জিয়াউর রহমান:
করোনা পৃথিবীর সবকিছু উলটপালট করে দিয়েছে। করোনাকালের প্রথম দিকে সবাই দরজা বন্ধ করে করোনাকে আটকানোর চেষ্টা করেছে। বন্ধ হয়েছে স্কুল, কলেজ, অফিস, আদালত। কী এক বিভীষিকা! এমন করে নিজেকে আবদ্ধ রেখে আর কয়দিন বন্দী থাকা যায়! এক পর্যায়ে মাস্ক পড়ে, পিপিই পড়ে প্রটেকটেড হয়ে কেউ কেউ বাইরে বের হওয়া শুরু করে। এমন দম বন্ধতাকে ছুটি দিতেই হয়তো চীফ জাস্টিস অফ ইন্ডিয়া মিঃ বোবদে একদিন ‘হারলে ডেভিডসন’ মোটর সাইকেল নিয়ে বাইরে বের হন। মোটর সাইকেল টি অনেক দামী, নাগপুরের একজন এমপির ছেলের। ছবিতে দেখা যায়, তার আশেপাশে অনেকে দাড়িয়ে আছেন, সবার মাস্ক পরা, অথচ মিঃ বোবদের মুখে কোন মাস্ক নেই! এই নিয়ে নেটিজেন পাড়া তোলপাড়! মাননীয় প্রধান বিচারপ্রতি এর হিরোইক পোজ এবং মুখে মাস্ক ও মাথায় হেলমেট না থাকায় অনেকে নানারূপ বিদ্রুপাত্মক কমেন্ট করতে থাকেন। এ ঘটনায় প্রশান্ত ভূষণ (ইন্ডিয়ার বিখ্যাত মানবাধিকার লয়ার এবং একটিভিস্ট) পরপর দুটি tweet করেন। প্রথমটায় (জুন ২৭, ২০২০) তিনি লিখেন, “CJI rides a 50 lakh motorcycle belonging to a BJP leader at Raj Bhavan Nagpur, without a mask or helmet, at a time when he keeps the SC in lockdown mode denying citizens their fundamental right to access justice!” তিনি দ্বিতীয় টুইট করেন জুন ২৯, ২০২০। দ্বিতীয় টুইটে তিনি পূর্ববর্তী ৪ জন প্রধান বিচারপ্রতির ভূমিকাকে (role) ভারতীয় গণতন্ত্রের জন্য ‘destruction’ বলে উল্লেখ করেন।
এই দুই টুইট নিয়ে ইন্ডিয়ান আইনাঙ্গনে যে তর্ক, বিতর্ক হলো বা হচ্ছে, সাম্প্রতিক ইতিহাসে এমনটি দেখা যায়নি। প্রথমে (৯ জুলাই) একজন আইনজীবী (মালেক মহেশ্বরী) বিষয়টি কোর্টের নজরে আনেন। সে ভিত্তিতে ২১ জুলাই সুপ্রিম কোর্ট এর রেজিস্ট্রার অফিস আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণ এর বিরুদ্ধে সুয়োমুটো কনটেম্ট কেস দায়ের করেন। জাস্টিস অরুণ মিশ্র এর নেতৃত্বে (J. Arun Mishra, B R Gavai and Krishna Murari) সুপ্রিম কোর্টের একটি বেঞ্চ ২২ জুলাই প্রশান্ত বরাবর কমটেম্ট নোটিশ ইস্যু করে। বিষয়টিতে সুপ্রিম কোর্টের প্রাথমিক দৃষ্টিভঙ্গি (prima facie view) হিসেবে উল্লেখ করা হয়, ‘ Bhushan’s tweet brought disrepute to justice, administration and undermine dignity of CJI’s office.’ ১ আগস্ট প্রশান্ত সুপ্রীম কোর্টে কনটেম্ট এক্ট এর সাংবিধানিকতা চ্যালেঞ্জ করেন এবং কনটেম্ট নোটিশ রিকল প্রার্থনা করেন। ৩ জুলাই নোটিশের রিপ্লাই তে প্রশান্ত দাবী করেন, ৪ জন প্রধান বিচারপ্রতির দায়িত্ব পালনের ব্যর্থতা নিয়ে উদ্বেগ জানানো আদালত অবমাননা হতে পারে না। তিনি দাবী করেন, ‘As an officer of the court, he has duty to speak up when he beleives that the judicial institution is deviating from its sterling record.’
এই আদালত অবমাননা প্রসিডিং শুরু হতেই আইনজীবী, বিচারক, একাডেমিক, সিভিল সোসাইটি সহ সর্বত্র ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা তৈরী হয়। এর মধ্যে ১৬ জন বুদ্ধিজীবী এই মামলায় পক্ষভুক্ত হওয়ার আবেদন করলে ৪ আগস্ট সুপ্রিম কোর্ট তা না মঞ্জুর করেন এবং বলেন, ‘contempt is a matter strictly between the court and the contemnor’. ৫ জুলাই শুনানীতে প্রশান্ত পক্ষে দাবী করা হয়, ‘comments were not out of malice, but out of love and affection for court’. তিনি জানান, অসতর্ক ভাবে তিনি টুইট করেননি। ১৪ আগস্ট কনটেম্ট কেস এর রায়ে প্রশান্তকে আদালত অবমাননার জন্য দোষী সাব্যস্ত করা হয়। প্রশান্তের ২২৮ বর্ণের কম টুইটের বিপরীতে ১০৮ পাতার রায়!
১৭ আগস্ট প্রশান্ত রিভিউ দাখিল করেন। ২০ আগস্ট শুনানীতে তিনি মহাত্মা গান্ধীর উক্তি কোট করে দাবী করেন, ” I don’t ask for mercy, I don’t appeal to magnanimity. I am here to cheerfully submit to any penalty.” তিনি আরও বলেন, ‘My statements are well considered and well thought of’. তিনি জানান, ‘My tweets were a small attempt to discharge what I consider my highest duty.’ ভূষণের আইনজীবী রাজিব ধাবান দাবী করেন, কনটেম্ট কেস এ দেখাতে হবে, মন্তব্য প্রকৃতভাবেই বিচার প্রক্রিয়াকে হস্তক্ষেপ করেছে। এদিন এটর্নি জেনারেল প্রশান্তকে শাস্তি না দিয়ে সতর্ক করে দেওয়ার অনুরোধ করেন। প্রশান্তকে ক্ষমা চাওয়ার কথা বলা হলে ২৪ আগস্ট তিনি বলেন, ‘offering apology would be contempt of my conscience and that of supreme court.’ ২৫ আগস্ট শুনানীতে জাস্টিস মিশ্র বলেন, ক্ষমা চাইলে কি ক্ষতি? ভূষণ জানান, তিনি ক্ষমা চান না, বিচারিক নায়কত্ব চান। ‘ Not seeking mercy, asking for judicial statesmanship’. আর প্রশান্ত এর লয়ার বলেন, প্রশান্ত কে শাস্তি দিলে তা তাকে শহীদ (martyr) বানাবে। কোর্ট ভাবার জন্য সময় দিলেও প্রশান্ত তার অবস্থানে অনড় থাকেন এবং বলেন, ‘granting time will not serve any purpose’.
৩১ আগস্ট রিভিউ এ রায় হয়- প্রশান্ত দোষী। সুপ্রিম কোর্ট বলে, আমরা তাকে দুঃখ প্রকাশ করতে বললেও তিনি তা করেননি। বরং বিচারাধীন থাকা স্বত্বেও তিনি তার বক্তব্য ব্যাপকভাবে প্রচার করেছেন যা বিচার প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ। জাজরা তো আর প্রেস এর কাছে যেতে পারে না। আদালত বলেন, এ ঘটনা আমলে না নিলে তা অন্যদের কাছে রং (wrong) মেসেজ বহন করতো। আদালতের প্রতি adamance and ego দেখালেও অবমাননাকারী আদালতের একজন কর্মকর্তা (Officer of the court) হিসেবে তার প্রতি মহানুভবতা দেখিয়ে লঘু শাস্তি দিচ্ছেন। প্রশান্তকে আদালত অবমাননার জন্য প্রতীকী ১ রুপি জরিমানা করা হয় যা আগামী ১৫ সেপ্টেম্বর এর মধ্যে দাখিল করার নির্দেশ আছে, ব্যর্থতায় আইনজীবী প্রশান্তকে তিন মাস কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে এবং ৩ বছর প্রাকটিস হতে বিরত থাকতে হবে।
এই রায়ের মধ্যে আদালত অবমাননা এর বিতর্ক শেষ হলে কথা থাকতো না। বরং রায় হওয়ার পর আরও জোরেসোরে বিতর্ক চলছে। বলা হচ্ছে, সুপ্রিম কোর্ট এর রায় proportionate নয়। প্রশান্তর মত মানুষ আরও দরকার- এমন নিবন্ধ ছাপছে পত্রিকাগুলো। বেঞ্চ এর জ্যেষ্ঠ বিচারক অরুণ মিশ্র গতকাল (২ সেপ্টেম্বর) অবসরে গেছেন। বলা হচ্ছে, তার রায়গুলো নিয়ে মানুষের মনে প্রশ্ন থেকে যাবে। উল্লেখ্য মিঃ জাস্টিস মিশ্র রাজনৈতিক ভাবে স্পর্শকাতর ইস্যুগুলোতে বেশ কিছু রায় দিয়েছেন যা ক্ষমতাসীনদের অনুকূলে গিয়েছে। আইনজ্ঞদের International Commission of Jurist নামে আন্তজার্তিক সংগঠন এই রায় বাতিলের জন্য অনুরোধ করেছে। প্রশান্ত ভূষণ অবশ্য অবনত চিত্তে এই রায় মেনে নিবেন জানিয়েছেন।
সূত্রঃ অনলাইন নিউজ, www.livelaw.com এবং প্রশান্ত ভূষণ কেস এ সুপ্রিম কোর্ট এর রায়।
জিয়াউর রহমান: চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট; মাগুরা।