ড. মো নায়ীম আলীমুল হায়দার:
বর্তমানে শিক্ষানবিশ আইনজীবীরা সনদ প্রাপ্তির জন্য আন্দোলন করছে। এর পিছনে তাদের নানা ক্ষোভ, দুঃখ, অভিমান ও নানা অপ্রাপ্তির বিষয়গুলো বিদ্যমান রয়েছে। তারা অহিংস আন্দোলন করছে, তাই তাদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি। যতদিন তারা সনদ পাবে না ততদিনই তাদের শিক্ষানবিশ আইনজীবী হিসেবে থাকতে হবে। তো দীর্ঘদিন শিক্ষানবিশ আইনজীবী হিসেবে থাকলে সমস্যা কোথায়? সমস্যা তো আছেই, তা হল; শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের পেশাগত স্বীকৃতি খুব সম্ভবত নেই, তারা যেহেতু মামলা লড়তে পারেন না তাই অর্থনৈতিক ভাবে সুফল তেমন একটা পায় না, তাদের জন্য আলাদা কোন ফান্ড আছে কিনা তা জানা নেই, নিয়মিত পরীক্ষা না হবার ফলে তাদের অপেক্ষার প্রহর দীর্ঘ হচ্ছে, বয়স বাড়ছে কিন্তু নিজের পায়ে ঠিকমত দাড়াতে পারছে না। ফলে পারিবারিক ও সামাজিক ভাবে হেয় হতে হচ্ছে, আইন পাশ করে বসে থাকছে কিন্তু তার ডিগ্রি কাজে লাগাতে পারছে না, অনেকেই হতাশায় জর্জরিত, অনেক বছর পর পর পরীক্ষা হয় কিন্তু বেশিরভাগই পরীক্ষায় পাশ করতে না পেরে আবার পরবর্তী পরীক্ষার অপেক্ষায় থাকতে হয়, অনেকের কাছে এরা নিজেদেরকে বোঝা মনে করতে থাকে এছাড়া আরো অন্যান্য সমস্যা তো আছেই।
সাধারণত সরকারী, বেসরকারী, বিদেশী ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন পাশ করা সব শিক্ষার্থীরাই আইনজীবী সনদের অপেক্ষায় থাকেন। যেহেতু পরীক্ষা পদ্ধতি তাই সবাই পাশ না করা স্বাভাবিক। আমার মূল বক্তব্য হচ্ছে এরা বিশ্ববিদ্যালয় বা আইন কলেজ থেকে পাশ করার পরও কেন আইনজীবী তালিকাভুক্তির পরীক্ষায় ফেল করবে। উত্তর হতে পারে নানা ধরণের, হয়ত এরা নামেই ডিগ্রি নিয়েছে আসল জ্ঞান লাভ করেনি, হয়ত আমাদের আইন পড়ানোর পদ্ধতির সাথে বিদ্যমান তালিকাভুক্তির পরীক্ষার সামঞ্জস্যতা নেই, হয়ত তাত্ত্বিক জ্ঞান আছে ব্যবহারিক জ্ঞানের অভাব, হয়ত ৬ মাস সিনিয়রের সাথে থেকে কিছুই শিখেনি অথবা শিখতে পারেন নি, হয়ত বিদ্যমান পরীক্ষা পদ্ধতির সাথে সে তাল মিলাতে পারেন নি অথবা আইন পাশ করলেও যেহেতু তালিকাভুক্তির পরীক্ষায় পাশ করতে পারছে না তাই সে আইনজীবী হবার যোগ্য না, আরো নানা সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে।
আমার যা মনে হচ্ছে বিদ্যমান মামলা জটের মত পাশ করা আইন শিক্ষার্থীদের জটও তৈরি হয়েছে কারণ সব বিশ্ববিদ্যালয় মিলিয়ে পাশ করার সংখ্যা বিচার করলে তাই মনে হবে। একটা বিষয় আমাদের আইনের ছাত্র ছাত্রীদের পরিষ্কার ধারণা নিতে হবে যে, পাশ করে সবাই কি আইনজীবী হবে নাকি আইন সংক্রান্ত অন্যান্য পেশাতেও যোগদান করবে। যদিও আইন পাশ সবারই স্বপ্ন বা ইচ্ছা থাকে সনদ নিয়ে নামের পাশে আইনজীবী শব্দটি বসানোর। সেই স্বপ্ন বা ইচ্ছা কেন বাধা গ্রস্থ হচ্ছে? তার উত্তর হতে পারে বিদ্যমান পদ্ধতি। প্রথম দিকে আইন পাশ যে কেউ আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হতে পারত (যখন কোন পরীক্ষা পদ্ধতি ছিল না), যেখানে আগে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে সনদ পেত, যেখানে আগে বছরে ২টি পরীক্ষা নেয়া হত এখন কয়েক বছর পর পর নেওয়া হচ্ছে, বর্তমানে এমসিকিউ, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা পার হয়ে বহু কাঙ্ক্ষিত সনদ পেতে হয়।
আরো কিছু বিষয় হতে পারে যেমন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর মান ভাল না তাই বর্তমান পদ্ধতিতে পাশের সংখ্যা কম, ছাত্র ছাত্রীদের আগের চেয়ে মেধা কমে গেছে, শিক্ষানবিশ অবস্থায় শিখছে না বা শিখতে পারছে না, পরীক্ষা পদ্ধতির সাথে তাল মিলাতে পারছে না ইত্যাদি। আমরা আমাদের অনেক বিজ্ঞ আইনজীবী পেয়েছি যারা পুরাতন আমলে সনদ নিয়েছিলেন তারা খুবই সুনামের সাথে কাজ করেছেন বা করছেন। পরীক্ষা পদ্ধতির মাধ্যমে সনদ দিলেই যে মেধাবী আইনজীবী হবে তা বলা যাবে না। মূলত তার ব্যবহারিক দক্ষতা ও কাজের মুল্যায়নের মাধ্যমেই বোঝা যায় কে মেধাবী। একটা বিষয় অবাক লাগে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের দিকের শিক্ষার্থীদের তালিকাভুক্তির পরীক্ষায় ফেল করতে দেখেছি কিন্তু পেছনের দিকের অনেক শিক্ষার্থী পাশ করে সনদ পেয়েছে। হয়ত তাদের মাঝে ব্যবহারিক জ্ঞানের ব্যবধান ছিল। পরীক্ষা একটি যাচাই করার মাধ্যম তবে আইনজীবী তালিকাভুক্তির পরীক্ষাতে ব্যবহারিক দিকগুলোতে জোর দেয়া হয় বেশি। আমার মনে হচ্ছে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উক্ত পদ্ধতির সাথে তাল মিলাতে পারছে না। এছাড়া বিদ্যমান পরীক্ষা পদ্ধতির বা সনদ প্রদানের পদ্ধতির আমূল সংস্কার প্রয়োজন। প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মাঝে বিশাল ফারাক। আইন পাশ করে সবাই যদি আইনজীবী হতে না পারে তার জন্য একসময় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষা পদ্ধতিকে দায়ী করবে আইন পাশ কিন্তু আইনজীবী সনদ নিতে ব্যর্থ শিক্ষার্থীরা। অনেকে বলে সবাই কেন আইনজীবী হবে? আমি বলব হোক না, যে যোগ্যতার পরিচয় দিবে সেই এই পেশায় দীর্ঘ দিন টিকবে অন্যরা এমনিতেই পিছিয়ে পড়বে। মেধাবীর জয় হবেই, যা তার ব্যবহারিক কাজের মাধ্যমেই যাচাই করা সম্ভব কোন পরীক্ষা দিয়ে নয়। তার ব্যবহারিক কাজই হবে এক ধরণের পরীক্ষা।
বর্তমান সমস্যা নিরসনে তত্ত্বীয় ও ব্যবহারিক মূল্যায়নের মাধ্যমে সনদ প্রদানের ক্ষেত্রে আমার সুপারিশগুলো হল-
- তত্ত্বীয় বিষয় গুলো দেখবে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়। অর্থাৎ আইন পাশ করা কেউ মানে বুঝে নিতে হবে তার তত্ত্বীয় জ্ঞান সম্পন্ন করেছে।
