তামান্না ফেরদৌস: পৃথিবীর ইতিহাসে যুগে যুগে আইনজীবীগণ স্বাক্ষর রেখেগেছেন তুখোর রাজনীতিবিদ, সফল রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে। রাজনীতি বা দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে আইনের জ্ঞানই যে একমাত্র সহায়ক তেমনটা আবার নয়। কেননা শুধু আইন জানা নয়; আইনের প্রয়োগ, সঠিক কর্ম পরিকল্পনা এবং তার বাস্তবায়নের পারদর্শীতা এ ক্ষেত্রে সঠিক যোগ্যতার মাপকাঠি বলেই বিবেচিত হয়। আইনজীবীদেরকে বলা হয় ‘A lawyer is a Master of all Masters’ কেননা একজন আইনজীবীর কাছে আইনগত সহযোগিতার প্রয়োজনে সকল পেশার মানুষের আনাগোনা থাকে। তাই পেশার প্রয়োজনেই একজন আইনজীবীকে সকল পেশার জ্ঞান কমবেশি রাখতে হয় বলেই হয়তো একজন আইনজীবী সকল বিষয়ে সাবলিল থাকেন সর্বত্র। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস বলে আইনজীবীগণ যখন অধিকার আদায়ে রাজপথে নেমেছে তখন আর কোনো সরকারই তার সিংহাসন আগলে রাখতে পারেনি। আর এসব কারনেই সম্ভবত আজও আইন প্রণেতাদের মাঝে আইনজীবী সংখ্যার আধিক্য।
একজন মানুষের পেশা হিসেবে আইনকে বেছে নিতে হলে এলএলবি, এমএলএম বা বার-এট-ল সনদ থাকাটাই শেষ কথা নয় বরং বলা যায় এই সনদ প্রাপ্তি কেবল পেশা জীবনের প্রারম্ভ। এর পরে তাকে বিশাল পথ পরিক্রমার মধ্য দিয়ে চলতে হয় এবং যার জন্য একান্ত প্রয়োজন সেই বহুপুরাতন এবং বহুল প্রচারিত শব্দ ‘ধৈর্য্য’ ও ‘অধ্যাবসায়’। একজন আইনের ছাত্রের মেধা জ্ঞান ধৈর্য্য ও অধ্যাবসায়কে সঙ্গী করে একজন প্র্যাকটিসিং সিনিয়রের অধীনে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করেই আইনজীবী জীবনের পথে পা রাখতে হয়। এই সময়ে তাকে শিখতে হয় সিনিয়র কিভাবে ক্লায়েন্ট হ্যান্ডেল করেন, কিভাবে মামলায় তৈরী হন, কিভাবে নথি-পত্র ঘেটে মামলার প্রকৃত ফ্যাক্ট জেনে নেন, কিভাবে সে ফ্যাক্টের সাথে প্রয়োজনীয় ল’ খুঁজে বের করেন এবং পরিশেষে কিভাবে সেই ফ্যাক্টের সাথে ল’এর সংমিশ্রন ঘটিয়ে বিচারকদের সামনে উপস্থাপন করেন। এ সময়ে শুধু নিজের সিনিয়র নয় অন্য আইনজীবী সিনিয়রদের অনুকরণের মাধ্যমেও নিজেকে শিখে নিতে হয়। মূলত সিনিয়রদের কর্ম ও পেশা জীবনের কারুকার্য অর্জনই জুনিয়র আইনজীবীদের থাকে প্রথম লক্ষ্য। ইংল্যান্ডসহ বেশির ভাগ দেশেই এই বিষয়গুলো বার কাউন্সিল সনদপ্রাপ্তির পূর্ব শর্ত হিসেবে প্রাধান্য থাকলেও আমাদের দেশে বার কাউন্সিল সনদ প্রাপ্তিতে নেই এর বাধ্যবাধকতা। আর তাই আমাদের দেশে শিখতে হয় সিনিয়রকে ফলো করেই। এসব কারনেই হয়তো এখনও সিনিয়রের সম্মান এবং অগ্রাধিকার আইন অঙ্গনের বাধ্যতামূলক রেওয়াজ বা রীতি।
সময়ের পরিবর্তনে আমাদের আইন অঙ্গনে আইনজীবীদের সংখ্যা পূর্বের তুলনায় বেড়েছে বহুগুণ। বিশেষত গত ১০ বছরে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে কয়েক গুণ। এর প্রধান কারণ বিষয় এবং পেশা হিসেবে আইনের জনপ্রিয়তা। এবং সে কারনেই বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে আইন বিভাগের প্রবর্তন এখন আবশ্যিক। কিন্তু বিপত্তি বাঁধছে যে পরিমাণ মানুষ আইনজীবী হিসেবে সনদ গ্রহণ করছেন