সিরাজ প্রামাণিক:
ঢাকা থেকে কুষ্টিয়ার উদ্দেশ্যে ফিরছি। মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া ফেরিঘাট। একজন লোক দৌড়াচ্ছে। গায়ে কাপড়-চোপড় নেই। ছেঁড়া-ময়লা একটি ফুলপ্যান্ট তার পরনে। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। পেছনে একঝাঁক শিশু-কিশোর তার গায়ে ইট-পাটকেল মারছে। যে লোকটি দৌড়াচ্ছে সে মানসিক প্রতিবন্ধী পাগল অথবা উন্মাদ। লোকটির যথাযথ যত্ন নেওয়া বা তার প্রতি নির্দয় ব্যবহার না করতে কেউ নিষেধ করছে না। এ রকম দৃশ্য আমাদের প্রায়ই চোখে পড়ে। দৃশ্যটি অমানবিক। কিন্তু এ ধরণের দৃশ্যে আমরা পুলকিত হই। একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে হাসাহাসি করি। এই দৃশ্যটি উন্মাদ বা পাগলের প্রতি অবহেলা বা নির্দয় আচরণের অংশ। এসব আচরণ প্রতিরোধের জন্য ১৯১২ সালে উন্মাদ আইন তৈরি হয়। এ আইন এখনো কার্যকর রয়েছে।
আইনে কোনো উন্মাদকে তার আত্মীয়স্বজন বা তত্ত্বাবধায়ক কর্তৃক যথাযথ যত্ন এবং নিয়ন্ত্রণে রাখা, নির্দয় ব্যবহার কিংবা অবহেলা না করার বিধি নিষেধ রয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও উন্মাদ বা পাগলকে পায়ে শিকল বেঁধে আটকে রাখার ঘটনা আমাদের দেশে অহরহ ঘটছে। উম্মাদ বা পাগলের জন্য তৈরী আইনে কোন উন্মাদকে তার আত্মীয় স্বজন বা তত্ত্বাবধায়ক কর্তৃক যথাযথ যত্ন এবং নিয়ন্ত্রণ রাখা, নির্দয় ব্যবহার কিংবা অবহেলা না করার কথা থাকলেও উন্মাদ বা পাগলকে পায়ে শিকল বেঁধে আটকে রাখার ঘটনা আমাদের দেশে অহরহ ঘটছে।
পাগলের প্রতি পুলিশের কর্তব্য
থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তার এখতিয়ারভূক্ত সীমানার মধ্যে যদি কোন লোককে বিক্ষিপ্তভাবে কিংবা এলোমেলো ঘোরা-ফেরা করা অবস্থায় দেখতে পান এবং তার বিশ্বাস করার কারণ থাকে যে, উক্ত লোক একজন উম্মাদ তবে তিনি তাকে গ্রেফতার করতে পারবেন। সেইসাথে উক্ত উম্মাদের উম্মাদনার কারণে যদি কেউ উম্মাদের প্রতি ক্ষিপ্ত হয় কিংবা তাকেও বিপজ্জনক বলে বিশ্বাস করার কারণ থাকে তবে তাকেও গ্রেফতার করবেন। কোন উন্মাদকে তার আত্মীয় স্বজন বা তত্ত্বাবধায়ক সঠিকভাবে যত্ন নিচ্ছেনা কিংবা নির্দয় ব্যবহার করছে কিংবা অবহেলিত অবস্থায় দিন যাপন করতে বাধ্য করছে, তাহলে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা অনতিবিলম্বে ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট রিপোর্ট করবেন।
উন্মাদের প্রতি নির্দয় আচরণের সাজা
যদি ম্যাজিস্ট্রেট পুলিশ অফিসারের রিপোর্ট কিংবা অন্য কোন লোকের তথ্যের ভিত্তিতে অবগত হন যে, তার আত্মীয় স্বজন কিংবা অন্য কেউ পাগলের প্রতি নির্দয় আচরণ করেছে তাহলে ম্যাজিস্ট্রেট উক্ত উন্মাদকে তার সামনে উপস্থিত করাতে পারবেন এবং অভিযুক্ত ব্যক্তির প্রতি সমন ইস্যু করতে পারবেন। সেইখানে উন্মাদের প্রতি নির্দয় আচরণকারী ব্যক্তিদের প্রতি সদয় আচরণের আদেশ প্রদান করতে পারবেন। যদি কেউ উক্ত আদেশ অমান্য করেন তবে ম্যাজিস্ট্রেট তাকে এক মাসের কারাদন্ডে দন্ডিত করতে পারবেন।
আর নাম ঠিকানা বিহীন উন্মাদ কিংবা আইনগতভাবে বৈধ এমন কোন অভিভাবক না পাওয়া গেলে ম্যাজিস্ট্রেট ১৪ ধারার বিধান অনুসারে অগ্রসর হবেন। এক্ষত্রে ডাক্তার যদি এইরূপ উম্মাদকে চিকিৎসা পরিচর্যার জন্য অন্তরীণ রাখা উচিৎ এই মর্মে সনদপত্র প্রদান করেন, তবে ম্যাজিস্ট্রেট উক্ত উন্মাদকে পাগলা গারদে ভর্তি করাবার জন্য অদেশ প্রদান করতে পারবেন।
উন্মাদ কর্তৃক কোন অপরাধ সংঘটিত হলে
কোন উন্মাদ আসামী শ্রেণিভুক্ত হলে কিংবা আত্মপক্ষ সমর্থণে অক্ষম সাব্যস্ত হলে মোকদ্দমাটি জামিনযোগ্য বা অ-জামিনযোগ্য যাই হোক না কেন ম্যাজিস্ট্রেট কিংবা আদালত পর্যাপ্ত জামানতে কিছু শর্ত সাপেক্ষে জামিন প্রদান করতে পারেন। এছাড়া বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক যদি এই মতামত প্রদান করেন যে, পাগল ভালো হওয়ার সম্ভাবনা নেই এরূপ অবস্থায় বিচারক তাকে মেডিকেল হাসপাতালের হেফাজতে আবদ্ধ রাখার আদেশ প্রদান করেতে পারেন।
সিরাজ প্রামাণিক: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা, পিএইচ.ডি ফেলো ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। ই-মেইল: seraj.pramanik@gmail.com