বাংলাদেশের বিচার বিভাগ গড়ে উঠেছে উর্দ্ধতন বিচার বিভাগ (সুপ্রীম কোর্ট) এবং অধস্তন বিচার বিভাগ (নিম্ন আদালতসমূহ)-এর সমন্বয়ে। বাংলাদেশ সরকারের তিনটি বিভাগের অন্যতম একটি হচ্ছে বিচার বিভাগ। সরকারের অন্য দুটি বিভাগ হল আইন বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগ।
ঊর্ধ্বতন বিচার বিভাগ
বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট সংবিধানের ৯৪ অনুচ্ছেদের ১ ধারা অনুযায়ী দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রীম কোর্ট আপীল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগ নিয়ে গঠিত।
আপীল বিভাগ
বাংলাদেশের উচ্চ আদালত দুই ভাগে বিভক্ত। এর মধ্যে আপীল বিভাগ উচ্চতম। প্রধান বিচারপতি ও অন্যান্য বিচারপতিদের নিয়ে এটি গঠিত হয়।
হাইকোর্ট বিভাগ
হাইকোর্ট বিভাগ বা উচ্চ আদালত বিভাগ হল বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রীম কোর্টের নিম্ন বিভাগ। এ বিভাগ প্রধান বিচারপতি ও হাইকোর্ট বিভাগের অন্যান্য বিচারপতিদের নিয়ে গঠিত।
অধস্তন বিচার বিভাগ
অধস্তন বিচার বিভাগ এখতিয়ার ও বিচারিক ক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে দেওয়ানী, ফৌজদারি ও ট্রাইব্যুনাল ইত্যাদি ভাগে বিভক্ত।
দেওয়ানি আদালত
পাঁচ শ্রেণির অধস্তন দেওয়ানি আদালত আছে, যথাঃ সহকারী জজ আদালত, ঊর্ধ্বতন সহকারী জজ আদালত, যুগ্ম জেলা জজ আদালত, অতিরিক্ত জেলা জজ আদালত এবং জেলা জজ আদালত।
প্রতিটি জেলায় বিচার বিভাগের প্রধান হলেন জেলা জজ। পাবর্ত্য জেলাগুলোতে যেখানে পৃথক কোনো দেওয়ানি আদালত ছিল না সেখানে ম্যাজিস্ট্রেটরাই দেওয়ানি আদালতের দায়িত্ব পালন করতেন। তবে সম্প্রতি সেখানে দেওয়ানি আদালত গঠিত হয়েছে এবং কাজ করছে। হাইকোর্ট বিভাগের তত্ত্বাবধান সাপেক্ষে জেলা জজের গোটা জেলার সকল দেওয়ানি আদালতের উপর প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। জেলা জজের প্রধানত আপীল মামলার বিচার করার ও মামলা পর্যালোচনা করার এখতিয়ার আছে। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে তার মৌলিক এখতিয়ারও রয়েছে।
অতিরিক্ত জেলা জজের এখতিয়ার জেলা জজের এখতিয়ারের মতোই সমবিস্তৃত। তিনি জেলা জজ কর্তৃক তার উপর অর্পিত বিচারিক দায়িত্ব পালন করেন। সহকারী জজ ও অধস্তন জজের প্রদত্ত রায়, ডিক্রি বা আদেশের বিরুদ্ধে আপীল জেলা জজদের কাছে করা হয়। অনুরূপভাবে জেলা জজ সহকারী জজদের প্রদত্ত রায়, ডিক্রি বা আদেশের বিরুদ্ধে আনীত আপিলগুলো যুগ্ম জেলা জজদের কাছে নিষ্পত্তির জন্য পাঠাতে পারেন। যুগ্ম জেলা জজদের দেওয়ানি বিষয়ক সীমাহীন মৌলিক এখতিয়ার রয়েছে।
দেওয়ানি আদালতগুলো উত্তরাধিকার, বিবাহ বা জাতপাত কিংবা কোনো ধর্মীয় রীতিনীতি বা প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত যেকোন প্রশ্নের নিষ্পত্তিকালে পক্ষগুলো যেখানে মুসলমান সেক্ষেত্রে মুসলিম আইন আর হিন্দু হলে হিন্দু আইন প্রয়োগ করে থাকে। তবে আইনসভা প্রণীত কোনো অধিনিয়মের (Enactment) দ্বারা এ জাতীয় আইনের পরিবর্তন বা বিলোপ ঘটে থাকলে সেসব ক্ষেত্রেই এর ব্যত্যয় ঘটে।
অর্থঋণ আদালত
