মুবিন হাসান খান:
বাংলাদেশে এখন সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা প্রায় দেড়শ ছাড়িয়েছে। সরকারী হোক বা বেসরকারী এসময়ে অনার্সের জন্য জনপ্রিয় একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে (LAW) আইন। বর্তমানে আইন বিষয়ের জনপ্রিয়তার একটি কারণ উজ্জ্বল ভবিষ্যতের নিরাপদ মাধ্যম। এই বিষয়ে অধ্যায়নে বহুমাত্রিক চাকুরির সুযোগ থাকে এবং বিশেষভাবে “আইনজীবী ও বিচারক” হওয়ার সুযোগ। আইন ছাড়া অন্যকোন বিষয়ে ডিগ্রি অর্জন করলে আইনজীবী কিংবা বিচারক হবার সুযোগ নেই।
একজন শিক্ষার্থী যখন উচ্চ-মাধ্যমিক শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্ততি হিসেবে “আইন বিভাগ” কেই চূড়ান্ত করে তখন থেকেই অবচেতন মনে কালো কোট-প্যান্ট আর সাদা শার্ট পড়া অবস্থায় নিজেকে আদালতের ভেতর দেখতে পায়। আইন বিভাগে অধ্যায়ন করলেও নানাবিধ পেশা থাকা স্বত্তেও বেশিরভাগ ডিগ্রিধারীই আইন পেশায় জড়িয়ে পড়ে, যার একটি অন্যতম কারণ হচ্ছে এটি একটি স্বাধীন পেশা। রাষ্ট্রের প্রথম শ্রেণীর নাগরিক হওয়ায় আইনজীবীকে সমাজের একজন সম্মানীয় ব্যক্তি হিসেবেও দেখা হয়। তাছাড়া এই বিষয়ে ডিগ্রি থাকলে বেকার থাকার প্রয়োজন পড়েনা। তাই একজন ছাত্র তার উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আকাঙ্ক্ষায় আইন বিষয়কেই বেছে নেয়।
আইন বিষয়ে স্নাতক সম্পন্ন করতে একজন শিক্ষার্থীর সাধারণত চার বছর সময় লাগে। এরপর শিক্ষানবিশ আইনজীবী হিসেবে একজন সিনিয়র আইনজীবীর হাত ধরে প্রবেশ করে আদালত প্রাঙ্গণে। সেখান থেকে শুরু হয় তার নতুন অধ্যায়, শিখতে থাকে আদালতের নিয়মাবলী ও কার্যাবলী। ন্যূনতম ৬ মাস সিনিয়র আইনজীবীর সাথে থেকে কাজ শিখতে হয়। তারপর অংশগ্রহণ করতে হয় বার কাউন্সিল পরীক্ষার তিনটি ধাপঃ প্রিলিমিনারি, লিখিত এবং ভাইবা। তিনটি বিষয়ে উত্তীর্ণ হওয়ার পর একজন আইনের শিক্ষানবিশ অ্যাডভোকেট পরিচয় পায়।
কিন্তু আইন বিষয়ে ডিগ্রী অর্জনের পর স্বপ্নপূরণের সহজ পথে সবচেয়ে বড় ধাক্কা হচ্ছে সময় মতো পরীক্ষা না হওয়া। বাংলাদেশ বার কাউন্সিল বিধি অনুযায়ী ‘অ্যাডভোকেট’ হিসেবে তালিকাভুক্তির (এনরোলমেন্ট) জন্য বছরে দু’বার পরীক্ষা হবে। আর সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনায় ফি বছর অন্তত একবার হলেও তালিকাভুক্তি পরীক্ষা সম্পন্ন করার কথা বলা হয়েছে। অথচ গত ৫ বছরে অন্তত ৫টি পরীক্ষাও নেয়া হয়নি। এদিকে প্রতিবছরই আইনে স্নাতক ডিগ্রিধারী বাড়ছে। সাথে শিক্ষিত বেকারের ট্যাগ লাগা আইনের শিক্ষানবিশদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক চাপ বাড়ছে।
বাংলাদেশ বার কাউন্সিলে আইনজীবী তালিকাভুক্তির পরীক্ষার ইতিহাস দেখলে শুধু ২০১২-১৩ এই দুই বছরে দুটি পরীক্ষা পরপর হয়েছিল। অতঃপর ২০১৫, ২০১৭ এবং সর্বশেষ ২০২০ সালে ৩ টি পরীক্ষা নেয়া হয়। প্রতিটি পরীক্ষার মাঝে প্রায় ২ বছর বা তার অধিক সময়ও অপেক্ষা করতে হয়েছে শিক্ষার্থীদের। দেখা গেল কোন শিক্ষার্থী ২০১৩ তে এল.এল.বি শেষ করে শিক্ষানবিশ হিসেবে আদালতের কার্যক্রম শিখল। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত শিক্ষানবিশ থাকাকালীন সময়েই ২০১৩ সালে বার কাউন্সিল পরীক্ষার সময় নির্ধারণ করে,যারফলে উক্ত শিক্ষার্থীর সেবার আর আইনজীবী নিবন্ধন পরীক্ষা দেয়ার সৌভাগ্য হলনা। তার পরের বছর পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হল ২০১৫ সালে, তখন সে অংশ গ্রহণ করে প্রিলিমিনারিতে পাশ করলেও রিটেনে অকৃতকার্য হয়। পরবর্তীতে ২০১৭ তে পরীক্ষা হলেও ২০১৮ সালে আবার রিটেন পরীক্ষা দেয় এবং কৃতকার্য হলেও তবে ভাইবাতে বাদ পড়ে। এখন তার অপেক্ষা ২০২০ সালের আইনজীবী নিবন্ধন পরীক্ষার শেষ ধাপ ভাইভার জন্য। কিন্তু তার এই অপেক্ষার প্রহর কবে শেষ হবে সেই আশ্বাস দেবার মত কোন হৃদয়বান হয়ত বাংলাদেশে খুজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব।
একজন শিক্ষার্থী এলএলবি অনার্স শেষ করতে লাগে চার বছর। আর বর্তমান প্রেক্ষাপটে আইনজীবী সনদ পেতে প্রায় ৭-৮ বছর লেগে যায়! সময়মত পরীক্ষা না হওয়ার কুফল ভোগ করতে হয় শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের। একজন শিক্ষানবিশ তার সিনিয়রের কাছ থেকে যে আয় বা সম্মানী পায় তা লাগামহীন পরিশ্রমের বিপরীতে নগণ্য এ কথা সংশ্লিষ্ট সকলেই স্বীকার করেন। তবু ‘অসম্মানীয়’ সম্মানী নিয়ে সারাদিনের কাজের ক্লান্তি ঝেড়ে স্বপ্ন পূরণে পরীক্ষার প্রস্ততি নেয়া শুরু করে, অথচ সেই পরীক্ষার দিনক্ষণ কিছুই যানা নেই। যতটুকু জানে তার নাম অপেক্ষা এবং ধৈর্য্য।
শিক্ষানবিশদের এই চিত্র আজ ২-১ বছরের নয়। বিগত ৭-৮ বছর ধরে চলে আসছে এই সমস্যা। শিক্ষার্থীদের ভেতর আইনের প্রতি যেই আকর্ষণ ছিল তাতে যেন দেশের একটা বড় অংশ এগিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু শুধু আইন পাঠে কি হবে যদি ৪ বছর পর ব্যানার হাতে অনশন করতে হয় একটি পরীক্ষার জন্য? যদি এভাবেই আরো কিছু বছর চলতে থাকে তবে ভবিষ্যতে বহু মেধাবী আইন বিষয়ে অধ্যায়নের আগ্রহ হারাবেন। সময় থাকতে কর্তৃপক্ষ যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে এর কুফল পুরো বিচার ব্যবস্থাকেই ভোগ করতে হবে।
মুবিন হাসান খান: শিক্ষার্থী; আইন বিভাগ, জেড. এইচ. সিকদার ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি।