মাজহারুল ইসলাম:
“ব্যক্তির গোপনীয়তা” হলো একটি মৌলিক মানবাধিকার যা আন্তর্জাতিক আইন দ্বারা স্বীকৃত এবং ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ব্যক্তির গোপনীয়তাকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেছে। ব্যক্তির গোপনীয়তার সম্পর্কে সাম্প্রতিক ও বিতর্কিত বিষয়গুলির অন্যতম হচ্ছে প্রাঙ্ক ভিডিও বা স্থিরচিত্র । যা সাধারণ মানুষকে বোকা বানানোর মাধ্যমে তাদের ভিডিও ধারণ করে বিনোদন ও টাকা উপার্জনের জন্য ইউটিউব সহ অন্যান্য ওয়েবসাইটে আপলোডের মাধ্যমে ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়ে রাতারাতি তারকা বনে যাওয়ার স্বপ্নে বিকৃত রুচির কাজ করে যাচ্ছে কিছু উঠতি বয়সের তরুণ এবং তা বর্তমান সময়ে উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই ধরনের ভিডিও যদিও দর্শকদের বিনোদনের খোরাক হিসেবে পরিচিত কিন্তু এর দেশীয় ও আন্তর্জাতিক আইনে গুরুতর প্রভাব সম্পর্কে আমরা অসচেতন। কতিপয় প্রাঙ্ক ভিডিও ধারণকারী “ব্যক্তির গোপনীয়তা রক্ষা ভঙ্গের জন্য” অভিযুক্ত হওয়ায় এর আইনগত দিক নিয়ে আলোচনা প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩২ অনুসারে
“কোন ব্যক্তি আইন বা আইন অনুযায়ী ব্যক্তি–স্বাধীনতা বা ব্যক্তির গোপনীয়তা হতে বঞ্চিত হবে না“।
একইভাবে অনুচ্ছেদ ৪৩ অনুযায়ী
“যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ–সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের গোপনীয়তা রক্ষার বা ব্যক্তির গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার থাকবে“।
এ দুটি অনুচ্ছেদের উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশ মানবাধিকার ফাউন্ডেশন (২০১১) সালে একটি রিট পিটিশন ফাইল করে বাংলাদেশ হাইকোর্ট ডিভিশনে একজন ভুক্তভোগী মহিলার পক্ষে। ভুক্তভোগী মহিলা পার্লারে গিয়ে দেখতে পায় গোপনীয় ভাবে তার ভিডিও ধারণ করা হচ্ছে। ফলস্বরূপ হাইকোট বিভাগ সরকারকে পার্লারে গোপনীয়ভাবে স্থাপন করা ক্যামেরা সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দেয় এবং অধিকতর তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ প্রদান করেন।
উপরন্তু ২০১৭ সালের জুলাই মাসে আরো একটি ঘটনা আপামর জনসাধারণের মনে দাগ কেটে যায়। একটি মেয়ে পার্কে বসা ছিল সে সময় কয়েকটি অপরিচিত ছেলে তার সামনে কৃত্রিম সাপ ছুড়ে ফেলে, বাস্তব সাপ ভেবে মেয়েটি দৌড়ে পালানোর সময় পড়ে যায় এবং আঘাত পায়। মেয়েটি বলেঃ
“আমি একদিন চন্দ্রিমা উদ্যানে গিয়েছি আমার ফ্রেন্ডের সঙ্গে দেখা করতে। ও আসেনি, তাই কিছুক্ষণ অপেক্ষা করছিলাম। এরই মধ্যে একটি ছেলে এসে আমাকে বলে, আপু আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাই। আমি বলি– বলুন? এটা বলার সঙ্গে সঙ্গেই সে পেছন থেকে একটি সাপ বের করে আমার সামনে ধরে। তখন আমি হঠাৎ দেখেই ভেবেছিলাম, সেটা হয়তো সত্যিই সাপ। আমি ভয়ে দৌড় দেই। দৌড়াতে গিয়ে আমি ইটের সঙ্গে বাধা পেয়ে রাস্তার ওপর পড়েও যাই। পড়ে গিয়ে প্রচুর ব্যথা পাই। এসময় আমার এমন দৌড় দেখে চারদিকের মানুষগুলো অনেক জোরে জোরে হাসছিল। এক পর্যায়ে ওই ছেলেসহ আরও কয়েকজন এসে আমাকে বলে, ‘আপু আমরা প্র্যাঙ্ক (কৌতুক) করেছি।’ কিন্তু আমি তখনও ভয়ে কাঁতরাতে থাকি। মনে হচ্ছিলো, আমি ওদের সবগুলোকে ধরে ইচ্ছামতো মার দেই। কারণ, ওরা আমার দুর্বলতা নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করলো। আমি ওইদিন রীতিমত হেনস্থার শিকার হলাম।’’ (Bangle Tribune, 20 July 2017)
অতঃপর ভিডিওটি ইউটিউবে আপলোডের এর মাধ্যমে বিনোদন ও টাকা উপার্জনের অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়। এই ক্রমবর্ধমান সমস্যা দেখে হাইকোর্টের আইনজীবী নূর মোহাম্মদ আজমি একটি রিট আবেদন করেন হাইকোর্ট ডিভিশনে এ বিষয়ে একটি নির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়নের জন্য। বর্তমানে সেটি চূড়ান্ত শুনানির জন্য অপেক্ষমাণ রয়েছে। এ ধরনের প্রাঙ্ক ভিডিও জনসাধারণের উপদ্রবের পাশাপাশি ব্যক্তির গোপনীয়তা রক্ষার অধিকারকে হুমকির সম্মুখীন করে তুলেছে যা দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী। প্রাঙ্ক ভিডিও বা স্থিরচিত্র ব্যক্তির জন্য মানহানিকর দন্ডবিধির (১৮৬০) ধারা ৪৯৯, ৫০০ অনুযায়ী। দন্ডবিধির ধারা ৫০০ অনুযায়ী প্রাঙ্ক ভিডিও বা স্থিরচিত্র ধারণকারীর ২ বছরের কারাদণ্ড ও জরিমানা বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ধারা ২৮ এবং ২৯ অনুযায়ী প্রাঙ্ক ভিডিও ধারণ অপরাধ, কেননা এটি ব্যক্তির জন্য মানহানিকর। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন অনুযায়ী ভিডিও ধারণকারীর ৩ বছরের কারাদণ্ড ও ৫ লক্ষ টাকা জরিমানা বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারে।
২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে দিল্লী পুলিশ ইউটিউবকে অশ্লীল কার্যকলাপে উৎসাহ প্রদানের জন্য দায়ী করে একটি প্রাঙ্ক ভিডিও সূত্র ধরে। এতে দেখা যায় একটি ছেলে নিউ দিল্লির কর্ণট প্লেস নামক জায়গায় জনসাধারণের মাঝ থেকে কিছু মেয়েকে চুমু দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। পুলিশ তদন্ত করতে গিয়ে দেখতে পায় যে, পূর্ব পরিকল্পিতভাবে তারা এই প্রাঙ্ক ভিডিও ধারণ করেছে টাকা উপার্জনের পন্থা হিসেবে।কিন্তু অনেক সময় এটি পূর্বপরিকল্পিত বা অভিযুক্তের অনুমতি সাপেক্ষে নাও হতে পারে। যদিও এতে পূর্বঅনুমতি নেওয়া হয়ে থাকে তবুও এটি সামাজিক নীতি নৈতিকতা পরিপন্থী।
ভারতে ব্যক্তির গোপনীয়তার সম্পর্কিত প্রথম মামলা কি হচ্ছে এমপি সারমা এবং অন্যান্য বনাম সতীশচন্দ্র জেলা ম্যাজিস্ট্রেট নতুন দিল্লি (১৯৫৪) যেখানে ব্যক্তির গোপনীয়তা রক্ষাকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়নি। তেমনি ভাবে খারাক সিং বনাম স্টেট অফ উত্তরপ্রদেশ (১৯৬২) ব্যক্তির গোপনীয়তাকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেনি। কিন্তু বিচারপতি পি এস পাতূসুয়ামি (অবসরপ্রাপ্ত) বনাম ইউনিয়ন অফ ইন্ডিয়া ৯ জন বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চে ২৫ শে আগস্ট ২০১৭ সালে ব্যক্তির গোপনীয়তাকে জীবন এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে এবং ব্যক্তির গোপনীয়তা সম্পর্কিত পূর্ববর্তী মামলাসমূহ কে অকার্যকর ঘোষণার মাধ্যমে নতুন রায়কে অতিদ্রুত কার্যকর করার নির্দেশ প্রদান করেন। আদালত মতামত প্রদান করেন যে “ব্যক্তির গোপনীয়তা বৈচিত্রতা রক্ষা করে এবং আমাদের সাংস্কৃতির বৈচিত্র্যকে স্বীকার করে। এটি গুরুত্বপূর্ণ যে ব্যক্তির গোপনীয়তা এমন একটি বিষয় যা কখনো হারিয়ে যাবে না এবং কেউ ব্যক্তির গোপনীয়তার উপর বাধা সৃষ্টি করতে পারবে না যেকোন স্থান কাল পাত্রভেদে“।
“ব্যক্তির গোপনীয়তা রক্ষার” বিষয়টি আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক কনভেনশন দ্বারা স্বীকৃত যেমন মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্র, আইসি সিপি আর, চাইল্ড কনভেনশন, মাইগ্রেন ওয়ার্কার্স কনভেনশন ও ইউরোপিয়ান কনভেনশন অফ হিউম্যান রাইটস্ ইত্যাদি। অনুচ্ছেদ ১২ মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্র মতে “কারো ব্যক্তিগত গোপনীয়তা কিংবা তাহার গৃহ পরিবার ও চিঠিপত্রের ব্যাপারে খেয়াল খুশিমতো হস্তক্ষেপ কিংবা কিংবা তাহার সুনাম ও সম্মানের উপর আঘাত করা চলবে না। এ ধরনের হস্তক্ষেপ বা আঘাতের বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার প্রত্যেকেরই রয়েছে“। অনুচ্ছেদ ১১ আমেরিকান কনভেনশন অফ হিউম্যান রাইটস্ও ব্যক্তির গোপনীয়তা রক্ষার বিষয়টি মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্র অনুযায়ী বর্ণনা করেছে। উপরন্তু অনুচ্ছেদ ৮(১) ইউরোপিয়ান কনভেনশন অফ হিউম্যান রাইটস্ অনুযায়ী “প্রত্যেকেরই তার ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক জীবনের গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার রয়েছে“/ । আইসি সিপি আর, অনুচ্ছেদ ১৭(১) অনুযায়ী ব্যক্তির গোপনীয়তা রক্ষার বিষয়টিকে অত্যাধিক গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। বাংলাদেশ বেশীরভাগ গুরুত্বপূর্ণ কনভেনশন গুলোর সাক্ষারকারী দেশ, অতএব সরকার কোন ভাবেই ব্যক্তির গোপনীয়তা রক্ষার বিষয়টিকে এড়িয়ে যেতে পারেনা।
ভন হ্যানোভার বনাম জার্মানি (২০০৪) মামলায় ইউরোপিয়ন কোর্ট অফ হিউম্যান রাইটস্ ব্যক্তির গোপনীয়তা রক্ষাকে মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের মাধ্যমে জার্মান ফেডারেল কনস্টিটিউশনাল কোর্টের রায়কে অকার্যকর ঘোষণা করেন। মোনাকোর ক্যারোলিনের রাজকুমারীর ছবি তার অনুমতি ব্যতীত প্রকাশ প্রসঙ্গে মামলাটি হয়। ছবিগুলি মাধ্যমে তার প্রাত্যহিক জীবনের অংশবিশেষ ফুটে ওঠে যেমন তার খাওয়া দাওয়া, সাইকেল চালানো এবং কেনাকাটার বিষয়গুলি। ইউরোপিয়ন কোর্ট অফ হিউম্যান রাইটসের রায় অনুযায়ী, জার্মান অনুচ্ছেদ ৮ ইউরোপিয়ান কনভেনশন অফ হিউম্যান রাইটস্ ভঙ্গের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়। আদালতের রায় অনুযায়ী “প্রত্যেকেরই ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষার বিষয়টি মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃত জনসাধারণ এতে বাধা সৃষ্টি করবে না। এমনকি জনসাধারণ কখনো কোন ব্যক্তির একান্ত ব্যক্তিগত বা গোপনীয় বিষয়ে জানার আগ্রহ প্রকাশ করবে না তাঁহার অনুমতি ব্যতিত এমনকি সে যদি জনবহুল স্থানেও থাকে“।
সুতরাং এখনই উপযুক্ত সময় যারা প্রাঙ্ক ভিডিও তৈরীর মাধ্যমে ব্যক্তির গোপনীয়তা রক্ষার অধিকারকে হরণ করে নেহায়েৎ মজা বা অর্থ উপার্জনের উদ্দেশ্যে, তাদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থার মাধ্যমে ব্যক্তির গোপনীয়তা রক্ষার অধিকারকে সমুন্নত রাখা। অতএব সরকারের উচিত আইনি দুর্বল দিকগুলো খুঁজে বের করে এর সংশোধনমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করার মাধ্যমে ব্যক্তির গোপনীয়তা রক্ষার অধিকারকে নিশ্চয়তা প্রদানের পাশাপাশি অপরাধী চক্রকে আইনের আওতায় এনে উঠতি অপরাধী চক্রের কাছে সতর্কবার্তা পৌঁছে দেওয়া। যাতে করে ব্যক্তির একান্ত গোপনীয় অধিকারগুলোকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলার অপচেষ্টায় কেউ লিপ্ত হতে না পারে।
মাজহারুল ইসলাম: পিএইচডি গবেষক সাউথ এশিয়ান ইউনিভার্সিটি, নয়াদিল্লি, ভারত। ইমেইল: talukderlaw@gmail.com