয়েছিলো সব ঠিকমতো হচ্ছে। মাথার উপরে থাকা বিশাল ঝাঁপিটাকে অনেক হালকা মনে হচ্ছে৷ হওয়ারই কথা। এখন প্রায় মধ্য দুপুর। সকাল বেলা থানচি থেকে যে ভারী ঝাঁপি বহন করছিলো একের পর এক পাড়ায় গিয়ে,বিক্রি করে তা হালকা হয়ে এসেছে। কিন্তু, পকেটে জমেছে বেশ টাকা। কত হবে? ২০ হাজার? কাদেরের মনে হয় একটু কমই হবে। তবে ১৫ হাজারের কম হবে না। আরেকটা পাড়া আছে সামনে। পাহাড়ী পথ বেয়ে উঠতে হবে। কাদের এখন হাঁটছে একটা ঝিরি ধরে। মাঝে মাঝে পা পিছলে যাচ্ছে। অনেক কসরত করে ভারসাম্য ঠিক রাখতে হচ্ছে। কিন্তু, এটাও কাদেরের কাছে কষ্ট মনে হচ্ছে না। কারণ, আরেকটা পাড়ার বেচাবিক্রি করেই কাদের বাড়ি ফিরবে। আজ থানচি ফিরবে। কাল বাস ধরে বান্দরবান সদর। সেখান থেকে কেরানীহাট। আর কেরানীহাটে পৌছালেই… কাদেরের চোখে ঝিলিক দিয়ে যায়। আনমনে এক চিলতে হাসি ফুটে ঠোঁটের কোণে। ওর চোখের সামনে দুটো কচি হাত। ছোট ছোট আঙুল। ছোট ছোট পা। বড় বড় দুচোখ। হাত বাড়িয়ে দৌড়ে আসে বাবার বুকে ঝাপিয়ে পড়বে বলে। কাদের হাত বাড়ায়। হাসে। মনে হয় ইচ্ছে করলেই মেয়েকে বুকে নিতে পারবে। মেয়ের কথা মনে হতেই কাদেরের হাঁটার গতি বেড়ে যায়। ফিরতে হবে নীড়ে।
আমরা ধরে নিই কাদেরের স্ত্রীও উঠানে এসে দাঁড়াবে। আকলিমা অপেক্ষা করবে কখন বাপ মেয়ের সোহাগ শেষ হবে। কখন কাদের তার দিকে তাকাবে।
দুই.
এস আই মং প্রু মারমা এর মেজাজ প্রচন্ড খারাপ। ওসি স্যার আর কোন মামলা দিতে পারলেন না! ছোট খাট মামলা দিলেও হতো। কিন্তু, একেবারে মার্ডার কেস দিয়ে দিলেন? এ এস আই থেকে মং প্রু মার্মা নিজ কর্মগুণ, অধ্যবসায় এবং সততার জন্য পদোন্নতি পেয়েছে। এস আই হয়েছে। পরীক্ষা পাশ করতে কম কষ্ট করতে হয়নি। অন্য এ এস আইরা তাকে নিয়ে হাসাহাসি করলেও সে দমেনি। সুতরাং, সে যখন এস আই হলো কেউ অবাক হয়নি। এটাইতো হওয়ার ছিলো! কিন্তু,পোস্টিং হলো বান্দরবান সদর থানা থেকে সাড়ে তিন ঘন্টা দূরে থানচি থানায়। এসপি স্যার যখন তাকে বললেন,তুমি ভালো অফিসার। তুমি ভালো বলেই ওখানে পাঠাচ্ছি- এই প্রশংসা শুনেও তার মন গলেনি। কারণ, থানচি সম্ভবত বাংলাদেশের সবচেয়ে দুর্গম থানা। আর মামলাইতো নাই। পুরো বছর মিলে ৫/৬ টা মামলা হয়। সে কাজ দেখাবে কি করে? মন খারাপ হলেও মংপ্রু প্রকাশ করেনি। স্যারকে স্যালুট ঠুকে বাসে উঠেছে থানচি যাওয়ার জন্য।
হঠাৎ কনস্টেবল সন্তোষ এর ডাকে মংপ্রু এর সম্ভিত ফেরে স্যার, পাওয়া গেছে। মংপ্রু এগিয়ে গিয়ে দেখে একজোড়া ঝুমকো একটা ছোট্ট পাহাড়ী লতার সাথে আটকে আছে। বাতাসে টুংটাং আওয়াজ করছে।
তিন.