সরকার অর্থঋণ আদালত আইন, ১৯৯০ এর বিধানাবলির অধীনে প্রতি জেলায় একটি অর্থঋণ আদালত গঠন করেছেন এবং সুপ্রীম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শক্রমে অধস্তন বিচারকদের এই আদালতের বিচারক পদে নিয়োগ দিয়েছেন। ব্যাংক, বিনিয়োগ কর্পোরেশন, গৃহনির্মাণ ঋণদান সংস্থা, লিজিং কোম্পানি ইত্যাদির মতো অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠান এবং অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠান আইন, ১৯৯৩ এর বিধানাবলির অধীনে গঠিত ব্যাংক বহির্ভূত অর্থ প্রতিষ্ঠানগুলোর অনাদায়ী ঋণ আদায়ের সকল মামলা অর্থঋণ আদালতে দায়ের করতে হয় এবং এজাতীয় মামলাগুলো এককভাবে এই শ্রেণির আদালতে বিচারযোগ্য। অর্থঋণ আদালত একটি দেওয়ানি আদালত এবং দেওয়ানি আদালতের যাবতীয় ক্ষমতা এই আদালতের রয়েছে।
পারিবারিক আদালত
পারিবারিক বিষয় সংক্রান্ত মোকদ্দমার নিষ্পত্তি করে পারিবারিক আদালত। ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ এর বিধানাবলী সাপেক্ষে কোন পারিবারিক আদালতের পাঁচটি বিষয়াদির সকল অথবা যেকোনটির সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়ে যেকোন মামলা গ্রহণ, বিচার এবং নিষ্পত্তি করার একক এখতিয়ার থাকবে ৷বিষয়গুলো হলো: (ক) বিবাহবিচ্ছেদ, (খ) দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধার, (গ) দেনমোহর, (ঘ) ভরণপোষণ এবং (ঙ) সন্তান-সন্ততিগণের অভিভাবকত্ব ও তত্ত্বাবধান ৷
দেউলিয়া আদালত
দেউলিয়া আইন, ১৯৯৭ এর অধীনে গঠিত হয়েছে। প্রতি জেলার জেলা আদালত সেই জেলার দেউলিয়া আদালত, এবং জেলা জজ হলেন সেই আদালতের পরিচালনাকারী বিচারক। জেলার অভ্যন্তরে উদ্ভূত দেউলিয়া মামলাগুলোর বিচার ও নিষ্পত্তি করার কর্তৃত্ব তার হাতে ন্যস্ত এবং তিনি অতিরিক্ত (জেলা) জজকে এজাতীয় যেকোন মামলার বিচার ও নিষ্পত্তি করার কর্তৃত্ব অর্পণ করতে পারেন।
সহকারী জজ, সিনিয়র সহকারী জজ এবং যুগ্ম জেলা জজদের ত্রিশ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থ আদায়ের মামলা এবং কোনো বাড়ির ১২ মাসের ভাড়া উপরোক্ত অঙ্কের অর্থের সমপরিমাণ হলে সেই বাড়ির মালিক কর্তৃক মাসওয়ারি ভাড়াটিয়াকে উচ্ছেদের মামলা গ্রহণ ও বিচার করার জন্য স্বল্প এখতিয়ারসম্পন্ন আদালতের দায়িত্ব পালনের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। নির্দিষ্ট কতিপয় আদেশের বিরুদ্ধে জেলা জজের কাছে আপিল করা ছাড়া স্বল্প এখতিয়ার সম্পন্ন আদালতের জারিকৃত ডিক্রি বা অধিকাংশ আদেশের বিরুদ্ধে কোনো আপীল করা যায় না। তবে সংক্ষুব্ধ পক্ষ ডিক্রি বা আপিলযোগ্য আদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট বিভাগে মামলা পুনর্বিবেচনার আর্জি পেশ করতে পারেন। সহকারী জজ ও সিনিয়র সহকারী জজরা ভাড়া নিয়ন্ত্রকের দায়িত্ব পালন করে থাকেন এবং বকেয়া ভাড়া আদায়ের মামলা বা ভাড়া দেয়া জায়গা থেকে ভাড়াটিয়া উচ্ছেদের মামলা বাদে বাড়ির মালিক ও ভাড়াটিয়াদের মধ্যেকার বিরোধগুলোর নিষ্পত্তি করে থাকেন যেমন, বাড়ির মালিক বাড়িভাড়া নিতে অস্বীকৃতি জানালে ভাড়াটিয়া কর্তৃক প্রদত্ত বাড়িভাড়া জমা নেয়া, বাড়ির মেরামত কাজ করানোর ব্যবস্থা, মানসম্মত ভাড়া নির্ধারণ করা ইত্যাদি। সহকারী জজ ও সিনিয়র সহকারী জজদের নিয়ে পারিবারিক আদালতও গঠিত হয়ে থাকে যার কাজ হচ্ছে পারিবারিক বিরোধ থেকে উদ্ভূত মামলাগুলো গ্রহণ ও বিচার করা যেমন দাম্পত্য অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা, বিবাহ বিচ্ছেদ, স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততির ভরণ পোষণ, সন্তানের হেফাজত ইত্যাদি।
