মোঃ সাইফুদ্দীন হোসাইন :
১৯৭১ সালে ২৬ শে মার্চ মহান স্বাধীনতার ঘোষনার মধ্যে দিয়ে শুরু হওয়া দীর্ঘ নয় মাসের স্বশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে বাঙালী জাতি পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর কাছে থেকে স্বাধীনতা অর্জন করেন৷ পাকিস্তান আমলে জন মানুষের জন্য দীর্ঘ ২৩ বছরের সংগ্রাম ও অত্যাচার স্বীকার করার কারনে শেখ মুজিবুর রহমান ধীরে ধীরে বঙ্গবন্ধু ও জাতির জনক হয়ে উঠেন৷
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান আমলে ২৩ বছরে ৪ হাজার ৬৭৫ দিন তিনি কারাভোগ করেন। অথ্যাৎ ২৩ বছরের মধ্যে অর্ধেক সময়ের বেশি সময় ১২ বছর ২ মাস ২১ দিন দেশের মানুষের স্বাধীনতা ও অধিকার আদায়ের জন্য কারাভোগ করেন।
স্বাধীনতার পরপরই বঙ্গবন্ধু সরকার কল্যানমুখী সংবিধান প্রনায়ন করেন৷ সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা হয় যে, আমরা আরও অঙ্গীকার করিতেছি যে, আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা- যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে;
একজন সাধারন নাগরিকের সুবিচার নিশ্চিতের কথা দেশের সুপ্রিম আইন সংবিধানে বলা হলেও স্বয়ং জাতির জনক সহ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হত্যাকান্ডের সুবিচার নিশ্চিতকরনের জন্য দীর্ঘ ৩৪ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর সড়কের ৬৭৭ নম্বর বাসায় সপরিবারে কিছু বিপথগামী সেনা সদস্যদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হন।
পৃথিবীর ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় যে, যুগে যুগে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর হত্যাকান্ড অন্য যেকোন রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের থেকে ভিন্ন এবং একাডেমিক গবেষণার দাবি রাখে কয়েকটি কারনে যার প্রধান দু’টি কারন বলা যায়-
(১) শিশু মহিলা সহ পরিবারের সকল সদস্যকে হত্যা করা এবং হত্যার কারন অনুসন্ধানে।
(২) হত্যাকান্ডের পরে পুরো রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে আইন প্রনয়নের মাধ্যমে বিচারের পথকে বন্ধ করে দেওয়ার মানসিকতা (পৃথিবীর ইতিহাসে এমন আইন বিরল)
২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭৫ বঙ্গবন্ধু সহ তার পরিবারের সদস্যদের হত্যার বিচার রুদ্ধ করার জন্য খন্দকার মোশতাক বাংলাদেশ সংবিধানের ৯৩ অনুচ্ছেদের অপব্যবহার করে Indemnity Ordinance 1975 (Ordinance No XIX of 1975) জারি করেন। Indemnity Ordinance এর মাধ্যমে ঘোষণা করা হয় যে-
“Notwithstanding anything contained in any law, including a law relating to any defence service, for the time being in force, no suit, prosecution or other proceedings, legal or disciplinary, shall lie, or be taken, in before or by any Court, including the Supreme Court and court Martial, or other authority against any person including a person who is or has, at any time, been subject to any law relating to any defence service, for on account of or in respect of any act, matter or thing done or step taken by such person in connection with, or in preparation or execution or any plan for, or as necessary step towards, the change of Government of the People’s Republic of Bangladesh and the proclamation of Martial Law on the morning of the 15th August, 1975.
অধ্যাদেশের মূল কথা এক বাক্য বললে বলা যায় যে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড নিয়ে কোন মামলা করা যাবে না। কোন অবস্থাতেই এই হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত এবং পরিকল্পনাকারী দের বিচারের আওতায় নেওয়া যাবে না।
দীর্ঘ ২১ বছর পরে বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার পরে The Indemnity (Repeal) Act 1996 (Act No 21 of 1996) এর মাধ্যমে Indemnity Ordinance 1975 বাতিল ও অকার্যকর ঘোষণা করেন। একই সাথে এই আইনের মাধ্যমে ঘোষনা করা হয় যে, উক্ত অধ্যাদেশের মাধ্যমে কোন অধিকার বা সুযোগ সৃষ্টি হলে সেটা বাতিল হয়ে যাবে৷ এক্ষেত্রে General Clauses Act 1897 এর ০৬ ধারার বিধানবলী প্রযোজ্য হবে না। যার ফলে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের বিচার শুরুর বাধা দূর হয়।
১২ আগস্ট ১৯৯৬ বিশেষ ক্ষমতা আইনে কর্ণেল ফারুক সহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯৯৬ সালের ২ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুর বাড়িটির রিসিপশনিস্ট কাম রেসিডেন্ট পিএ আ ফ ম মহিতুল ইসলাম বাদী হয়ে ঢাকার ধানমণ্ডি থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন (মামলা নম্বর ১০(১০)৯৬)।
ঘটনাটি তদন্ত করে সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার আব্দুল কাহার আকন্দ ১৯৯৭ সালের ১৫ জানুয়ারি ১৯ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। হত্যাকাণ্ডের পর যুক্তরাজ্যে পালিয়ে যাওয়া ফারুক-রশিদ হত্যাকাণ্ডের কথা স্বীকার করে ১৯৭৬ সালে এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকার দেন। সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের ধারণকৃত ওই ভিডিওসহ ৪৬ ধরনের আলামত চার্জশিটের সঙ্গে আদালতে জমা দেওয়া হয়। সাক্ষী করা হয় ৭৪ জনকে। তদন্তে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদসহ আরও চারজনের বিরুদ্ধে প্রাথমিকভাবে অভিযোগ প্রমাণিত হলেও চার্জশিট দাখিলের আগেই তারা মৃত্যুবরণ করায় চার্জশিটে তাদের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
মামলাটির বিচার শুরু হলে ২০২ কার্যদিবসে ৬১ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ করেন আদালত। ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর ১৭১ পৃষ্ঠার রায়ে তৎকালীন ঢাকা মাননীয় জেলা ও দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুলের আদালত বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার ১৮ আসামির মধ্যে ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন। বাকিদের খালাসের রায় দেন তিনি।
বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আসামিরা আপিল করলে ২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর মহামান্য হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ বিভক্ত রায় দেন। মাননীয় বিচারপতি এম রুহুল আমিন ৫ আসামিকে খালাস দিয়ে ১০ জনের মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল রাখেন। অপরদিকে মাননীয় বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক ১৫ আসামির মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল রাখেন।
বিভক্ত রায় হওয়ায় নিয়মানুযায়ী একটি তৃতীয় বেঞ্চে পাঠান তৎকালীন প্রধান বিচারপতি। ২০০৭ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর তৃতীয় বেঞ্চের মাননীয় বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিম ১২ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। ৩ জনকে খালাস দেন তিনি।
মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকা ১২ আসামি হলেন— সাবেক মেজর বজলুল হুদা, লে. কর্নেল (বরখাস্ত) ফারুক রহমান, কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, একেএম মহিউদ্দিন (ল্যান্সার), লে. কর্নেল মহিউদ্দিন আহমেদ (আর্টিলারি), লে. কর্নেল (বরখাস্ত) খন্দকার আব্দুর রশিদ, মেজর (বরখাস্ত) শরিফুল হক ডালিম, মেজর (অব.) নূর চৌধুরী, রিসালদার মোসলেহ উদ্দিন খান, লে. কর্নেল (অব.) রাশেদ চৌধুরী, ক্যাপ্টেন (অব.) আব্দুল মাজেদ ও লে. কর্নেল আজিজ পাশা (অব.)।
মহামান্য হাইকোর্ট ডিভিশন এর রায়ের বিরুদ্ধে ০৫ জন সাজাপ্রাপ্ত আসামী কয়েকটি গ্রাউন্ড দেখিয়ে আপিল বিভাগে লিভ টু আপিল করেন। মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত আসামীরা নিম্নোক্ত গ্রাউন্ডে সাজা বাতিলের দাবি করেন-
(১) Because the learned Judges of the Division Bench have delivered and signed two separate dissenting opinions, the third learned Judge has committed a fundamental error of law in not considering the reference in its entirety i.e, in respect of all the convicts and considering the cases of six convicts only.
(২) Because there is inordinate delay of 21 years in lodging the F.I.R.; this unreasonable delay speaks of ill intention and design on the part of the prosecution to falsely implicate the appellants by introducing a concocted story the High Court Division, in the premises, erred in law in maintaining the capital sentence without properly considering this aspect of the matter
(৩) Because the evidence on record disclose a case of mutiny leading to the murder of the then President and his family members and thus the said killing not being a case of murder simplicitor, the trial of the appellants by a normal criminal court has vitiated the trial.
(৪) Because the evidence on record do not disclose a case of a criminal conspiracy to commit murder but disclose a case of conspiracy to commit mutiny to change the then Mujib Government, hence the conviction and sentence are illegal.
(৫) Because the prosecution having failed to prove the charge under section 302/34 of the Penal Code against the appellants on proper evaluation and sifting of evidence on record, there has been a serious miscarriage of justice.
মহামান্য সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগ মৃত্যু দন্ডপ্রাপ্ত আসামীদের আপিল খারিজ করেন এবং হাইকোর্ট এর সাজা বহাল রাখেন।
মহামান্য সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগ অভিমত প্রদান করেন যে “Sections 378 and 429 of the Code of Criminal Procedure contemplate that it is for the third learned Judge to decide on what points he shall hear arguments, if any, and, that postulates that he is completely free in resolving the difference as he thinks fit, and therefore, the third learned Judge was competent to decide the case of six convicts of whom the learned judges were equally divided in their opinion and thus the third learned Judge was in agreement with the decision of the learned Judges of the Division Bench in respect of 9(nine) convicts of whom there was no difference of opinion.
মহামান্য সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগ অভিমত প্রদান করেন যে ” The learned Sessions Judge as well as the learned Judges of the High Court Division have believed the explanation given by the prosecution regarding the delay in lodging the First Information Report on assessment of the evidence on record; this finding being a concurrent finding of fact, in our view, does not call for any interference.
মহামান্য সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগ অভিমত প্রদান করেন যে “An offence of murder has been included in section 59(2) of the Army Act, 1952 triable under the Army Act subject to the condition that if the offender commits the said offence while in ‘active service’, but as the appellants were not in ‘active service’ within the meaning of section 8(1) of the Army Act, their trial by an ordinary criminal Court is not barred by the provisions of the Army Act, and secondly, even if it is assumed that it is a ‘civil offence’ within the meaning of Section 8(2) of the Army Act, there is no legal bar for trial of such offence in view of section 94 of the said Act.
মহামান্য সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগ অভিমত প্রদান করেন যে “There is no legal evidence, no record to come to the conclusion that the murder of Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman and other members of his family including the three security personnel was committed as a consequence of mutiny, we are of the view that it is not a case of criminal conspiracy to commit mutiny, rather it is a criminal conspiracy to commit the murder of Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman and other members of his family.
মহামান্য সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগ অভিমত প্রদান করেন যে “The learned Judges of the High Court Division having believed that the prosecution has been able to prove beyond reasonable doubt the charge of murder against the appellants and other convicts by adducing reliable evidence, and the appellants having failed to make out a case that the High Court Division has caused a grave substantial injustice or a miscarriage of justice in accepting the death reference so far as it relates to the appellants without proper evaluation and sifting of evidence, we find no cogent ground to interfere with the impugned judgment and order of the High Court Division.
The Appellate Division observed that” The appellants having failed to make out a case of extenuating circumstance to commute their sentence of death, we are not inclined to interfere with the sentence of death awarded to the appellants by the learned Sessions Judge and maintained by the High Court Division.
মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া ১২ আসামির মধ্যে পাঁচজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি। তারা হলেন— সাবেক মেজর বজলুল হুদা, লে. কর্নেল (বরখাস্ত) ফারুক রহমান, কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, একেএম মহিউদ্দিন (ল্যান্সার) ও লে. কর্নেল মহিউদ্দিন আহমেদ (আর্টিলারি)। তাদের মধ্যে বজলুল হুদাকে থাইল্যান্ড ও মহিউদ্দিন আহমেদকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরিয়ে এনে দণ্ড কার্যকর করা হয়।
২০২০ সালের ০৭ এপ্রিল ক্যাপ্টেন (অবসরপ্রাপ্ত) আবদুল মাজেদকে গ্রেফতার করা হয় এবং ১২ এপ্রিল তার মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। বর্তমানে ১২ জনের মধ্যে চার জন বিদেশে পালিয়ে রয়েছে। পলাতকরা হলো খন্দকার আবদুর রশিদ, শরিফুল হক ডালিম, এএম রাশেদ চৌধুরী, এসএইচ নূর চৌধুরী। তাদের সাজা ও অবিলম্বে কার্যকর হবে আশা করা যায়।
বিভিন্ন সময়ে পুরো রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সহ ১৫ আগস্ট হত্যাকান্ডের বিচারের পথ রুদ্ধ করে রাখা হয়।বিচার প্রক্রিয়া কার্যকর করতে প্রায় ৩৪ বছর সময় কেটে যায়। দেরিতে হলেও বিচার প্রক্রিয়ার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সুবিচার নিশ্চিতকল্পে বিচার বিভাগের অবদান অনস্বীকার্য।
মোঃ সাইফুদ্দীন হোসাইন : জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত, যশোর।