মনিরা নাজমী জাহানঃ
করোনা এক ভয়াবহ বিভীষিকার নাম। পৃথিবীর এমন কোন প্রান্ত খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে করোনা ভাইরাস আক্রমন করেনি । সারা পৃথিবীতে মহামারী আকার ধারন করেছে এই ভাইরাস। পৃথিবীর ২১৩ দেশের প্রায় ৬০,০০,০০০ লোক এই করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত। প্রতিদিন বহু মূল্যবান প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে এই অদৃশ্য ভাইরাস। গত ১০০ বছরের ইতিহাসে কোন ব্যধির কাছে মানব জাতির এমন করুণ পরিণতির উদাহরণ বিরল।
করোনা মহামারী কারণে মূলত দুটি ধাপে মানুষের জীবনে সমস্যার সৃষ্টি হবার আশংকা দেখা দিচ্ছে। একটি করোনা মহামারী চলাকালীন সময়ে এবং অপরটি করোনা মহামারী পরবর্তী সময়ে। করোনা চলাকালীন সময়ে সৃষ্ট সমস্যা গুলো ইতিমধ্যে আমরা প্রত্যক্ষ করছি। এই সমস্যাগুলো বিশ্ব রাজনীতি থেকে শুরু করে সামাজিক এমনকি ব্যক্তিজীবনকেও দারুন ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করেছে। এই করোনা মহামারী কে কেন্দ্র করে আমরা দেখেছি বিশ্বের দুই পরাশক্তির পরস্পরকে দোষারোপের লড়াই। দেখেছি ধর্মের ভিত্তিতে মহামারীকে কেন্দ্র করে একে অপরকে দোষারোপের লড়াই। সামাজিক অবক্ষয়ের এক বীভৎস রূপ দেখেছি এই করোনা মহামারীকে কেন্দ্র করে। কেউ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে শুনলে তাকে সমাজচ্যুত করার এক বীভৎস লড়াইয়ে মেতে উঠেছে সমাজ। ব্যক্তিজীবনে করোনা মহামারীর প্রভাব কোন অংশে কম ভয়াবহ নয়। জাতিসংঘের জনসংখ্যা বিষয়ক সংস্থা-ইউএনএফপিএ এবং এভেনার হেলথ, জন্স হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়, ও অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা গেছে, জাতিসংঘের ১৯৩টি সদস্য দেশে গত তিন মাসের লকডাউনে পারিবারিক সহিংসতা ২০ শতাংশ বেড়েছে। এই প্রতিবেদন থেকেই বোঝা যায় করোনা মহামারীতে মানুষের ব্যক্তিজীবনও ভয়াবহ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এবার আশা যাক করোনা পরবর্তী সময়ে যে সমস্ত বিপর্যয় নেমে আসতে পারে তার একটি হল অর্থনৈতিক মন্দা। অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থা ওইসিডি হুঁশিয়ার করে দিয়েছে যে বিশ্ব অর্থনীতির ওপর করোনাভাইরাসের প্রভাব কাটিয়ে উঠতে অনেক বছর সময় লেগে যাবে। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ায় যে বিরাট অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে, তা আমেরিকায় ১১ই সেপ্টেম্বরের সন্ত্রাসী হামলা পরবর্তী বা ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক সংকটের পর অর্থবাজারে যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল এবারের আঘাত তার চেয়েও অনেক আকস্মিক। এই অর্থনৈতিক মন্দার ফলে বিশ্বে প্রবৃদ্ধির হার হবে নিম্নমুখী। যার ফলে প্রচুর মাঝারী ও ক্ষুদ্র শিল্প বন্ধ হয়ে যাবে, প্রভাব পরবে বৃহৎ শিল্প কারখানাতেও। ফলশ্রুতিতে প্রচুর বেকারত্ব বৃদ্ধি পাবে। সামাজিক অস্থিরতা ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পাবে। করোনা পরবর্তী সময়ে বিশ্ব আরেকটি ভয়াবহ সংকটের মুখোমুখি হবে খাদ্যকে কেন্দ্র করে। বিশ্ব খাদ্য সংস্থা ‘ডব্লিউএফপি’র প্রধান ডেভিড বসেলে বলেছেন, করোনা সঙ্কটের কারণে যে অর্থনৈতিক সঙ্কট ধেয়ে আসছে তা খুবই ভয়াবহ। তিনি বলেছেন, জাতিসঙ্ঘ বিশ্বের গরিব জনগোষ্ঠীর মুখে খাদ্য তুলে দেয়ার ব্যবস্থা করতে না পারলে কমপক্ষে তিন কোটি মানুষ অনাহারে মারা যেতে পারে। এসব গরিব মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য বিশ্ব-ব্যবস্থার আওতায় একটি ব্যাপকভিত্তিক জাতিসঙ্ঘ তহবিল গঠন করা না হলে এ ভয়াবহ পরিণতি মেনে নিতে হবে বিশ্ববাসীকে। এখানে উল্লেখ্য যে, বিভিন্ন দেশের আর্থিক সহায়তায় বিশ্বের অন্তত ১০ কোটি মানুষের মুখে খাবার তুলে দেয় ডব্লিউএফপি। এর মধ্যে কমপক্ষে তিন কোটি মানুষ খাবার না পেলে অনাহারে মারা যাওয়ার ঝুঁকিতে আছে।
তবে এত সমস্যার মধ্যেও নতুন আরেকটি সমস্যা বিশ্ববাসীকে উদ্বিগ্ন করে তুলছে। সেই সমস্যাটি হচ্ছে জঙ্গিবাদ। করোনা মহামারী চলাকালীন এবং করোনা পরবর্তী সময়ে যে কয়টি প্রধানতম সমস্যা বিশ্ববাসীকে মোকাবেলা করতে হবে সেই সমস্যাগুলকে জঙ্গিগোষ্ঠী তাদের নিজেদের স্বার্থে জঙ্গিবাদকে উস্কে দেয়ার কাজে ব্যবহার করার আশংকা থেকেই যাচ্ছে। করোনা কালীন সময়ে জাতীয়তার ভিত্তিতে বা ধর্মের ভিত্তিতে যে ভাবে দোষারোপ করা হচ্ছে যে ভাবে ঘৃণার বিষবাষ্প ছড়ানো হচ্ছে তা সত্যিই ভয়াবহ। এই ঘৃণার বিষবাষ্প ছড়ানোর সুযোগ নিয়ে জঙ্গিগোষ্ঠী খুব সহজেই জঙ্গিবাদকে উস্কে দিতে পারে। সম্প্রতি এমন নজির লক্ষ্য করা গেছে আল কায়েদা, ইসলামিক স্টেটের মতো জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর কর্মকাণ্ডে। আল-কায়েদা বলেছে, অমুসলিমরা তাদের এই কোয়ারেন্টিনের সময়টাতে ইসলাম সম্পর্কে জানতে পারে৷ ইসলামিক স্টেট অবশ্য কঠোর অবস্থান ধরে রেখেছে৷ অনুসারীদের কোনো অনুকম্পা না দেখিয়ে আক্রমণ চালিয়ে যাবার আহ্বান জানিয়েছে তারা৷
মহামারী শুরুর দিকে নিজেদের ম্যাগাজিন আল নাবাতে কোভিড-১৯’কে খ্রিস্টান দেশগুলোর জন্য সাজা হিসেবে উল্লেখ করে প্রচারণা চালিয়েছিল আইএস। করোনা নিয়ে বেসামাল থাকা পশ্চিমা বিশ্বে হামলা চালাতে অনুসারীদের আহ্বান জানিয়েছিল তারা। সাম্প্রতিক তাদের প্রকাশিত নিবন্ধগুলোতে করোনা পরিস্থিতির জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করতে দেখা গেছে। যুক্তরাষ্ট্রে নাস্তিকতা ও অনৈতিকতার যে জোয়ার চলছে তার শাস্তি হিসেবে বিশ্বব্যাপী এ মহামারী পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।
অপরদিকে আরেকটি আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আল কায়দা কোভিড-১৯ নিয়ে ছয় পৃষ্ঠার একটি নির্দেশনা ও বিবৃতি প্রকাশ করেছে। সেখানে বলা হয়, ‘করোনা গোটা দুনিয়ায় অন্ধকারাচ্ছন্ন, যন্ত্রণাদায়ক ছায়া ফেললেও মুসলিম বিশ্বে ভাইরাসটি প্রবেশ করার কারণ হল মুসলিম দেশগুলোতে পাপ, অশ্লীলতা ও নৈতিক অবক্ষয় বেড়ে গেছে। তারা বলছে, ‘সঠিক ধর্মবিশ্বাসকে ছড়িয়ে দিতে, মানুষকে আল্লাহর পথে জিহাদের আহ্বান জানাতে এবং দমন ও দমনকারীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে করোনা সংকটকে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগাতে হবে।’
জার্মান সাংবাদিক Souad Mekhennet দ্য ওয়াশিংটন পোস্টে নিরাপত্তা কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞদের উদ্ধৃতি দিয়ে এ বিষয়ে লিখেছেন। Far-right and radical Islamist groups are exploiting corona virus turmoil শিরোনামের বিশ্লেষণধর্মী সেই লেখায় জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো ভাইরাস সম্পর্কে ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ছড়ানো শুরু করেছে বলে তিনি দাবি করেছেন।তার এই দাবির স্বপক্ষে প্রমান পাওয়া যায় নাইজেরিয়ার বোকো হারামের এক অডিও বার্তায়। যেখানে দাবি করা হয় , বোকো হারাম যে নৃশংস পদ্ধতি অবলম্বন করে সেটাই হল এন্টিভাইরাস।সেই অডিও বার্তায় সামাজিক দূরত্বের কথা বলে মসজিদ বন্ধ করে দেয়াকে ইসলামের ওপর আঘাত বলে উল্লেখ করেছে বোকো হারাম নেতা আবুবকর শেকাউ।
শুধু জঙ্গি কর্মকাণ্ড নয় কোন কোন বিশেষজ্ঞ মহামারী ছড়াতেও জঙ্গিগোষ্ঠী্র আশংকার কথা উল্লেখ করেছেন। এ বিষয়ে নিরাপত্তা গবেষক লায়েথ আলখৌরি এপিকে বলেন, এমনকি কোনো কোনো গোষ্ঠী ‘ভাইরাসের হাত থেকে কেবল ধর্ম মানুষকে বাঁচাতে পারে’ এমন তত্ত্ব দিয়ে সব বৈজ্ঞানিক সমাধান এড়িয়ে চলার কথা বলে বরং মহামারী ছড়াতে ভুমিকা রাখতে পারে৷
একথা পরিষ্কার যে মহামারীতে বিশ্বজুরে মানুষকে বিভ্রান্ত করার পূর্ণ চেষ্টা চালাচ্ছে জঙ্গি সংগঠন গুলো। তাই করোনা পরবর্তী সময়ে যে সব সমস্যা তথা অর্থনৈতিক মন্দা ও খাদ্যাভাব ঘিরে যে কঠিন সময় অতিক্রম করতে হবে বিশ্বকে সেই সময়েও পরিপূর্ণ ভাবে মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করবে এই জঙ্গিগোষ্ঠী। সভাবতই মানুষ অর্থনৈতিক মন্দা বা খাদ্য সংকটকে কিছুটা হতাশায় নিমজ্জিত হবে । সেই হতাশাকে রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ঘৃণায় রুপান্তরের সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাবে। রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থার প্রতি ঘৃণাই মানুষকে জঙ্গিবাদের দিকে আগ্রহী করে তোলে।
মহামারীতে জঙ্গিগোষ্ঠীর কর্মকাণ্ড নিয়ে উদ্বিগ্ন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস।জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এমন সতর্ক বার্তা দিয়ে আন্তোনিও গুতেরেস বলেন করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের এই সময়টিতে সুযোগ নিয়ে বড় রকমের হামলা চালাতে পারে জঙ্গিরা। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের মত উদ্বিগ্নতা জানায় ব্রাসেলসভিত্তিক থিংক ট্যাঙ্ক ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ তাদের উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করতে গিয়ে বলেন “একরকম নিশ্চিত করেই বলা যায়, কোভিড-১৯ দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাব্যবস্থা ও আইএসআইএসের বিরুদ্ধে সহযোগিতার জায়গাগুলোকে দুর্বল করে দেবে৷ এতে এই জঙ্গিরা তাদের অভূতপূর্ব হামলার জন্য প্রস্তুতি নিতে পারবে,”
এ কথা অনস্বীকার্য যে করোনা মহামারী তে জঙ্গিগোষ্ঠী যেমন ভাবে সক্রিয় মহামারী পরবর্তী সময়েও তারা ঠিক তেমন ভাবেই সক্রিয় থাকবে। তারা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তৈরি হওয়া প্রতিটি সুযোগ কে কাজে লাগানোর চেষ্টা করবে।তাই বাংলাদেশের আইন শৃঙ্খলা বাহিনী্র এই মহামারী এবং মহামারী পরবর্তী সময়ে শিথিলতা কোন সুযোগ নেই বরং তাদের কে আরও কঠোর নজরদারি বাড়াতে হবে জাতে বাংলাদেশ জঙ্গিগোষ্ঠী বিন্দুমাত্র সুযোগ নিতে না পারে।
লেখকঃ শিক্ষক, আইন বিভাগ, ইস্টওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়