চন্দন কান্তি নাথ:
আমাদের সংবিধান পৃথিবীর অন্যতম একটি সেরা সংবিধান। সংবিধান সর্বোচ্চ আইন। সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক কোনো আইন হলে তা বাতিল যোগ্য হয়। সংবিধানে আসামী ও বিচার প্রার্থী উভয়ের অধিকারের কথা লেখা আছে। আসামীকে বিচারে দোষী সাব্যস্ত করার আগে নির্দোষ মনে করা হয়। দেশে আসামীর বিচারের জন্যে ফৌজদারি আইন আছে। বিশেষ করে Code of Criminal Procedure, 1898 এক্ষেত্রে মূল আইন। এর সঙ্গে The Penal Code, The Evidence Act, 1872, Criminal Rules and Oder, 2009 এবং Police Act, 1861 ও Bengal Police Regulation,1943 গুরুত্বপূর্ণ। ফৌজদারি আইনে কিভাবে আসামীর জবানবন্দি তদন্তের সময় নিতে হবে তা আছে। আবার সাক্ষ্য আইনের ২৪ থেকে ৩০ ধারাতেও জবানবন্দি নেয়ার উপায়গুলো ও বিধান আছে। এটা প্রতিষ্ঠিত যে স্বেচ্ছামূলক (voluntary) এবং সত্য (True), প্রভাব মুক্ত ও পরস্পর সম্পর্ক যুক্ত (corroborative) হলে সে জবানবন্দির ভিত্তিতে আসামীকে সাজা দেয়া যায়। আর তদন্ত কালে ম্যাজিস্ট্রেট স্বেচ্ছামূলক (voluntary) এবং সত্য (True), প্রভাব মুক্ত জবানবন্দি নিয়ে থাকেন। ৩ ঘন্টা সময় দিয়ে উক্ত বিষয়গুলো নিশ্চিত করা ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব। না হয় বিচারের সময় আসামী সুবিধা পায়। আর তদন্ত কর্মকর্তা ১৬৪ ধারার জবানবন্দি, ১৬১ ধারার জবানবন্দিসহ অন্য সাক্ষ্য প্রমাণ নিয়ে তদন্ত রিপোর্ট দিলে মামলার আমল গ্রহণে বিচার শুরু হয়।
কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেট বুঝলেন আসামী ঘটনা ঘটিয়েছেন তবে স্বীকারোক্তি করতে বাধ্য নন এবং তিনি যদি তা করেন, তাহলে তার বিরুদ্ধে তা সাক্ষ্য হিসাবে ব্যবহৃত হতে পারে, এরূপ বক্তব্য শুনে সে উল্টে গেছেন এবং বললেন আমি ঘটনা ঘটিয়েছি সত্য কিন্তু আপনি তা লেখেন আমি তা চাই না। আমাকে আপনি আমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে বাধ্য করতে পারেন না। সংবিধান আমাকে সে অধিকার দিয়েছে। তখন ম্যাজিস্ট্রেট কি করবেন? তাঁকে বুঝিয়ে ১৬৪ নিতে পারেন কি? কার্যবিধির ১৬৪ (৩) ধারায় আছে , ‘দোষস্বীকারোক্তি লিপিবদ্ধ করার পূর্বেই ম্যাজিষ্ট্রেট স্বীকারকারীকে বুঝায়ে দিবেন যে, আসামী স্বীকারোক্তি করতে বাধ্য নন এবং তিনি যদি তা করেন, তাহলে তার বিরুদ্ধে তা সাক্ষ্য হিসাবে ব্যবহৃত হতে পারে, এবং স্বীকারোক্তিকারীকে জিজ্ঞাসাবাদ করে সেটা স্বেচ্ছামূলকভাবে করা হচ্ছে বলে যুক্তি সঙ্গতভাবে বিশ্বাস না করা পর্যন্ত কোন ম্যাজিষ্ট্রেট কোন দোষস্বীকারোক্তি লিপিবদ্ধ করবেন না; এবং যখন তিনি কোন দোষস্বীকারোক্তি লিপিবদ্ধ করবেন, তখন উক্ত লিপির পাদদেশে একটি স্বারক মন্তব্য লিপিবদ্ধ করবেন এবং তাতে লেখা থাকবে যে তিনি আসামীকে বুঝায় দিয়েছিল যে, তিনি দোষস্বীকার করতে বাধ্য নন এবং যদি তিনি তা করেন, তাহলে দোষস্বীকারোক্তি তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য হিসাবে ব্যবহৃত হতে পারে এবং তিনি বিশ্বাস করেন যে, দোষস্বীকারোক্তি স্বেচ্ছাপ্রণোদিতভাবে করা হয়েছে। এটি তাঁর উপস্থিতিতে ও শ্রবণে করা হয়েছে এবং স্বীকারোক্তিকারীকে এটি পড়ে শুনানো হয়েছে এবং তিনি এটি নির্ভুল বলে স্বীকার করেছেন এবং তিনি যে বিবৃতি দিয়াছেন, এতে তার পূর্ণাঙ্গ ও সত্য বিবরণ রয়েছে।’
