উম্মে হাবিবা রহমান: নারীর ক্ষমতায়ন (Women empowerment) বর্তমান বিশ্বে বহুল আলোচিত শব্দ। দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। দেশের উন্নয়নে এই একবিংশ শতাব্দীতে নারীর ক্ষমতায়ন অনেক বড় একটি চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশ সরকার নারীর ক্ষমতায়নে অনেক বেশি তৎপর।”মেয়েদের উপর ভরসা করা যায় না, মেয়েরা ঠিকঠাক দায়িত্ব নিতে পারে না,” _ এসব কথা উপেক্ষা করে নারীরা কর্মক্ষেত্রে সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে বেশকিছু ক্ষেত্রে সফলতার সাথেই নিজেকে প্রমাণ করছে। সুতরাং এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় উন্নত মানসিকতা খুবই জরুরী। করণ নারীর স্বাধীনভাবে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সমাজের কুসংস্কারের কালো চাদর এখনও বিলীন হয়নি। অথচ সৃষ্টির আদি লগ্ন থেকে পুরুষের সহযোদ্ধা হয়ে সর্বদা পাশে থেকেছে নারী। তাহলে এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে নারীরা কি এইটুকু আশা করতে পারে না, নারীর অধিকার নিশ্চিত করার জন্য, নারীর ক্ষমতায়নে একটা সুন্দর মানসিকতা নিয়ে পুরুষরাও নারীর পাশে থাকবে? যদি এই চাওয়াটা কোনদিন সত্যি হয়, তাহলে হয়ত আর নারী নির্যাতন ও নারীর অগ্রগতিতে আর বাধা থাকবে না। আর সেদিনই সত্যিকার অর্থে নারীরা ক্ষমতায়িত (empowered) হবে।
সুন্দর মানসিকতার অভাবে নারীদের যেমন নিজের অধিকার নিশ্চিত হচ্ছে না তেমনি নারীর ক্ষমতায়নে চাদরে মেয়েরা ব্যবহার হচ্ছে। এর প্রধান দুটি ক্ষেত্র হলো শিক্ষাক্ষেত্র আর কর্মক্ষেত্র। নারী শিক্ষাক্ষেত্রে সংকীর্ণ মানসিকতা প্রসারিত করা এখন সময়ের দাবী। হ্যাঁ, শিক্ষাক্ষেত্রে মেয়েদের অংশগ্রহণ ও সফলতা এখন চোখে পড়ার মত। তবে নারীর উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে সমাজের পিছুটান এখনো যায়নি। সমাজ এখনও বিশ্বাস করে,”মেয়ে মানুষ অত পড়াশোনার কি দরকার, একটা সময় তো সংসারই করতে হবে, ঐ একটা ভালো ঘরে বিয়ে দিতে যতটুকু দরকার ততটুকু পড়লেই হবে।” এই মানসিকতার বেড়াজাল সিংহভাগ নারীদের মাঝপথে আটকে দিচ্ছে। যারা এই মানসিকতার মোকাবেলা করতে পারছে তারাই উচ্চ শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে আর যারা পারছে না তারা সংসারে আবদ্ধ হচ্ছে। বিয়েটা পুরো জীবনের একটা অংশ। কিন্তু নারীর জীবনকে পুরো অংশ ফেলে রেখে শুধু একটা অংশ দিয়ে মাপা হচ্ছে। নারীর কাজ কি শুধু পরাধীন থাকা আর সংসার করা?
বাস্তবতা হচ্ছে সুযোগ পেলে সফলতার ছোঁয়া নিয়ে নারী নিজেকে মেলে ধরতে পারছে, এ প্রেক্ষিতে পরাধীন থাকাটা শুধু অযোক্তিকই নয়, অপরাধও বটে। বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে “জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতা” র অধিকার নারীরও রয়েছে। বাংলাদেশ সংবিধান অনুচ্ছেদ ৩২ তা নিশ্চিত করেছে।সেখানে নারী ও পুরুষ আলাদা করে কিছু বলা নেই। শিক্ষাগ্রহণ ও স্বাধীন জীবন এ দুটোই নারীর অধিকার। নারীর ক্ষমতায়নে শিক্ষার বিকল্প নেই।
নারীর ক্ষমতায়নের দরুণ নারীদের জন্য অনেক কর্মক্ষেত্রের দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। এত বাধা বিপত্তি পেরিয়ে যখন একজন নারী কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করে তখনও কি ঐ নীচু আর জঘন্য মানসিকতা থেকে বাঁচতে পেরেছে? উত্তর হচ্ছে- পারে নি। ক্ষমতায়নের (ক্ষেত্র বিশেষে) নামে নারীকে পণ্য হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। তথ্য-প্রযুক্তির এই যুগে মোবাইল ফোন সবার হাতে হাতে। “আপনার কঙ্খিত নম্বরটি এই মুহূর্তে বন্ধ আছে ” এই টিউন টা আজ অবধি পুরুষ কন্ঠে শোনা যায়নি। প্রত্যেকটা মোবাইল কোম্পানি সংযোগ বন্ধসহ সকল অফার কেন নারী কন্ঠেই প্রচার করে? এখানে তো পুরুষরাও কাজ করছে। তাহলে কি পুরুষরা এখানে অযোগ্য আর যোগ্যতার বিচারে নারীরা এখানে অগ্রাধিকার পাচ্ছে ব্যাপারটা এরকম? মোটেও না কাস্টমার কেয়ার সার্ভিস বা কল সেন্টারে প্রত্যেকদিন কোন না কোন নারীকে বাধ্য হয়ে কাস্টমার এর অশ্রাব্য ও যৌন হয়রানিমূলক কথা হজম করতে হয়। কারণ কাস্টমারের অনুমতি ছাড়া কল কাটার নিয়ম নেই। এই অদ্ভুত নিয়মে এটা পরিষ্কার নারী কন্ঠের মাধ্যমে পুরুষ ক্রেতাকে আকর্ষণ করাই তাদের মূল লক্ষ। টিভি চ্যানেলগুলো খুললেই বিজ্ঞাপনের মেলায় নারীকে পণ্য বানানোর এক মহোৎসব দেখা যায়। গোসলের সাবানের বিজ্ঞাপনে বরাবরই একজন নারী মডেলকে দেখা যায়। সুগন্ধি সাবান, লোশন, ক্রীম এসব প্রসাধনীর বিজ্ঞাপনগুলোতে বিভিন্নভাবে নারীর শরীর একটু বেশিই খোলামেলা ভাবে দেখানো হচ্ছে। এটাতো জরুরি না বরং এটা পরিষ্কার নারীরা এখানে সরাসরি পণ্য হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। নারীর ক্ষমতায়ন এখানে একটা উপলক্ষ মাত্র।
সুপারিশ
নারীর ক্ষমতায়নের জন্য কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ অত্যন্ত আবশ্যক। দিনদিন নারীর জন্য কর্মক্ষেত্রে সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে যা আগে ছিল না। নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে আমরা যদি এখনও সংস্কার মুক্ত না হতে পারি তবে প্রতিযোগিতামূলক এই বিশ্বে নিজের দেশকে উন্নত করা সম্ভব নয়। তাই যে যে ক্ষেত্রে মানসিকতার প্রসারণ দরকার বলে আমার ব্যক্তিগত মত-
ক. নারীর প্রথম পরিচয় সে একজন মানুষ তারপর সে নারী। নারীকে দুর্বল বোঝা নয়, পূর্ণ মানুষের মর্যাদায় দেখতে হবে।
খ. নারী একটি আলাদা সত্ত্বা, ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকার নারীরও আছে। নারীকে পরাধীন রাখার মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে।
গ. নারী বলে দুর্বল ভেবে, নারীর কাজকে সস্তা ভেবে কর্মক্ষেত্রে নারীকে হেনস্তা করা, অবজ্ঞা বা ব্যবহার করার মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে।
ঘ. বিয়ে জীবনের একটা অংশ। পুরো জীবনটা বিয়ে কেন্দ্রিক হওয়া উচিত নয়। সংসার করা নারীর একমাত্র কাজ না। নারীর প্রতিভা বিকশিত হওয়ার সুযোগ দিতে হবে।
পরিশেষে বলতে চাই নারী সমাজের অর্ধেক অংশ। সমাজের এই অর্ধেক অংশকে পেছনে ফেলে দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। দেশের উন্নয়নের জন্য নারীর অংশগ্রহণ তথা নারীর ক্ষমতায়ন প্রয়োজন। তাই পুরুষের উচিত নারীর ক্ষমতায়ন কে স্বাগত জানিয়ে সুন্দর মানসিকতা নিয়ে নারীর পাশে থাকা।
উম্মে হাবিবা রহমান: শিক্ষার্থী; আইন ও বিচার বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।