মোঃ জাকির হোসাইন: সাম্প্রতিককালে কিশোর গ্যাং নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। এই বছরের শুরুতে আমাদের বেশ কিছু জাতীয় পত্রিকায় কিশোর গ্যাং এর অপরাধ ও তাদের বেপরোয়া চলাফেরা নিয়ে সিরিজ আকারে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। গত বছর ও এই বছর আমাদের গণমাধ্যমগুলো জানায়, ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরে শতাধিক কিশোর গ্যাং অপরাধমূলক কার্যক্রমে জড়িত। কিশোর গ্যাং এর সদস্যদের অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার ও বহন, মাদক সেবন ও বিক্রি, সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজীর অভিযোগ আছে। বেশির ভাগ কিশোর গ্যাং মাদক সেবন সহ স্থানীয় পর্যায়ে অন্যান্য অপরাধের সাথে সরাসরি জড়িত মর্মে তথ্য প্রকাশ পায়।
শিশু ও কিশোররা জড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সাথে। এই কিশোররা সমাজের মধ্যে নিজেদের মতো করে নতুন এক সমাজ গড়ে তুলছে। ওই সমাজের সংস্কৃতি, ভাষা, বিশ্বাস, মূল্যবোধ, আচার-আচরণ সবকছিু আলাদা। বিগবস, নাইন এমএম, নাইন স্টার, ডিসকো বয়েজ ইত্যাদি নামে গড়ে তুলছে অদ্ভূত এবং মারাত্মক সব কিশোর গ্যাং। যার ফলে সংঘটিত হচ্ছে নানাবিধ অপরাধ। তিন বছর আগে উত্তরায় ডিসকো বয়েজ ও নাইন স্টার গ্রুপের অর্ন্তদ্বন্দ্বে খুন হয় ট্রাস্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণীর ছাত্র আদনান কবির। আদনান হত্যাকাণ্ডরে মধ্যে দিয়েই আলোচনায় আসে কিশোর গ্যাং। অন্যদিকে রাজধানীসহ জেলা শহরগুলোতেও বেরিয়ে আসে কিশোরদের গ্যাং কালচার এবং তাদরে সংঘবদ্ধ অপরাধের ভয়ঙ্কর সব চিত্র।
বাংলাদেশের বিগত কয়েক বছরের অপরাধ পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, আমাদের অনূর্ধ্ব ১৮ বছর বয়সের শিশু ও কিশোরগণ বিভিন্ন প্রকার অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ছে। হত্যা, ধর্ষণ, চাঁদাবাজী, ডাকাতি, মাদক সেবন ও মাদক বিক্রয়ের মত অপরাধগুলোতে প্রায় প্রতিদিনেই কিশোরেরা জড়িত থাকার প্রতিবেদন প্রকাশ পাচ্ছে। এমনকি কিছু কিছু ঘটনা খুবই লোমহর্ষক ও ভীতিকর। গত ফেব্রুয়ারী মাসে একজন শিশু অভিযুক্তকে হত্যা মামলায় ও গত ১৩ আগস্ট বরগুনায় ধর্ষণ মামলায় দুই জন শিশু অভিযুক্তকে ১০ বছর (সর্বোচ্চ শাস্তি) কারাদন্ড দেয়া হয়। বরগুনায় আলোচিত রিফাত হত্যা মামলায় বেশ কয়েকজন শিশু (যাদের বয়স ১৮ বছরের কম) অভিযুক্তের বিচার শেষ পর্যায়ে আছে। এই বিষয়গুলো ইঙ্গিত করে যে, কিশোর কালচার ভয়ংকর পর্যায়ে আছে।
গত কিছু দিন ধরে বাংলাদেশে টিকটক ও লাইকি অ্যাপের ব্যবহার নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে। সাধারণত কিশোর ও তরুণ বয়সের ছেলে মেয়ে এই অ্যাপগুলো ব্যবহার করে তাদের অনুভূতি বিভিন্ন কার্যক্রম ভিডিও এর মাধ্যমে অনলাইনে প্রকাশ করেন। সাম্প্রতিককালে উক্ত অ্যাপগুলো ভারতের পাশাপাশি বাংলাদেশে খুবই জনপ্রিয় হচ্ছে। অনেকে উক্ত অ্যাপগুলো ব্যবহার করে তারকা খ্যাতি অর্জন ও অর্থ উপার্জন করার চেষ্টা করছে। তারকা খ্যাতি, হিরোইজম, ক্ষমতা, বয়সের