মনিরা নাজমী জাহান:সম্প্রতি বাংলা ট্রিবিউনে “’অনলাইন জঙ্গি’ নিয়োগ করছে আইএস?” শীর্ষক শিরোনামে একটি খবর প্রকাশ করা হয় যেখানে ভারতের জি নিউজের বরাত দিয়ে উল্লেখ করা হয় যে গোয়েন্দা সংস্থার নজর এড়িয়ে কীভাবে কার্যক্রম চালানো যায়, সে কৌশলও শেখাচ্ছে আইএস নেতারা। সম্প্রতি ভারতের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর এক বৈঠকে এমন তথ্য উঠে এসেছে। মে মাসে প্রকাশিত আইএস-এর সঙ্গে যুক্ত ‘দ্য সাপোর্টারস সিকিউরিটি’ নামে একটি সাইবার সিকিউরিটি ম্যাগাজিনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বনের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। কী করে গোয়েন্দা সংস্থারগুলোকে ফাঁকি দেওয়া যায়, তার পথ বাতলে দেওয়া হয়েছে সেখানে। ২৪ পৃষ্ঠার ওই ম্যাগাজিন স্মার্টফোন এবং কম্পিউটার ব্যবহার করার সময় কীভাবে সতর্ক হতে হবে, তাও বলা আছে। বিষয়টি শুধু উদ্বেগজনক নয় চরম উৎকণ্ঠার ও বটে।কারন জঙ্গিবাদ একটি বৈশ্বিক সমস্যা। যখন পৃথিবীর কোন একটি প্রান্ত আক্রান্ত হয় তখন তা পৃথিবীর অন্য প্রান্ত গুলোকেও নিরাপত্তা হীনতার মধ্যে ফেলে দেয়। পৃথিবীকে করে তোলে অস্থির।
তবে এই অনলাইন জঙ্গি নিয়োগকে কেন্দ্র করে কয়েকটি বিষয় জানা প্রয়োজন। তার মধ্যে সর্বপ্রথম যে বিষয়টি জানা প্রয়োজন তা হল এই মহামারী চলাকালে জঙ্গি গোষ্ঠী কি হঠাৎ করে অনলাইন কার্যক্রম পরিচালনা শুরু করলো ? এই মহামারী চলাকালীন সময়ে তাদের কোন কার্যক্রম ছিল কি? এই প্রশ্নের উত্তরে বলতে হয় এই মহামারী চলাকালীন সময়ে জঙ্গিগোষ্ঠী যথেষ্ট সক্রিয় ছিল । মহামারি শুরুর দিকে নিজেদের ম্যাগাজিন আল নাবাতে কোভিড-১৯’কে খ্রিস্টান দেশগুলোর জন্য সাজা হিসেবে উল্লেখ করে প্রচারণা চালিয়েছিল আইএস। করোনা নিয়ে বেসামাল থাকা পশ্চিমা বিশ্বে হামলা চালাতে অনুসারীদের আহ্বান জানিয়েছিল তারা। সাম্প্রতিক তাদের প্রকাশিত নিবন্ধগুলোতে করোনা পরিস্থিতির জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করতে দেখা গেছে। যুক্তরাষ্ট্রে নাস্তিকতা ও অনৈতিকতার যে জোয়ার চলছে তার শাস্তি হিসেবে বিশ্বব্যাপী এ মহামারি পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।অপরদিকে আরেকটি আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদা কোভিড-১৯ নিয়ে ছয় পৃষ্ঠার একটি নির্দেশনা ও বিবৃতি প্রকাশ করেছে। সেখানে বলা হয়, ‘করোনা গোটা দুনিয়ায় অন্ধকারাচ্ছন্ন, যন্ত্রণাদায়ক ছায়া ফেললেও মুসলিম বিশ্বে ভাইরাসটি প্রবেশ করার কারণ হলো মুসলিম দেশগুলোতে পাপ, অশ্লীলতা ও নৈতিক অবক্ষয় বেড়ে গেছে। তারা বলছে, ‘সঠিক ধর্মবিশ্বাসকে ছড়িয়ে দিতে, মানুষকে আল্লাহর পথে জিহাদের আহ্বান জানাতে এবং দমন ও দমনকারীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে করোনা সংকটকে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগাতে হবে।’নাইজেরিয়ার জঙ্গি গোষ্ঠী বোকো হারামের এক অডিও দাবি করা হয়, বোকো হারাম যে নৃশংস পদ্ধতি অবলম্বন করে সেটাই হলো অ্যান্টিভাইরাস। সেই অডিও বার্তায় সামাজিক দূরত্বের কথা বলে মসজিদ বন্ধ করে দেওয়াকে ইসলামের ওপর আঘাত বলে উল্লেখ করেছে বোকো হারাম নেতা আবুবকর শেকাউ।