সে পরিমাণ সিনিয়র চেম্বার আমাদের নেই এবং যাও বা আছে সেখানে জুনিয়র উপস্থিতি সীমিত; আর তাই আইন অঙ্গনে জুনিয়র আইনজীবীদের আধিক্য থাকলেও যোগ্য জুনিয়র তৈরি হচ্ছে সংখ্যায় খুবই নগণ্য। অনেক জুনিয়রকে আবার গর্বের সাথে বলতে শোনা যায় সিনিয়র লাগেনা! একটা প্রচলিত প্রবাদ আছে- “যার জ্ঞান যত কম, তার ভয়ও তত কম”। এর অবশ্য আরেকটি বাস্তবিক কারণ হচ্ছে সুপ্রীম কোর্টে এখন বেশিরভাগ মামলাই আর সরাসরি প্র্যাকটিসরত আইনজীবী চেম্বারে আসেনা। কোর্টকে ঘিরে গড়ে উঠেছে বিশাল শক্তিশালী সিন্ডিকেট। সিনিয়র আইনজীবীদের শুধু সিনিয়র ব্রিফেই সীমাবদ্ধ থাকতে হয়। সিনিয়রদের চেম্বারে নেই আগের মত সিনিয়রের ডিকটেশন নিয়ে ড্রাফটিং করার প্রচলন। ড্রাফটিং চলে গেছে চার তলার কম্পিউটারে কপি-পেস্টের জগতে। আর সে কারনে সিনিয়রদেরও এখন আর সেরকম ভাবে জুনিয়রের প্রয়োজন হয়না বরং জুনিয়ররাই চারতলা থেকে মামলা রেডি করে কোর্ট অনুযায়ী সিনিয়র বাছাই করেন। ফলে সিনিয়রদের হাত গলে এখন আর কম্পিটেন্ট জুনিয়র তৈরী হয়না; যাদের হাতে ভবিষ্যত আইন অঙ্গন থাকবে নিরাপদ, হয়ে উঠবে নির্ভরতার প্রতীক, তার পরিবর্তে বরং আইনঅঙ্গনে তৈরি হচ্ছে বিশাল যোগ্য, প্রথিতযশা আইনজীবী শূন্যতা। এমন পরিস্থিতি বিরাজমান থাকলে জাতিকে ভীষণ ভয়াবহ ফলাফলের সম্মুখীন হতে হবে অতি নিকট ভবিষ্যতে। একই সাথে দেখতে হবে আমাদের আইন অঙ্গনের দীর্ঘ দিনের লালিত গৌরব বাধ্যতামূলক রেওয়াজ সিনিয়রকে সম্মান আর সিনিয়রের কাছ থেকে শেখার রীতির বিলুপ্তি।
গত কিছু দিন ধরে শিক্ষানবিশ আইনজীবী নাম নিয়ে আইনের কিছু শিক্ষানবিশ বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের পরীক্ষা গ্রহনের দীর্ঘসূত্রিতা বন্ধ করে নিয়মিত পরীক্ষা গ্রহণ এবং কোভিড-১৯ পরিস্থিতির কারনে গেজেটের মাধ্যমে সনদ দেয়ার দাবিতে আন্দোলন করছেন। নিয়মিত পরীক্ষা গ্রহণের দাবি খুবই যৌক্তিক; কিন্তু এই যৌক্তিক দাবি করতে গিয়ে তারা একটি অবান্তর দাবীও করে ফেলেছেন, আর তা হলো পরীক্ষা না নিয়ে গেজেট করে আইনজীবী হিসেবে তাদের ঘোষনা দেয়া। কতিপয় ব্যক্তির পরীক্ষার বৈতরণী পার হতে না পেরে পরীক্ষাকে ভয় পেয়ে এমন মহামারী পরিস্থিতিকে অগ্রায্য করে তাদের এই অবান্তর দাবী করতে গিয়ে অনেকে আবার ভাষা ও আচরণ জ্ঞান হারিয়ে ফেলছেন। হুমকির সম্মুখীন করছেন আইন অঙ্গনের বাধ্যতামূলেক রীতিকে। সিনিয়রদের উদ্দেশ্য করে অসম্মানমূলক বক্তব্য রাখছেন বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মাধ্যমে। বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট বারের সম্পাদক সাহেবের সাথে তাদের বাক্যবাণ আইনঅঙ্গনের গৌরব রেওয়াজকে ম্লান করে দিয়ে সকলকে করছে শঙ্কিত। এভাবে চলতে থাকলে ইতিহাসের ধারাবাহিকতা রক্ষায় বাংলাদেশের আইন অঙ্গনের অবস্থান কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা সংশ্লিষ্ট সকলকে এখনই ভাবতে হবে। কেননা বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট দেশের সমগ্র নাগরিকের শেষ ভরসার অপর নাম।
তামান্না ফেরদৌস: সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল।