কক্সবাজারের চকরিয়ায় চুরির অভিযোগে মা ও মেয়ের উপর বিচারবহির্ভূত নির্যাতনের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এন্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট)। পাশাপাশি ঘটনার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত এবং দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবী মানবাধিকার সংগঠনটি।
আজ মঙ্গলবার (২৫ আগস্ট) গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানা গেছে।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত ২১শে আগস্ট শুক্রবার কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার হারবাং ইউনিয়নের পঁহরচাঁদা এলাকায় গরু চুরির অভিযোগে মা-মেয়েকে রশিতে বেঁধে এলাকা ঘুরিয়ে ইউপি কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে চেয়ারম্যান মিরানুল ইসলাম তাঁদের আবার মারধর করেন। নির্যাতনের একপর্যায়ে মা-মেয়ের শারিরীক অবস্থার অবনতি হলে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়। পরে তাঁদের চকরিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ হতে এ সকল তথ্য জানা যায়। শনিবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মা-মেয়ের এই নির্যাতনের ভিডিওটি প্রকাশ পায় এবং ভাইরাল হয়। ভিডিওতে দেখা যায়, মা ও মেয়েকে (নারীদেরকে) প্রকাশ্যে রাস্তায় ঘোরানো হচ্ছে। একপর্যায়ে হারবাং ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।
শনিবার গরুর মালিক বাদী হয়ে গরু চুরির অভিযোগে পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। পরে তাঁদের চকোরিয়া সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এন্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) এ ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে ও তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে। পাশাপাশি ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তসহ জড়িত দোষী ব্যক্তিদের যথাযথ বিচার ও শাস্তিদাবী করছে।
বিচারবর্হিভূত শাস্তি প্রদানের ক্ষমতা বা এখতিয়ার কারো নেই তা সত্ত্বেও কেন এই ধরণের ঘটনা সংঘটিত হয়। সংশ্লিষ্ট ইউএনও, জেলা প্রশাসক এবং পুলিশ প্রশাসন এই ধরনের ঘটনা সংঘটিত হয়েছে জানার পর কি ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে বিষয়গুলো নিয়ে যথাযথ তদন্তের দাবী জানাচ্ছে ব্লাস্ট। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, গরু চুরির ঘটনা নয় বরং নির্যাতিত মা স্থানীয় ইউনিয়ন চেয়ারম্যানের প্রস্তাব অনুযায়ী তার মেয়েকে বিয়ে দিতে রাজী না হওয়ায় উক্ত চেয়ারম্যান ও তার অনুগত লোকজন ঐ মা ও মেয়ের বিরুদ্ধে মিথ্যা গরু চুরির অভিযোগ আনে। মা ও মেয়ের বিরুদ্ধে যে অভিযোগই আসুক না কেন, আইন অনুযায়ী উক্ত চেয়ারম্যান তাদেরকে কোন ধরনের শারীরিক ও মানসিক শাস্তি প্রদান করতে পারেনা। কোন নারীকে এই ধরনের শারীরিক ও মানসিক শাস্তি ও সম্মানহানী সংবিধান ও বাংলাদেশের প্রচলিত আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। বিশেষভাবে বাংলাদেশের সংবিধানে ২৭ (আইনের দৃষ্টিতে সকলে সমান এবং আইনের আশ্রয় লাভের অধিকারী), ৩১ (আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না যাতে কোন ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে), ৩২ (আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতা হতে কোন ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাইবে না এবং ৩৫(৫) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কোনো ব্যক্তিকে নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দন্ড দেয়া যাবেনা। নারী ও শিশুনির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধনী ২০০৩) অনুযায়ীও তা দন্ডনীয় ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
বিচারবহির্ভূত শাস্তি বন্ধে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট), আইন ও সালিশ কেন্দ্র, নিজেরা করি, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ এবং ব্র্যাক এই ৫টি মানবাধিকার সংগঠন হাইকোর্ট বিভাগে রিট আবেদন করেন। তৎকালীন সমসাময়িক সময়ে বিচ্ছিন্ন ঘটনায় প্রতিকার চেয়ে আরো দু’টো রিট আবেদন করা হয় (রিট আবেদন নং ৫৮৬৩/২০০৯, ৭৫৪/২০১০ এবং ৪২৭৫/২০১০)। অবশেষে এই তিনটি জনস্বার্থ মামলা একসঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে আদালত বিচারবহির্ভূত শাস্তি প্রদান নিষিদ্ধ করে একটি যুগাস্তকারী রায় প্রদান করেন।
হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী-
- বিচারবহির্ভূত শাস্তি প্রদান ও তা কার্যকর করা নিষিদ্ধ ও বে-আইনী কাজ।
- এ ধরনের শাস্তি প্রদানকারী ও শাস্তি প্রদানে সহায়তা প্রদানকারী ব্যক্তি দন্ডবিধি ও রাষ্ট্রের অন্যান্য আইনে দায়ী হবেন।
বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এন্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) এই ঘটনার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তসহ অভিযুক্ত ও দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দ্রুতবিচার ও যথাযথ শাস্তিপ্রদানের জোর দাবী জানাচ্ছে। বিচারবহির্ভূত শাস্তি বন্ধে হাইকোর্টের নির্দেশনা বাস্তবায়নসহ ভবিষ্যতে এ ধরণের নির্যাতনের ঘটনা যেন আর না ঘটে সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ ও নিয়মিত তদারকির জোর দাবী জানায় ব্লাস্ট।