দ্বিতীয় যে বিষয়টি জানা প্রয়োজন তা হল, জঙ্গি গোষ্ঠীর এই অনলাইন ভিত্তিক কার্যক্রম কি একেবারেই নতুন নাকি তারা আগেই অনলাইন দুনিয়াকে ব্যবহার করে জঙ্গি ভিত্তিক কার্যক্রম পরিচালনা করেছে ? এই প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে একটু অতীতে ফিরে যেতে হবে।যদিও ৯/১১ টুইন টাওয়ার আক্রমণের আগে জঙ্গি গোষ্ঠী বিচ্ছিনভাবে অনলাইনে কার্যক্রম চালাত তবে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এবং সাংগঠনিক ভাবে অনলাইনে কার্যক্রম শুরু করে করে ৯/১১ টুইন টাওয়ার আক্রমণের পর।আমেরিকার আফগানিস্থান আক্রমণের পর জঙ্গীদের একটা বিশাল অংশ আশ্রয় নেয় পাকিস্তান এবং সৌদি আরবে।বাকিরা বিচ্ছিন্ন ভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন যায়গায় আশ্রয় নেয়।যেহেতু সেই সময় তাদের নির্দিষ্ট ক্যাম্প ছিল না তাই ওই সময় আল কায়েদা তাদের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সদস্যদের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য প্রথম সাংগঠনিক ভাবে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার শুরু করে । সেই সময়ে তাদের কাজ ছিল অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে নিয়োগ কার্যক্রম চালানো এবং নিজেদের কলা কৌশল সম্পর্কে সদস্যদের ধারনা দেওয়া। পরবর্তীতে তারা এই প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে শুধু নিজেদের সদস্যদের মধ্যে যোগাযোগ নয় বরং সমমনা অন্যান্য গ্রুপ যেমন Al-Shabab in Somalia, Al-Qaeda in Iraq, Al qaeda in arabian peninsula প্রভৃতি সংগঠনগুলোর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে।এছাড়াও আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ তারা করে তা হল জঙ্গী কর্মকাণ্ডে অর্থ সংগ্রহ।২০০১-০২ সালে আল কায়েদা ওয়েবসাইড ডেভেলপ করে যেখানে তাদের যোগাযোগের মাধ্যম ছিল মেসেজ বোর্ড। আল কায়েদা তাদের প্রথম তৈরি মেসেজ বোর্ডের নাম দেয় আনসার মেসেজ বোর্ড।
এরপর জঙ্গি গোষ্ঠী মেসেজবোর্ড থেকে ফোরাম ভিত্তিক কার্যক্রম পরিচালনা শুরু করে।তারপর জঙ্গি গোষ্ঠী Ansar Al Mujahideen নামে ফোরাম ভিত্তিক কার্যক্রম চালু করে যেখানে তারা প্রথম paltalk সেশন চালু করে। এই সেশনের উদ্দেশ্য ছিল ব্যক্তি পর্যায়ে যোগাযোগ বৃদ্ধি। এই সেশনে মূলত নতুন সদস্যদের জিহাদ ভিত্তিক বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেয়া হত। এর পরের পর্যায়ে জঙ্গি গোষ্ঠী vBulletin পদ্ধতির প্রচলন করে।সেই পদ্ধতির সুবিধা ছিল সেই পদ্ধতি সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল না সেই vBulletin যোগ দেবার জন্য রেজিস্ট্রেশন এবং পাসওয়ার্ডের প্রয়োজন হত। যার কারনে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী চাইলেই তাদের কাজের উপর খবরদারী করার সুযোগ অনেকাংশে কমে যায়।
তবে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারে আমূল পরিবর্তন আনেন জঙ্গি আবু মুসাব আল জারকাবি।জারকাবি মূলত ছিলেন মিডিয়া বিমুখ একজন ব্যক্তি। তিনি অন্যান্য জঙ্গী দের মত আল জাজিরা মুখি ছিলেন না । বরং তিনি প্রথম শিরচ্ছেদের ঘটনা অনলাইন প্লাটফর্মে প্রচার করেন। যেহেতু জারকাবি প্রচারের মাধ্যম হিসেবে প্রচলিত মিডিয়া কে ব্যবহার না করে অলাইন প্ল্যাটফর্মকে ব্যবহার করছিলেন । ফলশ্রুতিতে জঙ্গি গোষ্ঠীর কাছে Ansar Al Mujahideen ফোরাম দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং এই ফোরামের মেম্বার হবার হিরিক পরে যায়।২০০৫ সালের বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠী বিভিন্ন মেসেজ বোর্ডের ব্যবহার শুরু করে। যা দ্রুত ই জঙ্গিদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।এই মেসেজ বোর্ডের মধ্যে একটি গুরুত্ব পূর্ণ ছিল Al qaeda military section । যেখানে সেই সময় আত্মঘাতী বোমা সহ জঙ্গিবাদের অন্যান্য কলা কৌশল সম্পর্কে ধারনা দেয়া হয়।পরবর্তীতে এই মেসেজ বোর্ড গুলোকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ভার্চুয়াল গ্রুপের আবির্ভাব ঘটে যাদের কাজ ছিল মেসেজ বোর্ডের মেসেজ গুলোকে বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে দেয়া। পরবর্তী কালে Al qaeda ইংরেজিতে INSPIRE নামের একটি ম্যাগাজিন Arabian peninsula থেকে প্রকাশ করে। এখনে উল্লেখ্য যে ২০১৩ সালে Boston Marathon যে বোমাবাজির ঘটনা ঘটে সেই ঘটনার তদন্তে জানা যায় যে তৎকালীন জঙ্গি গোষ্ঠী বোমাবাজির কৌশল INSPIRE নামের ম্যাগাজিন থেকেই রপ্ত করেছিল।
তবে এত তুলনামূলক ভাবে গোপন এবং নিরাপদ ফোরাম থাকা সত্বেও জঙ্গি গোষ্ঠী ওপেন ফোরাম অর্থাৎ সামাজিক গনমাধ্যমের দিকে ঝুঁকে পরে। বিশেষ করে টুইটার অনেক বেশী জনপ্রিয় হয় জঙ্গি গোষ্ঠীর মধ্যে। তবে এর অন্যতম প্রধান কারন হিসেবে ধরা হয় খুব সহজে অধিক মানুষের কাছে বার্তা পৌঁছান সম্ভব।আরেকটি কারন হচ্ছে মত প্রকাশের স্বাধীনতা।একটি উদাহরন দিলে বিষয়টি আরও পরিস্কার হয়ে যাবে, Jabhat al-Nusra একটি সিরিয়া ভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন।যাদের একবার মনে হল Shumukh al-Islam নামক ফোরামে তাদের মতামত কে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না বরং সেই ফোরামে গুরুত্ব পাচ্ছে Al qaeda ইরাকের মতামত। তখন তারা সেই ফোরামের পক্ষপাতদুষ্টের অভিযোগ এনে ফোরাম ত্যাগ করে। এই রকম বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জঙ্গি গোষ্ঠী মত প্রকাশে গুরুত্ব না পাওয়ায় বিভিন্ন ফোরাম ত্যাগ করে এবং পরবর্তী কালে ওপেন ফোরাম অর্থাৎ সামাজিক গনমাধ্যম বিশেষ করে টুইটারের দিকে ঝুকে পরে।
এ কথা অনস্বীকার্য যে, ইন্টারনেটের কোন নির্দিষ্ট সীমানা, ক্ষেত্র বা বিস্তৃতি নেই।তাই এই ইন্টারনেটকে ব্যবহার করে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে বসে অন্য প্রান্তকে খুব সহজেই প্রভাবিত করা সম্ভব।সেই সুযোগটি জঙ্গী গোষ্ঠী বার বার নেবার চেষ্টা করে। কাজেই জঙ্গীগোষ্ঠীর এই অসাধু প্রচেষ্টা কে মাথায় রেখেই আমাদের আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে পর্যাপ্ত এবং যুগপযোগী প্রশিক্ষণে প্রশিক্ষিত করে এই অনলাইন জগতকে কঠোর নজরদারির আওতায় আনতে হবে।নিঃসন্দেহে এই বিষয়ে বিন্দু মাত্র হেলা ফেলা বড় ক্ষতির কারন হয়ে দাঁড়াবে।
মনিরা নাজমী জাহান: শিক্ষক; আইন বিভাগ, ইস্টওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়।