স্ত্রী ও শিশু সন্তানকে হত্যার মিথ্যা অভিযোগে টানা ২০ বছর কারাভোগ করেছেন খুলনার শেখ জাহিদ (৫০)। অবশেষে সোমবার (৩১ আগস্ট) সন্ধ্যা ৬টা ২৫ মিনিটে তিনি খুলনা জেলা কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন। এ সময় তার স্বজনরা তাকে পেয়ে আবেগ-আপ্লুত হয়ে পড়েন। তবে বিনা দোষে জীবনের মূল্যবান ২০টি বছর নষ্ট হয়ে গেলেও শেখ জাহিদ এ জন্য কাউকে দায়ী বা কারও শাস্তি চান না। বাকি জীবন আল্লাহর ইবাদত করেই পার করতে চান।
এর আগে বিকেলে শেখ জাহিদের মুক্তির নির্দেশনা বাগেরহাট আদালত থেকে খুলনা জেলা কারাগারে এসে পৌঁছালে তার মুক্তির কার্যক্রম শুরু হয়। আদালতের নির্দেশনা হাতে পাওয়ার পরই সন্ধ্যায় শেখ জাহিদকে মুক্তি দেয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন খুলনা জেলা কারাগারের জেল সুপার মো. ওমর ফারুক।
জানা গেছে, স্ত্রী ও দেড় বছরের শিশু কন্যাকে হত্যার দায়ে ২০০০ সালের ২৫ জুন মৃত্যুদণ্ড হয় শেখ জাহিদের। তারপর থেকেই তিনি কারাগারের কনডেম সেলে টানা ২০ বছর ধরে মৃত্যুর প্রহর গুনছিলেন। কিন্তু মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত শেখ জাহিদকে গত ২৫ আগস্ট খালাসের রায় দেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। সুপ্রিম কোর্ট থেকে বাগেরহাট আদালতে তার খালাসের নির্দেশ প্রেরণ করা হয়। সেখান থেকে ওই নির্দেশনা সোমবার খুলনা কারাগারে এসে পৌঁছানোর পরই তাকে মুক্তি দেয়া হয়েছে।
এদিকে দীর্ঘ ২০ বছর পর শেখ জাহিদের মুক্তির খবরে তার স্বজনরা আগে থেকেই জেলা কারাগারের প্রধান ফটকের সামনে অবস্থান নেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন তার চাচা শেখ আশরাফুজ্জামান, ভগ্নিপতি আজিজুর রহমান ও আব্দুস সালাম এবং তার ছোট বোন।
মুক্তিলাভের পর শেখ জাহিদ সাংবাদিকদের জানান, কনডেম সেলে প্রতি মুহূর্তেই তিনি নিজের মৃত্যু কামনা করতেন। কখন ভাবতেই পারেননি কোনো দিন মুক্তি পাবেন। তার মুক্তির জন্য তিনি মহান আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করেন এবং কারা কর্তৃপক্ষ যারা তার মুক্তির জন্য সহযোগিতা করেছেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। মুক্তির পর তাকে খুলনা মহানগরীর মিয়াপাড়া এলাকায় তার বোনের বাসায় নেয়া হয়।
কারা ফটকে জাহিদের ভগ্নিপতি আজিজুর রহমান জানান, প্রথমে জাহিদের নামে নারী নির্যাতন আইনে ফকিরহাট থানায় মামলা হলে মামলার তৎকালীন তদন্তকারী কর্মকর্তা জাহিদের পরিবারের কাছে ৫০ হাজার টাকা উৎকোচ দাবি করেন এবং সেই টাকা দিতে না পারায় জাহিদকে উক্ত মামলায় এক তরফা দোষী সাব্যস্ত করে চার্জশিট প্রদান করা হয়। জাহিদের জীবনের ২০টি বছর নষ্ট হয়েছে।
প্রসঙ্গত, ১৯৯৪ সালে বাগেরহাটের ফকিরহাট থানার উত্তরপাড়ার ময়েন উদ্দিনের মেয়ে রহিমার সঙ্গে খুলনার রূপসা উপজেলার নারিকেলি চাঁদপুরের ইলিয়াছ শেখের ছেলে শেখ জাহিদের বিয়ে হয়। জাহিদ শ্বশুর বাড়িতে ঘরজামাই থাকতেন। পরে তাদের সংসারে কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। তার নাম রাখা হয় রেশমা খাতুন।
১৯৯৭ সালের ১৫ জানুয়ারি হত্যাকাণ্ডের তিন মাস আগে রহিমার বাবার বাড়ি থেকে ৫০০ গজ দূরে একটি পাকা ঘরে বসবাস শুরু করেন ওই দম্পতি। ১৬ জানুয়ারি বিকেলে রহিমার মা আনজিরা বেগম মেয়ের বাড়ির দরজা ভেজা অবস্থায় দেখতে পান। বাহির থেকে ডাকাডাকি করে সাড়া না পেয়ে ভেতরে ঢুকে খাটের ওপর কাঁথা ও লেপের নিচে বাচ্চাসহ রহিমার মরদেহ পান তিনি। ওই ঘটনায় রহিমার বাবা ময়েন উদ্দিন বাদী হয়ে পরদিন ফকিরহাট থানায় হত্যা মামলা করেন। ওই মামলায় ১৯৯৮ সালের ১৯ নভেম্বর এ মামলার অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। তার আগেই ওই বছরের ১৮ জানুয়ারি আদালতে আত্মসমর্পণ করেন জাহিদ।
হত্যাকাণ্ডের তিন বছরের মাথায় ২০০০ সালের ২৫ জুন বাগেরহাটের জেলা ও দায়রা জজ আদালত আসামি শেখ জাহিদকে মৃত্যুদণ্ড দেন। রায়ের বিরুদ্ধে ওই বছরের ২ সেপ্টেম্বর জেল আপিল করেন তিনি। সে হিসেবে আসামি শেখ জাহিদ ২০ বছর ধরে কনডেম সেলে ছিলেন। ডেথ রেফারেন্স ও জেল আপিলের শুনানি শেষে ২০০৪ সালের ৩১ জুলাই মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন হাইকোর্ট। ওই বছর ২৯ ডিসেম্বর হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে জেল আপিল করেন আসামি শেখ জাহিদ। গত ২৫ আগস্ট শুনানি শেষে তাকে খালাসের রায় দেন আপিল বিভাগ।
শেখ জাহিদের চাচা আকরাম হোসেন শেখ বলেন, জাহিদের ২০ বছরের জীবন ফেরত দেবে কে? কে দেবে তার জবাব? মাতৃহীন, পিতৃহীন ও সম্বলহীন জাহিদের দায়িত্ব নেবে কে?
তিনি বলেন, জাহিদ জেলে থাকা অবস্থায় তার বাবা ইলিয়াস শেখ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে এবং মা হামিদা বেগম বিভিন্ন রোগে-শোকে ভুগে মারা গেছেন। যারা জাহিদের জীবন নষ্ট করেছে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।