- তত্ত্বীয় জ্ঞান লাভের পর তাঁকে ব্যবহারিক জ্ঞান/ট্রেইনিং নিতে হবে সংশ্লিষ্ট বার থেকে। এই ব্যবহারিক ট্রেইনিং দিবে সংশ্লিষ্ট কোন বিশ্ববিদ্যালয়। উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়টি নিজের এলাকার বারের সাথে যুক্ত থাকবে। বারের অভিজ্ঞ আইনজীবী ও বিচারকরা নানা ব্যবহারিক ক্লাস, সেমিনার, ওয়ার্কশপ, মুট কোর্ট ও অন্যান্য ব্যবহারিক বিষয় গুলো শিখাবেন ও পরবর্তীতে তা মূল্যায়ন করবেন। অর্থাৎ কেউ কুমিল্লা বারের সদস্য হতে হলে কুমিল্লা বারের সাথে সম্পর্কযুক্ত কুমিল্লার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হবে।
- উক্ত ট্রেইনিং ৬/৯/১২ মাস মেয়াদি হতে পারে। যারা সফল ভাবে তত্ত্বীয় ও ব্যবহারিক ট্রেইনিং শেষ করবে তাদেরকে সনদ দেয়ার জন্য সুপারিশ করবে সংশ্লিষ্ট বার। সনদে উক্ত শিক্ষার্থীর ব্যবহারিক জ্ঞানের নানাদিক উল্লেখ থাকবে, যেমনঃ খুব ভাল, ভাল, মধ্যম, খারাপ, বেশি খারাপ ইত্যাদি। যাদের অবস্থা বেশি খারাপ তারা সনদ পাবে না তাদের আবার ট্রেইনিং দিতে হবে।
- ব্যবহারিক ট্রেইনিং কোর্সের ফিস সংশ্লিষ্ট বার ও বিশ্ববিদ্যালয় ঠিক করবে অথবা বাংলাদেশ বার কাউন্সিল ও ইউজিসি মিলে ঠিক করবে। ফির একটা অংশ পাবে যারা ক্লাস নিবে তারা, কিছু যাবে সংশ্লিষ্ট বারে এবং বাকি অংশ পাবে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়।
- উক্ত ট্রেইনিং এর সিলেবাস ও মেয়াদ বাংলাদেশ বার কাউন্সিল ঠিক করবে। সনদ নেয়ার পরের পদ্ধতি গুলো বার কাউন্সিল ঠিক করে দিবে।
- বার কাউন্সিল চাইলে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে না দিয়ে নিজেরাও উক্ত ট্রেইনিং কোর্স করাতে পারে।
- মূলত তত্ত্বীয় ও ব্যবহারিক নানা ধাপ পেরিয়ে যখন কোন ছাত্র বা ছাত্রী সনদ পাবে নিঃসন্দেহে তারা বর্তমান পরীক্ষা পদ্ধতির চেয়ে ভাল অবস্থায় থাকবে কোর্টে গেলে।
- এছাড়া কোন আইনজীবীর দক্ষতার কমতি দেখা গেলে সে চাইলেও উক্ত ব্যহারিক ট্রেইনিং কোর্স করে নিজের দক্ষতা বাড়াতে পারবে যা তার পেশাগত উন্নয়নে কাজে দিবে।
আমি বর্তমান অবস্থায় একটি সুপারিশ তুলে ধরেছি মাত্র। আশা করি এতে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির ফারাক হয়ত কিছুটা কমলেও কমতে পারে। সব ধারনারই কিছু ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক থাকে, আমার ধারনায় ও থাকতে পারে। তবে আমি একটি সহজ সরল উপায় দেয়ার চেষ্টা করেছি যাতে বেশি সংখ্যক ছাত্র ছাত্রী মেধাবী আইনজীবী হতে পারে। এই ক্ষেত্রে ব্যবহারিক জ্ঞ্যানের শিক্ষা ও প্রয়োগ এর বিকল্প কিছু দেখছি না।
ড. মো নায়ীম আলীমুল হায়দার: সহযোগী অধ্যাপক এবং বিভাগীয় প্রধান; আইন ও বিচার বিভাগ নর্থ ইস্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ।