মোঃ শহীদুল্লাহ মানসুর

প্রসঙ্গ যৌতুক: সংজ্ঞা, শাস্তি, প্রতিকার ও অন্যান্য

মোঃ শহীদুল্লাহ মানসুর:

যৌতুক একধরনের সামাজিক ব্যাধি। আমাদের চারপাশে বিয়ের সময় বা বিয়ের পরে যৌতুকের জন্য নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। অনেক সময় এ ঘটনা মৃত্যু পর্যন্ত গড়ায়। যৌতুকের জন্য সাংসারিক জীবনে নেমে আসে অশান্তি। অনেক সময় সংসার ভেঙে যাওয়ার উপক্রম বা ভেঙেও যাচ্ছে। যৌতুক প্রথার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সফলতা আসছেনা। এই ব্যাধি ছড়িয়ে পড়েছে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। গ্রাম থেকে শহরে, উচ্চবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত – সর্বত্রই এই ব্যাধি হানা দিচ্ছে। গ্রামে এটি দৃশ্যমান ও প্রকাশ্য। সেখানে বলাই হয় যে, যৌতুক না দিলে মেয়ের বিয়ে হবেনা। মেয়ের বয়স বেশি হলে যৌতুক বেশি দিতে হয়। আবার শহরে নানান ‘ফরম্যাটে’ যৌতুক দেয়া এবং নেয়া হচ্ছে। এখানে উচ্চবিত্তরা চাকরি, গাড়ি, বাড়ি, ব্যাংক – নানা কায়দায় যৌতুক দিচ্ছে-নিচ্ছে।

নারী নির্যাতনের অনেকগুলো কারণের মধ্যে অন্যতম প্রধান কারণ “যৌতুক”। সাধারণ অর্থে যৌতুক বলতে বিয়ের সময় কিংবা বিয়ের আগে-পরে পাত্র বা বরপক্ষ কর্তৃক কনে পক্ষের কাছে কৃত দাবি-দাওয়াকে বুঝায়। অর্থাৎ পাত্রপক্ষ কনেপক্ষের কাছে দাবি জানিয়ে যে সমস্ত স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি আদায় করে তা-ই যৌতুক। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন অনুযায়ী, স্বামীপক্ষের দ্বারা বিয়ের পণ হিসাবে বিয়ে বিদ্যমান থাকা অবস্থায় বিয়ে স্থির থাকার শর্তে অর্থ, বিলাস সামগ্রী বা অন্যবিধ দাবিকে যৌতুক বলা হয়েছে।

যৌতুক নিরোধ আইন, ২০১৮ এর ২ ধারায় যৌতুকের সংজ্ঞা – ‘‘যৌতুক’’ অর্থ বিবাহের একপক্ষ কর্তৃক অন্যপক্ষের নিকট বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের পূর্বশর্ত হিসাবে বিবাহের সময় বা তৎপূর্বে বা বৈবাহিক সম্পর্ক বিদ্যমান থাকা কালে, বিবাহ অব্যাহত রাখিবার শর্তে, বিবাহের পণ বাবদ, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে, দাবিকৃত বা বিবাহের একপক্ষ কর্তৃক অপরপক্ষেকে প্রদত্ত বা প্রদানের জন্য সম্মত কোনো অর্থ-সামগ্রী বা অন্য কোনো সম্পদ, তবে মুসলিম ব্যক্তিগত আইন (শরিয়াহ্) প্রযোজ্য হয় এমন ব্যক্তিগণের ক্ষেত্রে দেনমোহর বা মোহরানা অথবা বিবাহের সময় বিবাহের পক্ষগণের আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব বা শুভাকাঙ্ক্ষী কর্তৃক বিবাহের কোনো পক্ষকে প্রদত্ত উপহার-সামগ্রী ইহার অন্তর্ভুক্ত হইবে না।

ব্যাখ্যা
বিয়ের সম্পর্ক স্থাপন করার শর্তে বিয়ের আগে বা পরে কোন পক্ষ যদি কোনো অর্থ-সমগ্রী বা অন্য কোন সম্পদ দাবী করে এবং অপরপক্ষ তা প্রদান করে বা প্রদান করার জন্য সম্মত হয় তবে তা যৌতুক হিসাবে বিবেচিত হবে।

আলোচনায় প্রাপ্ত যৌতুকের উপাদান

  • বিয়ের পক্ষগণ কর্তৃক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উক্ত যৌতুক আদান-প্রদান বা আদান-প্রদানের সম্মতি থাকতে হবে।
  • বিবাহের সময়ে বা পূর্বে বা পরে যেকোন সময়ে এটি প্রদান বা প্রদানের সম্মতি দিতে হবে।
  • পক্ষদের মধ্যে যৌতুক হিসেবে দেয়া-নেয়াটি বিয়ে বজায় রাখার শর্তে হতে হবে।

আদালতের মন্তব্য
বিয়ের সময় বা আগে যৌতুক গ্রহণ বা দেওয়া বা তাতে সাহায্য করা শুধু অপরাধ নয় বরং বিয়ের পরে যৌতুক দাবি করাও অপরাধ। [আবুল বাশার হাওলাদার বনাম রাষ্ট্র ও অন্যান্য, ৪৬ ডি.এল.আর (১৯৯৪) ১৬৯]

লেনদেন কি চুক্তি হবে?
এক কথায় যৌতুকের লেনদেন নিষিদ্ধ। সুতরাং এখানে চুক্তি হওয়ার প্রশ্নই উঠেনা। যৌতুক প্রদান বা গ্রহণ সংক্রান্ত যেকোনো চুক্তি ফলবিহীন। (void)

অপরাধের ধরণ
যৌতুক সংক্রান্ত সকল অপরাধ আমলযোগ্য, জামিন অযোগ্য এবং আপোষযোগ্য হবে অর্থাৎ যদি পক্ষগণ চান,তবে আপোষ-মীমাংসার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে পারবেন।

প্রতিকার
সামাজিকভাবে যৌতুক তথা বিয়ের সময় উভয়পক্ষের মধ্যে অর্থ বা সম্পদ আদান-প্রদানের প্রথা থাকলেও বর্তমানে বাংলাদেশের প্রচলিত যৌতুক নিরোধ আইনে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। আপোষের সুযোগ থাকায় এই আইনের অধীনে সংঘটিত অপরাধের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি দুই ভাবে প্রতিকার পেতে পারেন,

• সালিশের মাধ্যমে আপোষ মীমাংসা এবং
• আদালতে মামলা দায়েরের মাধ্যমে।

সালিশের মাধ্যমে আপোষ-মীমাংসা
যৌতুকের জন্য সমাধান চেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ নিজে বা তার পক্ষে অন্য কেউ ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ানম্যান বরাবরে আবেদন প্রদান করবেন। আবেদন প্রদানের ৩০ দিনের মধ্যে চেয়ারম্যান উভয়পক্ষের মনোনীত প্রতিনিধিদের নিয়ে সালিসী পরিষদ গঠন করবেন। সালিসী পরিষদ উভয়পক্ষকে ডেকে সমঝোতার চেষ্টা করবেন। সমঝোতার চেষ্টা সফল হতে পারে আবার ব্যর্থও হতে পারে। সমঝোতার চেষ্টা ব্যর্থ হলে ক্ষতিগ্রস্তপক্ষ আদালতে মামলা দায়ের করতে পারবেন। উক্ত মামলার তদন্ত, বিচার, আপীল এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয়ে ফৌজদারী কার্যবিধি বিধানাবলী কার্যকর হবে।

যৌতুক প্রদান বা গ্রহণের শাস্তি
যৌতুক নিরোধ আইন-২০১৮ এর ধারা ৩ এ বলা হয়েছে, যদি কোন ব্যক্তি যৌতুক প্রদান বা গ্রহণ করে অথবা প্রদান বা গ্রহণে প্ররোচনা দেয়, তাহলে সে ৫ বছর পর্যন্ত এবং একবছরের কম নয় এমন কারাদন্ডে বা জরিমানা কিংবা উভয়বিধ দন্ডে দন্ডিত হবে অর্থাৎ যৌতুক দেয়া বা নেয়া দুটিই শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে বিবেচিত হবে। তেমনিভাবে যদি কেউ যৌতুক নেয়া বা দেয়ার জন্য উৎসাহ বা প্ররোচনা দেয় তাহলে সে ব্যক্তিও একই ধরণের শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছে বলে বিবেচিত হবে।

যৌতুক দাবি করার জন্য শাস্তি
যৌতুক নিরোধ আইন, ২০১৮ এর ধারা ৪ এ বলা হয়েছে, যদি কোন ব্যক্তি ক্ষেত্রমতে বর বা কনের পিতা-মাতা বা অভিভাবকের কাছে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোন যৌতুক দাবি করে, তাহলে সে ৫ বছর মেয়াদ পর্যন্ত বর্ধনযোগ্য এবং একবছর মেয়াদের কম নয়, কারাদন্ডে বা জরিমানায় বা উভয়বিধ দন্ডে দন্ডিত হবেন। অর্থাৎ যদি কোন একপক্ষ যৌতুক দাবি করে এবং তা প্রমাণিত হয় তবে অপরাধীর দন্ড হবে। এই দাবি মৌখিক বা লিখিতভাবে হতে পারে।

মিথ্যা মামলা দায়েরের শাস্তি
যৌতুক নিরোধ আইন, ২০১৮ এর ধারা ৬ অনুযায়ী, যদি কোনো ব্যক্তি অন্যকোনো ব্যক্তির ক্ষতি সাধনের উদ্দেশ্যে উক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে এই আইনের অধীনে মামলা বা অভিযোগ করার মতো কারণ না থাকা সত্ত্বেও মামলা বা অভিযোগ দায়ের করেন বা করান, তাহলে তিনি অনধিক ৫ (পাঁচ) বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০,০০০ (পঞ্চাশ হাজার) টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

প্রতিকার পেতে সহযোগী সংস্থা
বর্তমানে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে যৌতুকের ভয়াবহ থাবা তাদের অসহায়ত্বকে আরো প্রকট করছে। আইন সর্ম্পকে অজ্ঞতা, অসচেতনতা, ব্যয়বহুল মামলা পদ্ধতির পাশাপাশি সংসার ভেঙ্গে যাবার আশংকার কারণে অসহায় মানুষগুলো অধিকার বঞ্চিত হচ্ছে। দেশে যৌতুকের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের আইনি সহায়তা দেওয়ার জন্য সরকারি-বেসরকারি কিছু সংস্থা রয়েছে, যারা বিনা খরচে ক্ষতিগ্রস্তের পক্ষে মামলা পরিচালনার যাবতীয় খরচ বহন করে। এ রকম সংস্থাগুলো হলো-

১. বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এন্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট)
২. আইন ও সালিশকেন্দ্র (আসক);
৩. বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি;
৪. জাতীয় আইন সহায়তা প্রদানকারী সংস্থা, ইত্যাদি।

মোঃ শহীদুল্লাহ মানসুর: শিক্ষার্থী; আইন বিভাগ, মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।