মনিরা নাজমী জাহানঃ
বর্ণবাদ বৈষম্য মানব সভ্যতার এক কলঙ্ক জনক অধ্যায়। সভ্যতার শুরু থেকেই এই কলঙ্ক বয়ে চলেছে মানব সমাজ। যুগের পরিক্রমায় মানুষ সভ্য হয়েছে বটে, জ্ঞান বিজ্ঞানে উৎকর্ষ সাধন করেছে বটে তবে বর্ণবাদ নামক কলঙ্ক থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ঘটনাকে কেন্দ্র করে এই বর্ণবাদ নামক ভাইরাস সমাজে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। এমনকি সাম্প্রতিক সময়ে যখন মানুষ করোনা নামক অদৃশ্য ভাইরাসের বিরুদ্ধে নিজের অস্তিত্ত্ব রক্ষার লড়াইয়ে লিপ্ত ঠিক সেই সময়েও আমরা দেখেছি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে বর্ণবাদের এক বীভৎস রূপ।
সর্বপ্রথম যে বিষয়টি আমাদের জানা প্রয়োজন তা হচ্ছে বর্ণবাদ কি? বর্ণবাদ হচ্ছে সেই দৃষ্টিভঙ্গি, চর্চা এবং ক্রিয়াকলাপ যেখানে বিশ্বাস করা হয় যে মানুষ বৈজ্ঞানিকভাবেই অনেকগুলো গোষ্ঠীতে বিভক্ত এবং একই সাথে বিশ্বাস করা হয় যে কোন কোন নির্দিষ্ট গোষ্ঠী অন্য গোষ্ঠীর চেয়ে নির্দিষ্ট কিছু বৈশিষ্ট্যের জন্য উঁচু অথবা নিচু; কিংবা তার উপর কর্তৃত্ব করার অধিকারী; অথবা বেশি যোগ্য কিংবা অযোগ্য।
তবে এই কথাও সত্য যে বর্ণবাদের সঠিক সংজ্ঞা নির্ধারণ করাটা কঠিন। কারণ, গবেষকদের মধ্যে গোষ্ঠী ধারণাটি নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। এছাড়াও কোনটি বৈষম্য এবং কোনটি বৈষম্য নয় সেটি নিয়েও সবাই একমত নয়। বর্ণবাদ কখোনো গায়ের চামড়ার রং দিয়ে হতে পারে, কখোনো আঞ্চলিকতা দিয়ে হতে পারে, কখোনো গোত্র দিয়ে হতে পারে, কখোনো বর্ণ দিয়ে হতে পারে। কিছু কিছু সংজ্ঞা অনুসারে, কোনো মানুষের আচরণ যদি কখনো তার জাতি বা বর্ণ দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হয়, সেটি অন্য কারো জন্য ক্ষতিকর না হলেও তাকে বর্ণবাদ বলা হবে। অন্যান্য সংজ্ঞায় শুধুমাত্র বর্ণবাদ দিয়ে প্রভাবিত হয়ে শোষণ এবং অত্যাচার করাই বর্ণবাদ।তবে এই কথাও অস্বীকার করা যায় না যে বর্ণবাদের সঠিক সংজ্ঞা নির্ধারিত না হবার ফলে সমাজে কিছু কিছু বর্ণবাদী আচরন স্থান পেয়ে যায়।
পৃথিবীকে কথায় কথায় মানবাধিকারের ছবক দেয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে বর্ণবাদের ঘটনা কি এই প্রথম? উত্তর হবে একেবারেই না। যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদের শুরু ষোড়শ শতকে। সেই সময় কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকানদের দাস হিসেবে ব্যবহারের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যাওয়া শুরু হয়েছিল৷ এরপর প্রায় এক কোটি ২০ লাখ কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকানকে দাস হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়৷তবে দিন দিন যুক্তরাষ্ট্র জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় সাফল্য লাভ করেছে বটে তবে তাদের আচরনের পরিবর্তন হয়নি। সিএনএনের ভাষ্যমতে , ২০১৮ সালে দেশটিতে মোট গ্রেপ্তারে সংখ্যা ছিল ১ কোটি ৩ লাখ ১০ হাজার ৯৬০টি। অর্থাৎ গড়ে প্রতি ৩২ মার্কিন নাগরিকের একজন গ্রেপ্তার হয়েছে। আর এই গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে শারীরিক শক্তি প্রয়োগ করা হয়েছে এমন ব্যক্তির মধ্যে কৃষ্ণাঙ্গরাই এগিয়ে।আর ২০১৬ সালে আমেরিকান জার্নাল অব হেলথে প্রকাশিত এক গবেষণা নিবন্ধের তথ্য বলছে, যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশের তৎপরতার কারণে শ্বেতাঙ্গদের চেয়ে কৃষ্ণাঙ্গদের নিহত হওয়ার ঝুঁকি তিনগুণ বেশি।লন্ডনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ওয়ার্ল্ড প্রিজন ব্রিফের দেওয়া তথ্যমতে, কয়েদি সংখ্যার দিক থেকেও যুক্তরাষ্ট্র সবার ওপরে। দেশটির জেলখানাগুলোয় ২০ লাখের বেশি কয়েদি রয়েছে, যা ওয়াশিংটন ডিসি, মিয়ামি ও বোস্টনের মোট জনসংখ্যার চেয়েও বেশি। এই কয়েদিদের এক–তৃতীয়াংশই কৃষ্ণাঙ্গ। অথচ. দেশটির মোট জনসংখ্যার ১৩ শতাংশের কিছু বেশি অংশ কৃষ্ণাঙ্গ।
শুধু বর্ণবাদের অভিযোগ যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ঘিরে তা কিন্তু নয় মানবাধিকারের তীর্থভুমি বলে খ্যাত ইউরোপ ও এই অভিযোগ থেকে মুক্ত নয়।ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটির ইতিহাসের সাবেক অধ্যাপক রবার্ট ডেভিসের মতে, ১৫শ’ থেকে ১৮শ’ শতকের মধ্যে দশ লাখের বেশি মুসলমানকে ইউরোপে দাস হিসেবে ব্যবহার করা হয়৷
২০০৫ সালে বুনা তাওহে ও জিয়েঁদ বিনা নামের দুই কিশোর পুলিশের তাড়া খেয়ে পালাতে গিয়ে একটি সাবস্টেশনে বিদ্যুৎ স্পৃষ্ট হয়ে মারা পড়ে৷ যে ঘটনার জেরে পুরো ফ্রান্সে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছিল৷ ওই বছরই জার্মানির ডেসাউয়ে পুলিশ সেলে গুলিতে সিয়েরা লিওনের শরণার্থী ওউরি জালহ মারা যায়৷২০১১ সালে পুলিশের গুলিতে মার্ক ডুগান নামের এক কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তি নিহতের ঘটনায় লন্ডন বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠেছিল৷শুধু সাধারন মানুষ নয় নেইমার কিংবা ওজিলের মত বিশ্ব বরেন্য ব্যক্তিদেরকেও ইউরোপে বর্ণবাদী আচরনের স্বীকার হতে হয়েছে।
শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপ নয় পৃথিবীর এমন কোন অংশ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর যেখানে বর্ণবাদ তার বিষাক্ত ছোবল ফেলেনি। ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটির ইতিহাসের সাবেক অধ্যাপক রবার্ট ডেভিসের আরও বলেন , ১৫শ’ থেকে ১৮শ’ শতকের মধ্যে উত্তর আফ্রিকা এবং তুরস্ক, মিশর ও পশ্চিম এশিয়ায় প্রায় ২০ লাখ খ্রিস্টানকে দাস করা হয়েছিল৷অষ্টম শতকে উত্তর আফ্রিকার মুররা স্পেন ও পর্তুগালের একটি অংশ দখল করার পরে শ্বেতাঙ্গ খ্রিস্টানদের দাস হিসেবে ব্যবহার শুরু করে৷ ১৫শ’ শতকে ইউরোপ থেকে বিতাড়িত হওয়ার আগ পর্যন্ত সেই রীতি চালু ছিল৷
তবে একথাও সত্য যে এই বর্ণবাদ বৈষম্য কে সমাজ থেকে উৎখাত করতে মানুষ অবিরত লড়াই করে গেছে।মার্টিন লুথার কিং,নেলসন ম্যান্ডেলা কিংবা মহাত্মা গান্ধীর মত বিশ্ববরেণ্য নেতারা তাদের জীবন উৎসর্গ করে গেছেন এই বর্ণবাদ বৈষম্যর বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে।জাতিসংঘ বিভিন্ন সময়ে এই বর্ণবাদ বৈষম্যর বিরুদ্ধে বিভিন্ন রকম কঠোর পদক্ষেপ গ্রহন করেছে। তার মধ্যে উল্লেখ যোগ্য হচ্ছে Universal Declaration of Human Rights 1948 , International Covenant on Civil and Political Rights 1966, International Convention on the Elimination of All Forms of Racial Discrimination 1965 প্রভৃতি।এমনকি সাম্প্রতিক সময়ে জর্জ ফ্লয়েড হত্যার পর যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গদের বিরুদ্ধে চলে আসা বর্ণবাদ বৈষম্য, অন্যায়, অবিচারের তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদ।মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনার মিশেল ব্যাচেলেটকে এক বছর সময়ের মধ্যে তদন্ত করে ওই প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
এত আন্দোলন সংগ্রাম আইন কানুন প্রণয়নের পরেও সমাজ থেকে নির্মূল করা যায়নি বর্ণবাদ বৈষম্য।আমরা কি কখনো ভেবে দেখেছি কেন নির্মূল করা যায়নি বর্ণবাদ বৈষম্য ? এর কারন সমাজে মানবিকতা ও মনুষ্যত্ববোধের চরম অভাব । সমাজে মানুষের প্রথম পরিচয় মানুষ নয় বরং ধর্ম , বর্ন গোত্র প্রভৃতি বিষয় গুলো বেশী গুরুত্ব পাচ্ছে। যার কারনে সমাজে প্রকট হচ্ছে শ্রেণী বৈষম্য, বাড়ছে সংঘাত এবং সমাজের রন্ধে রন্ধে প্রবেশ করছে বর্ণবাদের ভয়ংকর বিষবাস্প।
আমাদের মনে রাখতে হবে, যে সমাজ মানুষকে তার সর্বপ্রথম পরিচয় মানুষ না শিখিয়ে ধর্ম , বর্ন ,গোত্র প্রভৃতির ভিত্তিতে বিভক্ত করতে শেখায় সেই সমাজ কখনো সভ্য সমাজ হতে পারে না।নিজেদেরকে সভ্যতার আলোয় আলোকিত করতে হলে ধর্ম , বর্ন , গোত্রের উর্ধে উঠে মানুষকে একমাত্র মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করতে হবে। তাই সমাজ থেকে বর্ণবাদ বৈষম্য নামক মহামারী নির্মূল করতে হলে আমাদের একমাত্র মূলমন্ত্র হতে হবে “সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই”।
লেখকঃ শিক্ষক; আইন বিভাগ, ইস্টওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়।