অপরিপক্কতা, অর্থলোভ, শিক্ষাব্যবস্থার ঝুঁকি এবং পারিবারিক বন্ধন দুর্বল হওয়ায় তাদের সামাজিকীকরণ ও মানসিক বিকাশ দারুণভাবে ক্ষতগ্রিস্থ হচ্ছে যার ফলশ্রুতিতে সমাজের বিভিন্ন গ্যাং কালচারের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ছে কিশোররা। যেখানে শিশু-কিশোরদের সামাজিকীকরণের প্রথম ধাপ ছিল পরিবার কিন্তু আধুনিক ও তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে সেখানে তার স্থালাভিষিক্ত হচ্ছে বিভিন্ন ধরণের সোশ্যাল মিডিয়া।
সম্প্রতি সোশাল মিডিয়া ও ইউটিউব দেখে এবং বেশকিছু টিকটক ভিডিও ও লাইকি ভিডিও দেখি, যা রুচির অযোগ্য এবং ভাষায় প্রকাশ করার মত নয়। বিকৃত অঙ্গভঙ্গি এবং অশ্লীল শব্দ ও যৌনতা প্রয়োগ করে শুধুমাত্র সস্তা জনপ্রিয়তা পাওয়ার উদ্দেশ্যে এই ভিডিওগুলো তৈরী করে আপলোড করা হয়। টিকটক ও লাইকি ভিডিও যারা নির্মাণ করেন, তাদের প্রায় ৮০% কিশোর-কিশোরী বয়সের। ভিডিও নির্মাণ ও তার জনপ্রিয়তায় ইঙ্গিত করে, আমাদের সমাজের চরম অবক্ষয় হচ্ছে ও নেতিবাচক কাজ দ্রুত জনপ্রিয় হচ্ছে। অভিভাবকগণ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো শিশুদের মননশীলভাবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে ব্যর্থ হচ্ছে।
বাংলাদেশ সরকার ২০১৩ সালে শিশু আইন প্রনয়ণ ও কার্যকর করেন। জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ ১৯৮৯ ও শিশু আইন, ২০১৩ অনুযায়ী অনূর্ধ্ব ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত প্রত্যেক ব্যক্তি শিশু। তাদের অপরাধ সংক্রান্ত বিষয়ে বিচার ও তদন্ত শিশু আইন, ২০১৩ অনুযায়ী হবে। শিশু অভিযুক্তের বিচারের জন্য বর্তমানে প্রত্যেক জেলায় শিশু আদালত রয়েছে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসাবে শিশু আদালতের দায়িত্বে রয়েছে। দেশে বর্তমানে প্রায় ৫০ হাজার মামলা শিশু আদালতগুলোতে বিচারাধীন আছে।
শিশু আইন, ২০১৩ অনুযায়ী শিশুদের বিচারের ক্ষেত্রে ও আদালতে উপস্থাপনের ক্ষেত্রে বেশকিছু নির্দেশনা আছে। জেলা সমাজ সেবা অফিস, প্রবেশন কর্মকর্তা ও প্রত্যেক থানায় শিশু ডেস্কের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তার শিশু অভিযুক্তকে নিয়ে আইনের আলোকে বিভিন্ন প্রকার দায়িত্ব রয়েছে। শিশু অভিযুক্তদের নিয়ে কাজ করার জন্য বেশকিছু সেইফ হোম ও ৩টি শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র রয়েছে টঙ্গি, গাজীপুর ও যশোরে। শিশু অভিযুক্তরা মূলত জামিনের পূর্ব পর্যন্ত ও দন্ড উক্ত উন্নয়ন কেন্দ্রগুলোতে ভোগ করে। অভিয্ক্তুদের মানসিক উন্নয়নে কেন্দ্রগুলোর কার্যক্রম সন্তোষজনক নয়। উন্নয়ন কেন্দ্রগুলোতে শিশুদের মানসিক বিকাশের লক্ষ্যে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। পৃথক শিশু আদালত গঠন, পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা প্রদান এবং শিশুদের সংশোধন করার লক্ষ্যে আদালত যাতে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারে, সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। শিশুদের মানসিক উন্নয়ন, অপরাধ থেকে ফেরাতে সরকার কে সমন্বিত ঊদ্যোগ নিতে হবে।
সমাজের নানা ক্ষেত্রে শিশু নির্যাতন-নিপীড়ন-হত্যার মতো ভয়াবহ খবর প্রায়ই সংবাদমাধ্যমে উঠে আসে। কিন্তু গত ১৩-১৫ আগস্ট দেশের প্রায় সকল সংবাদমাধ্যমে যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে তিন শিশু হত্যাসহ আরও ১৫ শিশুকে বেদম পিটিয়ে আহত করার যে চিত্র উঠে এসেছে তা এক কথায় বীভৎস। যাদের দায়িত্ব ছিল সংশোধনাগারে শিশুদের শুধু দেখভালই নয়, নৈতিক শিক্ষার মাধ্যমে সংশোধন করা- তারাই হন্তারক হয়ে দাঁড়ালেন! সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ, ৩ আগস্ট ওই কেন্দ্রের এক আনসার সদস্যকে মারধর করাকে কেন্দ্র করে এই নির্মম ঘটনা ঘটানো হয়। দেশে এমন ঘটনা এটাই প্রথম নয়। আমাদের প্রশ্ন কিশোর অপরাধের প্রতিকারে ‘কিশোর সংশোধনাগার’ কিংবা ‘শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র’ গুলো কতোটা কাজ করে? এ অভযিোগ নতুন নয় যে, এই কেন্দ্রগুলোর পরিবেশ, প্রশিক্ষণ ও সেবা কার্যক্রম অত্যন্ত নিম্নমানের। বলতে গেলে আচরণ সংশোধন কার্যক্রম নয়, এগুলো যেন নিছক আটকখানা। শিশুদের আটকে রাখা সহজ কিন্তু তাদের মনন, স্বভাব-চিন্তায়-আচরণে মৌলিক পরিবর্তন আনার কাজটি এত সহজ নয়। এর জন্য সৃজনশীল উদ্ভাবনী কার্যকর পদ্ধতি অত্যন্ত জরুরি হলেও সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলরা এর ধারে কাছেও নেই- বিদ্যমান বাস্তবতা এরই সাক্ষ্যবহ। এই ঘটনায় কেন্দ্রের সহকারী পরিচালককে সাসপেন্ড ও ১০ জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও সমাজসেবা অধিদপ্তর পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।
উপর্যুক্ত আলোচনায় এট স্পষ্ট যে, বাংলাদেশে শিশু ও কিশোরদের অপরাধ প্রবনতা অনেক বেড়েছে। মোবাইলের সহজলভ্য ব্যবহার, ফেসবুক, টুইটার, টিকটকের আসক্তি ও অন্যদের সাথে পরিচয়, অপরিণত বয়সে সর্ম্পকে জড়ানো, রাজনৈতিক সংশ্লেষ ও মাদক সেবন কিশোর ও যুব সমাজকে বিপথে পরিচালিত করছে। চাকরীর সুবাদে বেশকিছু শিশু অভিযুক্তকে দেখতে পাই, যারা মূলত ফেসবুক ও সমবয়সী বন্ধুদের মাধ্যমে এবং মাদক সেবনের ফলে অপরাধে জড়িত হন।
বর্তমান কিশোর গ্যাং এর অপরাধমূলক কার্যক্রম বিবেচনায় নিলে এটা সহজেই প্রতীয়মান হয় যে, শিশু কিশোরা বিভিন্ন প্রকার অপরাধ কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়ছে এবং এই হার দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখনি সঠিক পদক্ষেপ না নিলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হুমকির মধ্যে পড়বে। শিশু ও কিশোরদের লোমহর্ষক বিভিন্ন অপরাধমূলক কার্যক্রমের হারও বৃদ্ধি পাবে। অভিভাবকদের সচেতনতা, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণ, সাইবার অপরাধ সর্ম্পকে ও প্রযুক্তি ব্যবহারে সচেতনতা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর আরো বেশি মননশীল উদ্যোগ ও সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কার্যকর সমন্বিত অংশগ্রহণের মাধ্যমে এই অবস্থা হতে উত্তোরণ সম্ভব।
মোঃ জাকির হোসাইন: বাংলাদেশ বিচার বিভাগের সদস্য ও সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, ফেনী।