কাদের জোরে পা চালায়। আর মিনিট পাঁচেক দূরেই রত্নমোহন পাড়া। ঐ পাড়ায় তাড়াতাড়ি পৌছাতে হবে। থানচি থেকে এরিমধ্যে সে প্রায় ১০/১৫ কিমি ভেতরে চলে এসেছে। তার ব্যবসা মূলত মেয়েদের গহনা। সে পাড়ায় পাড়ায় গিয়ে এগুলো বিক্রি করে। বছর পাঁচেক ধরেই এই ব্যবসায় আছে। পাহাড়ি নারী,মেয়েরা তার পণ্য পছন্দ করে। বেছে বেছে নেয়। সে খুব বেশি লাভ করেনা। কারণ, দাম বেশি ধরলে মেয়েরা কিনবে না। কিন্তু,আজকে পরিস্থিতি ভিন্ন। আর ২ দিন পরে পাহাড়ীদের পরব। বৈসাবি উৎসব শুরু হবে পাড়ায় পাড়ায়। নতুন বছরের আগমনে দিলখোলা পাহাড়ীরা উৎসবে মাতবে৷ তাদের মেয়েরা পরবে নতুন কাপড়, হাতে কানে থাকবে নতুন গহনা। সুতরাং, কাদেরের ভাগ্য অপ্রসন্ন মনে হয়না। সে ভালো জিনিস ভালো দামে বিক্রি করবে। কিছু টাকা বাকী আছে। হয়তো সেগুলোও দিয়ে দেবে। পাহাড়ীদের সে ভালোবাসে। এই সহজ,সরল মানুষগুলো,তাদের জীবনবোধ ভালো লাগে। অল্পতেই তুষ্ট সেটাও ভালো লাগে। এখানকার সবাই তাকে চেনে। তাকে কাদি বলে। কাদের ডাকতে পারে না। কাদেরের কাছে সেটাও আদরের মনে হয়। পাহাড়ীদের নতুন বছরের একদিন পরেই বাঙালীদের ১লা বৈশাখ। বৌ বায়না ধরেছে এবার তাকে কিছু দিতে হবে। কাদের একটু হাসে। বুক পকেটে একজোড়া ঝুমকা সে আলাদা করে রেখেছে বৌয়ের জন্য। সদরে কেনার সময় কাদেরের এই জিনিস মনে ধরেছে। অনেক দাম দিয়ে নিয়েছে। কাদের মনে মনে বলে- বউ, তোর মনে ধরলেই আমি খুশি। ঐতো পাড়ার ঘর দেখা যাচ্ছে।
চার.
আকলিমার আজ সকাল থেকে কাজে খুব ভুল হয়ে যাচ্ছে। বার বার স্বামীর কথা মনে পড়ছে। সে মোবাইল তুলে ফোন করে। এক মহিলা বার বার বলে যাচ্ছে- দুঃখিত। আপনি যে নাম্বারটিতে ফোন করেছেন, তাতে সংযোগ দেয়া সম্ভব নয়। কিছুক্ষন পরে আবার চেষ্টা করুন। এই মহিলা কি বলে তার ঠিক নাই। এরকম আগেও হয়েছে। কাদের নেটওয়ার্কের বাইরে গিয়েছে। তার জন্য চিন্তাও হয়েছে। পাহাড়ে পাহাড়ে ফেরী করে। কখন কি হয়!! আবার ফোনেও পাওয়া যায়না। আকলিমা জানে সারাদিন ফোনে না পেলেও সন্ধ্যায় পাবে। কাদের ফিরে আসবে। কিন্তু কখনো এমন হয়নি যে ২/৩ দিন ফোনে পায়নি। হয়তো দূরের পাড়ায় গিয়েছে। ফিরতে সময় লাগছে। কিন্ত আকলিমা মনকে বুঝাতে পারে না। কাদেরকে সে বলেছে আর পাহাড়ে না যেতে। পাহাড় তার ভয় লাগে। কাদের বলেছে এই শেষবার। কিছু টাকা জমিয়েছে। এবার কেরানীহাট বাজারে একটা দোকান নেবে। আর পাহাড়ে যেতে হবে না। আকলিমা মেনে নিয়েছে। এখন ৩টার মতো বাজে। মেয়েকে ভাত দিতে গিয়ে থালাসহ ভাত হাত থেকে পড়ে গেলে আকলিমা সেদিকে তাকিয়ে থাকে। আজ তার কি হয়েছে? আর ২ দিন পরেই ১লা বৈশাখ। কাদের আগের দিন ফিরবে কথা দিয়েছে। কাদের ঘরে আসবে।
পাঁচ.
রত্নমোহন কার্বারী পাড়া থেকে প্রায় ১০/১৫ মিনিট হাঁটলে এই পাহাড়ে আসা যায়। পাড়া থেকে পাহাড়ী হাঁটা পথ ধরে আসতে হয়। একদম নির্জন জায়গা। আশেপাশে শুধু জুমের ক্ষেত আছে। নীচ দিয়ে পাথুরে ঝিরি বয়ে গিয়েছে। এখানে দাঁড়িয়েই মংপ্রু পানির আওয়াজ পাচ্ছে। ঝুমকো জোড়া হাতে নিয়ে মংপ্রু ভালো করে দেখে। পাড়ার কার্বারীও সাথে আছে। ঝুমকো দেখে মংপ্রু এর ক্লান্ত ভাব উবে যায়। পিচমোড়া করে বাঁধা দুই হারামজাদার দিকে তাকায়। এই দুজন গত ২ ঘন্টা ধরে তাদেরকে পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরাচ্ছে। কার্বারী এগিয়ে এসে বলে, স্যার এগুলাই কাদি বিক্রি করতো৷ মংপ্রু অংহ্লা এবং মংহাই এর সামনে দাঁড়ায়। তারা সম্পর্কে শ্যালক-ভগ্নিপতি। লাশ কই ফেলছস?
এই এক প্রশ্নে মংহাই ভেঙে পড়ে। হাউমাউ করে কেঁদে বলে- স্যার, ওরে মানা করছিলাম।মারিস না। ও আমার কথা শুনে নাই।আমি কিছু করি নাই স্যার। আমি মারি নাই। অং হ্লার বয়স বছর পঁচিশেক হবে। সে একরোখা,গোঁয়ার প্রকৃতির। সে বললো- আমি কিছুই জানি না। কাদিকে আমি চিনি না। মংপ্রু ঘুরে মংহাইকে চড় মারতে গেলেই মংহাই বলে -স্যার ঐ দিকে ফেলছে। ঐদিকে। ঝিরির নীচের দিকে হাত দেখিয়ে দেয়। মংপ্রু তাকিয়ে দেখে প্রায় ২০০ ফুট নীচে ঝিরি। সেখানে নামতে হবে। আরেকবার বিরক্ত লাগে তার। কিন্ত প্রথম কেস। সমাধান চাই।
ছয়.
পাড়ার বটতলায় কাদের বসলে এক ঘরের মেয়ে তাকে পানি এনে দেয়। কাদের পানি খায়। তাকে মেয়েরা ঘিরে ধরে। কার আগে কে নেবে সে প্রতিযোগিতা শুরু হয়। আধাঘন্টার মধ্যেই কাদের প্রায় সব জিনিস বিক্রি করে ফেলে। বাকী টাকাও পায় কিছু। ওদের হাতে এখন টাকা আছে। পুরুষরাও দিলখোলা। সুতরাং, কাদের তুষ্ট মনেই পাড়া ছাড়ে।
বটতলা থেকে একটু দূরে অং হ্লা একদৃষ্টে কাদেরের দিকে তাকিয়ে থাকে। কাদের টাকা গুনে। ১০০০, ৫০০ টাকার নোট। কত টাকা হবে? অং হ্লা ভাবতে পারে না। কত হাজার চিন্তা করতেই তার মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি আসে। সে জানে কাদের কোন জায়গা দিয়ে যাবে। পাড়ায় যাওয়ার পথ ছাড়াও আরেকটা ঘুরপথ আছে। কাদের প্রতিবার পাড়ায় এসে পাড়া থেকে যাওয়ার সময় ঐ পথে যায়। অং হ্লা বেড়া থেকে লম্বা দা টা তুলে নেয়।
কাদেরও বেচাবিক্রি শেষ করে পাড়ার কার্বারীকে নমষ্কার জানিয়ে বিদায় নেয়।
সাত.
ঝিরিতে নামতেই নাকে গন্ধ লাগে। মংপ্রু জানে এটা কিসের গন্ধ। গন্ধ ধরে আগাতে থাকে। অংহাই ঝিরির পাশে হাঁটতে হাঁটতে একটা জায়গায় দাঁড়ায়। গন্ধ অনেক তীব্র এখন৷ বলে- এখানেই আছে। মংপ্রু চারপাশে খোঁজে। কিন্তু গন্ধ পেলেও কিছুই দেখতে পায়না। মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। লাঠি দিয়ে দুয়েক ঘা বসিয়ে দিলে মং হ্লা একটা গর্ত দেখায়। মংপ্রু তাকে পানিতে নামতে বলে। মং হ্লা পানিতে নেমে গর্তের মুখ থেকে লতাপাতা সরায়। গর্তটা পানি যেতে যেতে তৈরি হয়েছে। মং হ্লা হাত ডুকিয়ে বের করে আনে। ওর হাতে অর্ধ গলিত একজন মানুষের মাথা। অল্প কিছু মাংস আছে। বাকীটা নিরেট কংকাল। পঁচে গলে পানির সাথে ভেসে গিয়েছে। সুতরাং,কাদি কে খুঁজে পাওয়া গিয়েছে।
একে একে কাদেররে বাকী শরীর অং হ্লা বের করে আনে। মাথার মতোই সেগুলো মাংসশুন্য। মনেই হয়না এগুলো কোন এক কালে কাদেরের ছিলো। মং প্রু এর সাথে থাকা একজন তরুণ কনস্টেবল হড় হড় করে বমি করে দেয়। বেচারা আগে কখনো দেখেনি। মং প্রু ভ্রুক্ষেপ না করে পকেট থেকে রুমাল বের করে নাকে জড়ায়। অনেক কাজ বাকী।
আট.
১লা বৈশাখ পার হওয়ার ৩ দিন পরেও যখন স্বামী ফেরে না আকলিমার মন আর মানে না। কেরানীহাট থেকে বাসে উঠে পড়ে। এরপর সদর থেকে আবার বাস ধরে থানচি পৌছায়। ওর মনে কু ডাকে। খালি কু ডাকে। আর বুক অজানা আশংকায় ধড়ফড় করে। আকলিমা জানে সেটা কি? কিন্তু সেটা ভাবনায় না নিয়েও পারে না। কাদেরের বন্ধু জাকির সহ সে থানায় আসে। জাকির আকলিমাকে বার বার বলছে ভাবী কিছু হয় নাই। ও ফিরে আসবে। আকলিমা মানে না। বলে- ভাই আগে এমন হয় নাই। ওসি সাহেব সব শুনে জিডি লেখাতে বলেন। কাদেরের ফোন চেক করতে বলেন। মং প্রু চেক করে। শেষ লোকেশন দেখে। সোর্স খবর দেয় পরবের ২ দিন আগে কাদেরকে রত্নমোহন পাড়ায় দেখা গেছে। মং প্রু রওয়ানা দিয়ে পাড়ায় এসে বলে কেউ বাইর হবে না। পাড়ার লোকজন বুঝে না। কাদেরের ছবি দেখালে সবাই বলে কাদে। কাদে। ও চলে গেছে। কার্বারী বলে পরবের দিন অং হ্লার কাছে সে অনেক টাকা দেখেছে। ১০০০ টাকার নোট। আগে কখনো দেখে নাই। তার বাসায় রাতে দোচোয়ানীর আসর বসে। অং হ্লা খালি ১০০০ টাকার নোট দেয়। আগেতো দিতো ১০/২০ টাকা। পাড়ার একজন দেখায় কাদের কোন রাস্তা দিয়ে গিয়েছে। সে রাস্তা ধরেই অং প্রু পাড়ার কার্বারী সহ আসে। সাথে মংহাই, অং হ্লাকেও নিয়ে আসে। আর আকলিমা? ও থানচি থানার বারান্দায় বসে থাকে কাদের ফিরবে বলে।
নয়.
কাদের দ্রুত পথ চলে। তার আগেই অং হ্লা গিয়ে ভগ্নিপতি মংহাইকে বলে কাদের আসছে। ওর সাথে অনেক টাকা আছে। টাকা নিয়ে ছেড়ে দেবো। মংহাই এর লোভ হয়। আবার বলে- কাদেকে সবাই চেনে। ও বলে দেবে। অং হ্লা বলে -ভয় দেখাবো যাতে আর পাড়ায় না আসে। মংহাই রাজী হয়। আরেকবার মনে হয় ভুল হচ্ছেনাতো? দূরে কাদেকে দেখা যায়৷ মং হ্লা দা এগিয়ে দেয়। মংহাই তাড়াতাড়ি দা হাতে নেয়। শত হলেও অং হ্লা ওর শ্যালক।
কাদের পাহাড়ে উঠতে উঠতে হঠাৎ দেখে পাড়ার ২ জন দা নিয়ে জুমের কাজ করছে। ও এগিয়ে যায়। বলে- ভাই ভালো আছো? তারা কথা বলে না। অং হ্লা এগিয়ে আসে। গলায় দা ধরে বলে- টাকাগুলো দে। আর কোনদিন পাড়ায় আসবি না। কাদের বুঝতে পারে না। মংহাই বলে তাড়াতাড়ি কর। টাকা দে। কাদের এবার বুঝতে পারে। কিন্তু, এই টাকাই যে ওর সম্বল। কাদের বলে- ভাই আমি আর পাহাড়ে আসবো না। আমি তোদের চিনি। আমাকে যেতে দে। মং হ্লা বলে- সময় নাই। টাকা দে। কাদের অনেক কাকুতি মিনতি করে। পায়ে ধরার চেষ্টা করে। একে একে স্বপ্নগুলো হারিয়ে যেতে থাকে। কেরানীহাটের দোকান। আকলিমা, মেয়ে, মেলা সব, সব উপার্জন। কাদের মরিয়া হয়ে মাথার ঝাঁপি ফেলে দিয়ে দৌড় দেওয়ার চেষ্টা করে। মং হ্লা দৌড়ে ওকে ধরে ফেলে। মাটির উপর চেপে ধরে। মংহাই এর ভয় লাগে। বলে – না হয় ছেড়ে দে। অং হ্লার মাথায় রক্ত উঠে যায়। দে না হয় কল্লা নামাবো। অস্তগামী সূর্যের আলোয় কাদের স্পষ্ট দেখে ওর স্বপ্নের চেয়েও উঁচু একটা অস্ত্র আঘাত হানার জন্য প্রস্তুত। কাদের ভয়ে বুক পকেট চেপে ধরে। চেপে ধরে তার স্বপ্নগুলোকে। এখানেই তার স্বপ্নের ছোট ছোট হাত,পা আধো আধো বোলের রেশমার বাস। কাদের মেয়েকে স্পষ্ট দেখে। আকলিমার চেহারা দেখে। ওর মনে হয় আকলিমা ওর মুখের উপর ঝুঁকে আছে। যেন বলছে আর কত ঘুমাইবা। উঠো। আমার ঝুমকা আনছো? দা টা নেমে আসে। কাদের চোখ বন্ধ করে।
দশ.
লাশ উদ্ধার শেষে মংপ্রু আবার পাড়ায় ফিরে আসে। শ্যালক, ভগ্নিপতি দুজনের ঘরেই কাদেরের অবশিষ্ট কিছু জিনিস পাওয়া যায়। টাকা এবং জিনিস দুইজনে সমানভাবে ভাগ করে নিয়েছিলো। কিছু জিনিস মংহাই তার বউকেও কিছু দিয়েছিলো। তার বউ এগুলা কাদেরের কাছে দেখেছে। সে নিজেও কিছু কিনেছে। জিজ্ঞাসা করলে মংহাই বলে- তোর জন্য আবার কিনেছি। কার্বারীর মেয়ের কাছেও কিছু জিনিস পাওয়া যায়। তখনই জানা যায় অং হ্লার সাথে কার্বারীর মেয়ের মন দেওয়া নেওয়া চলছিলো। সুতরাং, আসরে অং হ্লার হাজার টাকার নোট বের করার কারণও জানা যায়। ভাবী শ্বশুরকে টাকা দেখাতে হবে না?
মংপ্রু এর আর অবসন্ন লাগে না। থানায় দ্রুত ফিরতে হবে। অনেক কাজ বাকী আছে এখনো।
মংপ্রু ফিরতেই এবং পিছ মোড়া করে ২ জনকে বাঁধা দেখে থানার সামনে বসে থাকা আকলিমা দৌড়ে আসে। স্যার আমার কাদেরকে পাইছেন?
মংপ্রু এখনো এই প্রশ্নের উত্তর দিতে শেখেনি। মাথানীচু করে মংপ্রু মাথার ক্যাপটা খুলে ২ কনস্টেবল এর হাতে থাকা সাদা ব্যাগের দিকে থাকায়। কিছু না বলে ওসির কক্ষের দিকে হাঁটা দেয়।
যে প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যায়না, সে প্রশ্নের সামনে না দাঁড়ানোই উত্তম।
পেছন থেকে আকলিমার স্বপ্ন ভাঙার আহাজারি শোনা যায়। আকলিমা সাদা ব্যাগে থাকা তার স্বপ্নকে বুকে চেপে ধরে “আল্লাগো” বলে চিৎকার দেয়।
স্বপ্ন আজ স্বপ্নের কাছে ফিরেছে। তার স্বামী, রেশমার বাপ অবশেষে ঘরে ফিরেছে।
আবদুল্লাহ আল মামুন : অতিরিক্ত চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, বান্দরবান।