যেহেতু আসামী দোষ স্বীকার করলে তা তার বিরুদ্ধে তা সাক্ষ্য হিসাবে ব্যবহৃত হতে পারে এবং সে স্বীকারোক্তি করতে বাধ্য নন সেহেতু তিনি উক্ত সাক্ষ্য দিতে বাধ্য নন এবং তিনি চান ম্যাজিস্ট্রেট তা লিপিবদ্ধ না করুক। ম্যাজিস্ট্রেট কি করবেন সংবিধান ও আইন বিরোধী কাজ করবেন? আসামীর এরূপ ১৬৪ ধারার জবানবন্দি কোনো কারণে অসাংবিধানিক কিনা? তবে এরূপ প্রশ্ন আসার আগেই একটি বিষয় পরিষ্কার যে ম্যাজিস্ট্রেট যখনই ১৬৪ ধারার জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করবেন তার আগেই প্রশ্ন করে নিশ্চিত হবেন, আসামী ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট এমন জবানবন্দি দিতে ইচ্ছুক কিনা যা তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য হিসাবে ব্যবহৃত হবে। আসামীকে মারধর করা হয়েছে কিনা, প্রলোভন কিংবা কোনো অনৈতিক প্রস্তাব দিয়েছে কিনা ইত্যাদি বিষয়ে ও নিশ্চিত হবেন। তাঁকে আর পুলিশ হেফাজতে পাঠানো হবে না একথাও নিশ্চিত করবেন। এরপর আসামী জবানবন্দি দিলে ম্যাজিস্ট্রেট জবানবন্দি নিবেন, আর না হয় নিবেন না। ম্যাজিস্ট্রেট আর পুলিশ এক নয়। ম্যাজিস্ট্রেটের কাজ ম্যাজিস্ট্রেট করবেন, পুলিশ এর কাজ পুলিশ করবেন এবং বিচারকের কাজ বিচারক করবেন। ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি না হলে আসামী ছাড়া পাবে একথা আইনে নাই। Circumstantial evidence, corroborative evidence এবং বস্তুগত সাক্ষ্য এর উপর ভিত্তি করে মামলার চেইন (chain) ঠিক করা গুরুত্বপূর্ণ। অনেক সময় প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য কিংবা আসামীর কথা মত আলামত উদ্ধারের সাক্ষ্য, dying declaration, expert opinion, medical সাক্ষ্য, দলিলগত সাক্ষ্য, accomplice সাক্ষ্য, admission সহ অন্য বিষয় বিচারে ভূমিকা রাখে। ১৬৪ ধারার জবানবন্দি একটি অংশ মাত্র। আর আমাদের দেশে পুলিশের মনোভাব ও কার্যক্রম প্রতিষ্ঠিত। তাঁরা শুধুমাত্র ১৬৪ জবানবন্দি দিয়ে আগাতে চান। উন্নত বিশ্ব এখান থেকে অনেক আগেই বের হয়ে গেছে। ডিজিটাল মাধ্যম ও মেডিকেল বিজ্ঞান এবং উন্নত প্রযুক্তি দিয়ে অপরাধ বিজ্ঞান কে ব্যবহার করে সহজেই অপরাধের রহস্য উদ্ধার করা যায় এবং সাক্ষ্য প্রমাণ যোগাড় করে বিচারে তা পেশ করা যায়। জবানবন্দি দিতে না চাইলে ম্যাজিস্ট্রেট বুদ্ধি খাটিয়ে জবানবন্দি নেয়া পণ্ডশ্রম ও সময় অপচয় ছাড়া কিছু নয়। পুলিশের মানসিকতা ও ম্যাজিস্ট্রেটের মানসিকতা এক হওয়া উচিত নয়। তদন্তের সময়ে দায়িত্ব মূলত তদন্ত কর্মকর্তার, ম্যাজিস্ট্রেটের নয়। ম্যাজিস্ট্রেট শুধুই আইন অনুযায়ী রেকর্ড করেন, আর কিছু নয়। আর অপরাধী যদি চতুর হয়, পুলিশের আরো বেশি চতুর হওয়া উচিত, ম্যাজিস্ট্রেট নয়। আসামী যদি ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে সব শুনার পর বলে সে দোষ স্বীকার করবে না, তখন ম্যাজিস্ট্রেট তাকে পুলিশ হেফাজতে আর দিবেন না। এটা Criminal Rules and Oder, 2009 এর বিধান। আমাদের সুপ্রীম কোর্ট এ বিষয়ে অনেক সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। একই রূপ ভারতের Patna High Court Anil Kumar Yadav vs The State Of Bihar Thru.Cbi on 17 May, 2013 মামলায় বলেন, “If at any time before the confession is recorded, the person appearing before the Magistrate states that he is not willing to make the confession, the Magistrate shall not authorise the detention of such person in police custody.”
