কে এম মাহ্ফুজুর রহমান মিশু: কথায় কথায় হরহামেশাই বলি,‘ যত দোষ নন্দ ঘোষ।’ ছন্দের সাথে নন্দের মন্দ ভাগ্যের কিচ্ছায় ঢের আনন্দ আমাদের। রোষ দেখিয়ে দোষ খুঁজিয়ে সিরাতুল মুস্তাকিমের পথ দেখানোর হম্বিতম্বি করা শিক্ষানবীশ আইনজীবী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ কি ভুল করে ভুলে গেছেন নাকি নির্ভুলভাবে ভুলের ভ্যান ধরছেন? আমাদের কর্মকান্ড ৭০ হাজার শিক্ষানবীশদের কাছে আজ প্রশ্নবিদ্ধ! যত দোষ এই বার কাউন্সিলই নন্দ ঘোষ। প্রিলিতে রেজাল্ট খারাপ? হবেই তো। বার কাউন্সিল যদি আসমান থেকে প্রশ্ন নাজিল করে কেমনে সম্ভব? লিখিত পরীক্ষা কবে হবে? কাউন্সিল কর্তাব্যক্তিরা নাকে তেল দিয়ে ঘুমালে কিভাবে হবে? লিখিত পরীক্ষার তারিখ নাকি ঘোষণা হয়েছে? করবেইতো। করোনার এই ত্রাহি ত্রাহি অবস্থায় মানুষকে বিপদে ফেলা ছাড়া ওদের কোন কাজ আছে? আমাদের দোষারোপের মাজেজার হাকিকতের মুখোশ কিন্তু উন্মেচিত হয়েছে। গত ৭ জুলাই থেকে আমরণ অনশন বসে মহানায়কের পরিচয় দিতে গিয়ে খলনায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছি। আন্দোলনকারীদের সকল যুক্তিযুক্ততা মেনে নিয়ে বার কাউন্সিল আগামী ২৬ শে সেপ্টেম্বরে লিখিত পরীক্ষা নেওয়ার ঘোষণা দেন। এরপরও করিপয় শিক্ষানবিশ আবার কেন যেন পরীক্ষা বাতিলের আন্দোলনে করছে; পরীক্ষা পিছিয়ে দেওয়ার জন্য রিটের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে! তাহলে তারা করোনার অজুহাতে পরীক্ষা ছাড়াই সনদ নেওয়ার কলকাঠি নাড়ছেন?
একবিংশ শতাব্দীর চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের দোড়গোড়ায় মানবসভ্যতা। আদালতে অ্যার্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ব্যবহার এখন নেহায়তই ঠুনকো ব্যাপার। রাষ্ট্রযন্ত্রের সকল অঙ্গকে আধুনিকায়ন করতে সরকার চিন্তার টেবিলে মগ্ন। আর সুনাগরিক শিক্ষানবীশ আইনজীবী বন্ধুগণ একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় স্বপ্ন দেখছেন কিভাবে পরীক্ষা ছাড়াই সনদ নিয়ে ন্যায় বিচার নিশ্চিত করা যায়! বিভিন্ন পেশায় অতিষ্ঠ হয়ে সুখের আশায় ভিড় জমানো স্বল্প মেয়াদী পাস কোর্স কিছু বন্ধুরাও এই একই কাতারে। ক্ষানিকটা মগের মুল্লুকের মত। ঘি যে দামে তৈলও একই দামে। এই পদ্ধতিতে ন্যায় অন্যায়ের বিচার হবে কিভাবে? পাবলিক কিংবা প্রাইভেটের মেধাবী শিক্ষার্থীবৃন্দ তাহলে কোন যুক্তিতে এই মহান পেশায় আসতে চাইবেন। বিচারালয়ের পবিত্র আঙ্গিনা ৭০ হাজার শিক্ষানবীশ আইনজীবীদের আলোয় আলোকিত হবে নাকি কষ্টের করুণ পরিস্থিতির আবির্ভূত হবে তা ভাববার সময় এসেছে।
করোনাকালের এই সংকটাকালীন মহা দুর্যোগময় মুহুর্তে শিক্ষানবীশ আইনজীবীদের দু:খ দুদর্শার অধিকার আদায়ে লক্ষ্যে আন্দোলনে নামা হলো। আন্দোলনের শুরু থেকে কিছু মানুষের নেতা হওয়ার মানসিকতায় টালমাটাল অবস্থা তৈরী হলেও বোধকরি আন্দোলন মূল উদ্যেশ্য সফল হয়েছে। বার কাউন্সিলের দায়িত্ববোধ থেকেই হোক আর শিক্ষানবিশদের বেগবান আন্দোলনের জোরেই হোক লিখিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষিত হয়েছে। তাহলে সেই যে গত ৭ জুলাই থেকে আমরণ অনশনের নামে যে নাটকীয়তা শুরু হয়েছে সেটি হাসির খোড়াক বৈ কি বুঝায় তা বুঝে আসেনা। আমরণ অনশনের আজ প্রায় ৬০ দিন হতে চলেছে। শব্দের যে বিকৃত হয়েছে তার পবিত্রতা ফিরে আনতেইতো কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। ইতোমধ্যে ৩ তারিখের মহাসমাবেশের নামে হাতেগোনা ৪০/৫০ জনের উপস্থিতিতি সেই জানানই দেয়। কথায় কথায় প্রায়শই আমাদের বার কাউন্সিলের সাথে ইন্ডিয়ার বার কাউন্সিলের মিল খুঁজি। কিন্তু আমরা কি কখনো ভেবে দেখেছি আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি আইন কলেজ, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কথা? নিচ তলায় মুড়ির দোকান দ্বিতীয় তলায় বিশ্ববিদ্যালয়, তৃতীয় তলায় সেলুনের দোকান। হায়রে শিক্ষাব্যবস্থা!
পৃথিবী সৃষ্টি লগ্ন থেকে রাজকীয় এই পেশার হালহকিকতের জন্য আসলে কি দায়ী? পৃথিবীর প্রায় প্রতিষ্ঠিত বলে পরিচিত মানুষগুলো এই পেশার সাথে যুক্ত ছিলেন। তাহলে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির প্রায় ৭০ হাজার শিক্ষানবীশ আইনজীবীদের নাস্তানুবাদ অবস্থা! একবারও কি ভাববার মত ভাবার সময় হয়েছে উধ্বর্তন কর্তাব্যক্তিদের। এমন পরিস্থিতির সুরাহা না খুঁজলে বিচারপ্রার্থী মক্কেলদের কুড়ে কুড়ে ছিড়ে খাওয়া ছাড়া উপায় থাকবেনা। হয়ত ৪০ বছরের আইনজীবী ও বিচারকের চেয়ারের দায়িত্ব থেকে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা বিষয়টি বুঝেই মন্তব্য করেছিলেন ‘অদক্ষ আইজীবীদের কারনে শতকরা ৬০ থেকে ৭০ ভাগ মক্কেলই সুবিচার থেকে বঞ্চিত হন।’ পবিত্র এই আঙ্গিনার পবিত্রতা ধরে রাখতে যোগ্যতার মাপকাঠিতে আইনজীবী তৈরী করুন। বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে মেধাবী এবং অর্কম্মাদের পার্থক্যের পৃথকায়ন টানা অন্যায় কিছু নয়।
ব্যাঙের ছাতার মত গিজ গিজ করে গজে উঠা আইন কলেজের হিড়িক, সার্টিফিকেট ব্যবসাধারী প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে মানহীনভাবে আইন বিষয় অন্তর্ভুক্তিকরণের অনুমতিদান ভয়ঙ্কর বিপদজনক। একবার রাজধানীর চাকরি প্রার্থীদের কোচিংয়ের আতুড়ঘর খ্যাত ফার্মগেট এলাকায় গেলাম। অ্যাডভোকেটশীপ লিখিত পরীক্ষার ধরণ রকম বুঝতে ফার্মগেটের আর এই এইচ হোম সেন্টারের দ্বিতীয় তলায় এক কোচিংয়ের ফ্রি ক্লাসে ঢুকলাম। কিছু মানুষকে দেখে প্রথমে অবাক হলাম। মগজের চিন্তার তরজমায় কিছুই স্থির করতে পারলাম না। মফস্বল শহরের কিন্ডার গার্ডেনে দেখতাম মায়েরা তাঁদের সন্তানদের ক্লাসে দিয়ে বাইরে অপেক্ষা করতেন। কিন্তু এখানে পঁচিশের কোটার ছেলে মেয়ে ক্লাসে আছে আবার ৬৫ কোটার ডাঙ্গর তরুণ-তরুণীরাও আছে। ওদের বিষয়ে প্রচন্ড কৌতুহলবশত জানতে ইচ্ছে হলো। কিন্তু মনে বেজে উঠল কি বলে সম্বোধন করব? এই পল্লীর আবার এক সমস্যা আছে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকবার বিপদেও পড়েছি। বাপ উর্ধ্ব বয়সীদের স্যার নতুবা ভাই বলতে হয়। এটাই নাকি এই শহরের সামাজিকতা। যাইহোক মন সায় না দিলেও ঠাওর করতে না পেরে একজনকে আপু বলে সম্বোধন করলাম। ক্ষানিকটা মনে মনেই কাতুকুতি লাগলো। যথারিতী ক্লাস শেষে এই মহিয়সী নারীর স্টামিনার গল্প শুনতে গিয়ে মাথায় হাত! ক্যামনে এসব হয়! এই গল্পের ফিরিস্তি টানা সম্ভবপর নহে। বুঝলাম আস্থার, মেধাবীদের প্রবেশের এই জায়গা নষ্ট হলে মাথা ঠুকরে অনুশোচনা করে শেষমেষ কোন ফায়দা হবেনা। এখনই লাগাম টেনে ধরুন।
সামগ্রিক পরিস্থিতির ইতিহাস বিবেচনায় আলোকিত পেশার গুনগত মানের দাফন সম্পন্ন করতে না চাইলে চিন্তার টেবিলে আসুন। বিচারঙ্গনের অন্য ডানা বার কাউন্সিল ছাড়া বিচার বিভাগ অচল। শিক্ষানবীশ আইনজীবীদের আন্দোলন নামে যে সারকাস চলছে সেটি বন্ধের জন্য কাউন্সিলের অতিসত্ত¡র পরীক্ষার ব্যাপারে পরিষ্কারভাবে নোটিশ প্রদান করে শিক্ষানবীশদের পড়ার টেবিলে ফিরে যেতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। বার কাউন্সিলের ওএমআর শিট সংযোজন; রিভিউ করার সুযোগ; আগামী ৩ মাসের মধ্যে লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশের ব্যাপারে কাউন্সিলের কর্তাব্যক্তিদের যে মৌখিকভাবে যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে তা বাস্তবায়নের মাধ্যমে আস্থার জায়গা ফিরে আনতে হবে। কাউন্সিলের বিরুদ্ধে উত্থাপিত দায় ঝেড়ে ফেলে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যেতে হবে। আজকের এই স্বাপ্নিক শিক্ষানবীশ আইনজীবীদের যোগ্যতার মাপকাঠিতে ক্রমান্বয়ে বিচারপতির চেয়ারে বসাতে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের কার্যকরী পদক্ষেপ সময়ের দাবী।
কে এম মাহ্ফুজুর রহমান মিশু: মানবাধিকার কর্মী, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। ই-মেইল: Mahfujiub@gmail.com