তদন্ত পর্যায়ে ১৬৪, ২২ ধারার জবানবন্দি রেকর্ড, যেকোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্যে ও দ্রুত তদন্ত শেষ করার জন্যে কেস ডায়েরি পর্যালোচনা ছাড়া রিপোর্ট আসার আগ পর্যন্ত ম্যাজিস্ট্রেটের কোনো কাজ নাই। ম্যাজিস্ট্রেটসহ তদন্তে কারো হস্তক্ষেপ এর সুযোগ নাই।
তবে অনেকে মনে করে এরূপ সাক্ষ্য নেওয়া সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নিষিদ্ধ। কিন্তু এতে ভিন্ন মত আছে। কেননা ৩৫ অনুচ্ছেদে আছে,
“(1) No person shall be convicted of any offence except for violation of a law in force at the time of the commission of the act charged as an offence, nor be subjected to a penalty greater than, or different from, that which might have been inflicted under the law in force at the time of the commission of the offence.
(2) No person shall be prosecuted and punished for the same offence more than once.
(3) Every person accused of a criminal offence shall have the right to a speedy and public trial by an independent and impartial Court or tribunal established by law.
(4) No person accused of any offence shall be compelled to be a witness against himself.
(5) No person shall be subjected to torture or to cruel, inhuman, or degrading punishment or treatment.
(6) Nothing in clause (3) or clause (5) shall affect the operation of any existing law which prescribes any punishment or procedure for trial.”
উক্ত অনুচ্ছেদের শিরোনামে আছে,’ Protection in respect of trial and punishment’ এবং ৬ টি উপঅনুচ্ছেদ এর conviction, penalty, punishment, trial, witness শব্দ গুলো খেয়াল করলে বুঝা যায় উক্ত অনুচ্ছেদ বিচার কালে অধিকার রক্ষা করার কথা বলেছে, তদন্ত কালে নয়। আর ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি একটি সাক্ষ্য যা বিচারকালে ব্যবহৃত হয় এবং আসামী বিচার কালে ১৬৪ এর জবানবন্দি আদালতে সাক্ষী (witness) হিসেবে দেন না। কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক বুঝিয়ে সাক্ষ্য নেয়া অবশ্যই সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩১ ও ৩২ অনুযায়ী নিষিদ্ধ।
৩১ অনুচ্ছেদ মতে, আইনের আশ্রয়লাভ এবং আইনানুযায়ী ও কেবল আইনানুযায়ী ব্যবহারলাভ যে কোন স্থানে অবস্থানরত প্রত্যেক নাগরিকের এবং সাময়িকভাবে বাংলাদেশে অবস্থানরত অপরাপর ব্যক্তির অবিচ্ছেদ্য অধিকার এবং বিশেষতঃ আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না, যাতে কোন ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে।
৩২ অনুচ্ছেদ মতে, আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তি-স্বাধীনতা হইতে কোন ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাইবে না।
সে মোতাবেক জবানবন্দি লিপিবদ্ধ হওয়ার আগে আসামী স্বীকারোক্তি করতে বাধ্য নন এবং তিনি যদি তা করেন, তাহলে তার বিরুদ্ধে তা সাক্ষ্য হিসাবে ব্যবহৃত হতে পারে, এ কথা জানার পর দোষ স্বীকার করতে আসামী অস্বীকার করলে আর ম্যাজিস্ট্রেট তাঁকে ইনিয়ে বিনিয়ে বুঝিয়ে লিপিবদ্ধ করলে, পুলিশ এর কাজ ম্যাজিস্ট্রেট করলে তা অবশ্যই আইন ও সংবিধান বিরোধী হবে।
লেখক: সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, কুমিল্লা।