ফৌজদারী আদালত
ফৌজদারী আদালত বেশ কয়েক শ্রেণির রয়েছে। এগুলো হচ্ছে দায়রা আদালত, বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটের আদালত এবং মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের আদালত। বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রধান বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট, অতিরিক্ত প্রধান বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট এবং প্রথম দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটের আদালত। মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রধান মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট, অতিরিক্ত প্রধান মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট এবং অন্যান্য মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের আদালত। এরা সবাই প্রথম শ্রেণির বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা প্রয়োগ করে থাকেন। আগে বিভাগীয় কমিশনার তিন পার্বত্য জেলার দায়রা আদালতের দায়িত্ব পালন করতেন। কিন্তু ২০০৮ সাল থেকে পার্বত্য জেলাগুলোতে দায়রা আদালত গঠন করা হয়। ১৯৯৯ সালের জানুয়ারি থেকে ঢাকা ও চট্রগ্রাম মেট্রোপলিটন এলাকার জন্য মেট্রোপলিটন দায়রা আদালত প্রতিষ্ঠা করা হয়। বিচারিক কার্যাবলি বাদে অন্যান্য কার্য সম্পাদনের জন্য রয়েছেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা।
জেলাগুলোতে জেলা জজদের দায়রা জজ হিসেবে, অতিরিক্ত জেলা জজদের অতিরিক্ত দায়রা জজ হিসেবে এবং যুগ্ম জেলা জজদের যুগ্ম দায়রা জজ হিসেবে কাজ করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। প্রত্যেক জেলায় জেলা জজ দায়রা জজের, অতিরিক্ত জেলা জজ বা জজেরা অতিরিক্ত দায়রা জজের এবং যুগ্ম জেলা জজেরা যুগ্ম দায়রা জজের দায়িত্ব পালন করে থাকেন। মেট্রোপলিটন এলাকাগুলোতে সাবেক জেলা জজদের মেট্রোপলিটন দায়রা জজ করে, সাবেক অতিরিক্ত জেলা জজদের মেট্রোপলিটন অতিরিক্ত দায়রা জজ করে এবং সাবেক যুগ্ম জেলা জজদের মেট্রোপলিটন যুগ্ম দায়রা জজ করে মেট্রোপলিটন দায়রা আদালত গঠন করা হয়েছে। যুগ্ম দায়রা জজরা দায়রা জজদের অধস্তন এবং দায়রা জজরা যুগ্ম দায়রা জজদের কর্মদায়িত্ব বণ্টনের নিয়মবিধি জারী করতে পারেন। অতিরিক্ত দায়রা জজেরা যদিও দায়রা জজদের মতো একই ক্ষমতা প্রয়োগ করে থাকেন তথাপি জেলার দায়রা জজ সেই জেলার অতিরিক্ত দায়রা জজ বা জজদের দায়িত্ব বণ্টন করে দিতে পারেন। দায়রা আদালতগুলোর বিচারকরা দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন, ১৯৪৭ এবং অধুনা বাতিলকৃত দুর্নীতি দমন আইন, ১৯৫৭-এর স্থলে প্রবর্তিত দূর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ এর আওতাভুক্ত অপরাধসমূহের বিচার করার জন্য ফৌজদারী আইন (সংশোধনী) অ্যাক্ট, ১৯৫৮ এর অধীনে বিশেষ বিচারক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করে থাকেন। দায়রা আদালতগুলোর বিচারকরা বিশেষ ক্ষমতা আইন, ১৯৭৪ এর বিধানাবলির অধীন অপরাধসমূহের বিচারের জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল হিসেবেও কাজ করেন। বিশেষ ট্রাইব্যুনাল হিসেবে কর্মরত দায়রা জজ, অতিরিক্ত দায়রা জজ বা যুগ্ম দায়রা জজরা আইনে প্রাপ্ত ক্ষমতাবলে যেকোন ধরনের সাজা বা দন্ডাদেশ দিতে পারেন। দায়রা জজ ও অতিরিক্ত দায়রা জজরা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (বিশেষ বিধান) আইন, ২০০০ এর বিধানাবলির অধীনে নারী ও শিশু নির্যাতন দমনের জন্য বিশেষ আদালত হিসেবেও কাজ করে থাকেন। দায়রা জজরা জননিরাপত্তা (বিশেষ বিধান) আইন, ২০০০ এর আওতাধীন অপরাধসমূহের বিচার করার জন্য ঐ আইনের অধীনে জননিরাপত্তা ট্রাইব্যুনাল হিসেবেও কাজ করেন। জননিরাপত্তা (বিশেষ বিধান) (সংশোধনী) আইন, ২০০২ বলে উক্ত আইনের অধিকাংশ বিধান বাতিল করা হয়েছে বটে, তবে যথোপযুক্ত মামলাগুলো প্রত্যাহার করতে সরকারের ক্ষমতা সংরক্ষিত করে উক্ত আইনের অধীনে বিচারাধীন মামলাগুলো অব্যহত রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বাতিলকৃত বিধানাবলিকে আইনশৃঙ্খলা বিঘ্নকারী অপরাধ (দ্রুত বিচার) আইন, ২০০২ বলে ঈষৎ সংশোধিত আকারে পুনঃবিধিবদ্ধকরণ করা হয়েছে এবং মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ও প্রথম শ্রেণির বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেটদের দ্রুত বিচার আদালত হিসেবে অতি অল্প সময়ের মধ্যে এসব অপরাধের বিচার করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। দায়রা জজ ও অতিরিক্ত দায়রা জজরা অ্যাসিড অপরাধ দমন আইন, ২০০২ এর অধীন অপরাধসমূহের বিচারের ট্রাইব্যুনাল হিসেবেও কাজ করেন। হত্যা, ধর্ষণ, বেআইনি অস্ত্র, বিস্ফোরক ও মাদকদ্রব্য রাখার মতো অপরাধসমূহের দ্রুত বিচার নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে দায়রা জজ পদমর্যাদার বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের নিয়ে প্রাথমিকভাবে ছয়টি জেলায় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছে। পরবর্তীকালে অন্যান্য অধস্তন ফৌজদারি আদালত কিংবা দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল আইন, ২০০২ এর অধীনে গঠিত ট্রাইব্যুনালসমূহে বিচারাধীন এজাতীয় কিছু কিছু মামলা স্থানান্তরিত করে প্রতি জেলায় এই ট্রাইব্যুনাল সম্প্রসারিত করা হবে। এসব ট্রাইব্যুনাল, সংশ্লিষ্ট সরকারি কৌসুলি ও পুলিশ অফিসাররা সর্বোচ্চ ১২০ কর্মদিবসের মধ্যে এজাতীয় মামলার বিচারকাজ সম্পন্ন করতে না পারার জন্য দায়ী থাকবেন। যেকোন ফৌজদারী অপরাধ কিম্বা তার প্রস্ত্ততির ভিডিও ফিল্ম ও স্থির চিত্র অথবা এমন অপরাধের সঙ্গে সম্পর্কিত সংলাপ সংবলিত টেপ রেকর্ড বা ডিস্ককে সাক্ষ্যপ্রমাণ হিসেবে গ্রহণের জন্য সাক্ষ্যপ্রমাণ সম্পর্কিত বিশেষ বিধানকে এজাতীয় মামলার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য করা হয়েছে। দায়রা জজ ও অতিরিক্ত দায়রা জজরা মানি লন্ডারিং দমন আইন, ২০০২ এর অধীন মানিলন্ডারিং অপরাধের বিচারের জন্য মানি লন্ডারিং আদালত হিসেবেও কাজ করেন। পরিবেশ রক্ষা আইন, ১৯৯৫ ও অন্যান্য পরিবেশগত আইন ও নিয়মবিধির অধীন বড় ধরনের পরিবেশগত অপরাধের সঙ্গে সম্পর্কিত অন্যান্য অপরাধের বিচারের জন্য যুগ্ম জেলা জজদের (যারা আবার পদাধিকার বলে যুগ্ম দায়রা জজও বটে) নিয়ে পরিবেশ আদালত গঠন করা হয়েছে এবং প্রথম শ্রেণির বিচার বিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট ও বিশেষ বিচার বিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটদের ছোটখাট ধরনের পরিবেশগত অপরাধের বিচারের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। বিশুদ্ধ খাদ্য অধ্যাদেশ, ১৯৫৯ যা বিশুদ্ধ খাদ্য (সংশোধনী) আইন, ২০০৫ দ্বারা সংশোধিত তার অধীন অপরাধসমূহের বিচার করার জন্য প্রথম শ্রেণির ক্ষমতাধিকারী বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ে বিশুদ্ধ খাদ্য আদালত গঠন করা হয়েছে। অনুরূপভাবে অভ্যন্তরীণ নৌচলাচল অধ্যাদেশ, ১৯৭৬ এর অধীন অপরাধসমূহের বিচার করার জন্য প্রথম শ্রেণির বিচার বিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ে এবং অ্যাসেসরদের সহায়তায় নৌ-আদালত গঠন করা হয়েছে।
মেট্রোপলিটান এলাকার বাহিরের জেলাগুলোতে প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটদের প্রধান বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট ও অতিরিক্ত প্রধান বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে নিয়োগ করা হয়। ২০০৭ সালের নভেম্বর থেকে জেলাগুলোতে অতিরিক্ত জেলা জজরা প্রধান বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে, সিনিয়র সহকারী জজরা প্রথম শ্রেণির বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে এবং সহকারী জজরা দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। মেট্রোপলিটন এলাকাগুলোর বাইরে প্রতি জেলায় প্রধান বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট ও অতিরিক্ত প্রধান বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট ছাড়াও প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির অন্যান্য বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট আছেন। সরকার কিংবা সরকারের নিয়ন্ত্রণ সাপেক্ষে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট স্থানীয় এলাকাগুলোর সীমানা নির্ধারণ করে দেন যার পরিসীমার মধ্যে এই ম্যাজিস্ট্রেটরা তাদের উপর ন্যস্ত ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন। প্রতি জেলায় জেলা জজ দায়রা জজের দায়িত্ব, অতিরিক্ত জেলা জজ বা জজেরা অতিরিক্ত দায়রা জজের দায়িত্ব এবং যুগ্ম জেলা জজেরা যুগ্ম দায়রা জজের দায়িত্ব পালন করেন। মেট্রোপলিটন এলাকাগুলোতে সাবেক জেলা জজদের মেট্রোপলিটন দায়রা জজ করে, সাবেক অতিরিক্ত জেলা জজদের মেট্রোপলিটন অতিরিক্ত দায়রা জজ করে এবং সাবেক যুগ্ম জেলা জজদের মেট্রোপলিটন যুগ্ম দায়রা জজ করে মেট্রোপলিটন দায়রা আদালত গঠন করা হয়েছে। যুগ্ম দায়রা জজরা দায়রা জজদের অধস্তন এবং দায়রা জজেরা যুগ্ম দায়রা জজদের কাজ ও দায়িত্ব বণ্টন করার নিয়মবিধি তৈরি করতে পারেন। অতিরিক্ত দায়রা জজরা যদিও দায়রা জজদের মতো একই ক্ষমতা প্রয়োগ করে থাকেন তারপরও জেলার দায়রা জজরা ঐ জেলার অতিরিক্ত দায়রা জজ বা জজদের কর্মদায়িত্ব বণ্টন করতে পারেন। দায়রা আদালতগুলোর বিচারকরা দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন, ১৯৪৭ ও দুর্নীতি দমন আইন, ১৯৫৭ এর বিধানাবলির অধীন অপরাধসমূহের বিচার করার জন্য ফৌজদারী আইন (সংশোধনী) অ্যাক্ট, ১৯৫৮ অনুযায়ী বিশেষ জজ হিসেবেও কাজ করে থাকেন। দায়রা আদালতগুলোর বিচারকরা বিশেষ ক্ষমতা আইন, ১৯৭৪ এর বিধানাবলির অধীন অপরাধসমূহের বিচারের জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল হিসেবেও কাজ করেন। বিশেষ ট্রাইব্যুনাল হিসেবে কর্মরত দায়রা জজ, অতিরিক্ত দায়রা জজ বা সহকারী দায়রা জজরা আইনে প্রাপ্ত ক্ষমতাবলে যেকোন সাজা প্রদান করতে পারেন। দায়রা জজ ও অতিরিক্ত দায়রা জজরা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (বিশেষ বিধান) আইন, ২০০০ এর বিধানাবলির অধীনে নারী ও শিশু নির্যাতন দমনের জন্য বিশেষ আদালত হিসেবেও কাজ করেন। দায়রা জজরা জননিরাপত্তা (বিশেষ বিধান) আইন, ২০০২ এর অধীন অপরাধসমূহের বিচারের জন্য ঐ আইনবলে জননিরাপত্তা ট্রাইব্যুনাল হিসেবেও কাজ করেন। জননিরাপত্তা (বিশেষ বিধান) (সংশোধনী) আইন, ২০০২ বলে ঐ আইনের অধিকাংশ বিধান বাতিল করা হলেও উপযুক্ত মামলাগুলো তুলে নেয়ার ব্যাপারে সরকারের হাতে ক্ষমতা সংরক্ষণ করে উক্ত আইনের অধীনে বিচারাধীন মামলাগুলো অব্যাহত রাখার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। বাতিলকৃত বিধানগুলোকে আইনশৃঙ্খলা বিঘ্নকারী অপরাধ (দ্রুত বিচার) আইন, ২০০২ বলে ঈষৎ সংশোধিত আকারে নতুন করে বিধিবদ্ধ করা হয়েছে এবং মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ও প্রথম শ্রেণির বিচার বিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেটদেরকে দ্রুত বিচার আদালত হিসেবে অতি অল্প সময়ের মধ্যে এসব অপরাধের বিচার করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। দায়রা জজ ও অতিরিক্ত দায়রা জজরা অ্যাসিড অপরাধ দমন আইন, ২০০২ এর অধীন অপরাধসমূহের বিচার করার জন্য ট্রাইব্যুনাল হিসেবেও কাজ করেন। হত্যা, ধর্ষণ, বেআইনি অস্ত্র, বিস্ফোরক ও মাদকদ্রব্য রাখার অপরাধের নির্দ্দিষ্ট সময়ের মধ্যে দ্রুত বিচার সম্পন্ন করার জন্য দায়রা জজ পদমর্যাদার বিচারবিভাগীয় কর্মকর্তাদের নিয়ে দ্রুত বিচার আদালত প্রাথমিক ভাবে ৬ টি বিভাগে গঠন করা হয়েছে এবং পরবর্তী পর্যায়ে অন্যান্য অধস্তন ফৌজদারী আদালত কিংবা দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল আইন, ২০০২ এর অধীনে গঠিত ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন এজাতীয় কিছু কিছু মামলা জেলাগুলোতে স্থানান্তর করে প্রত্যেক জেলায় দ্রুত বিচার আদালত সম্প্রসারিত করা হবে। এসব ট্রাইব্যুনাল, সংশ্লিষ্ট সরকারি কৌসুলি ও পুলিশ অফিসাররা সর্বোচ্চ সময় ১২০ কার্যদিবসের মধ্যে এজাতীয় মামলার বিচার সম্পন্ন না হওয়ার জন্য দায়ী থাকবেন। যেকোন ফৌজদারী অপরাধ বা তার প্রস্ত্ততির ভিডিও দৃশ্য ও স্থিরচিত্র এবং এই অপরাধের সঙ্গে সম্পর্কিত টেপরেকর্ড বা ডিস্ক সাক্ষ্যপ্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করার জন্য সাক্ষ্যপ্রমাণ সম্পর্কিত বিশেষ বিধি এইসব মামলার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য করা হয়েছে। দায়রা জজ ও অতিরিক্ত দায়রা জজরা মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০০২ এর অধীন মানিলন্ডারিং অপরাধের বিচার করার জন্য মানি লন্ডারিং আদালত হিসেবেও কাজ করেন। পরিবেশ রক্ষা আইন, ১৯৯৫ ও অন্যান্য পরিবেশ বিষয়ক আইন ও নিয়মবিধির অধীন বড় ধরনের পরিবেশগত অপরাধের বিচার করার জন্য যুগ্ম জেলা জজদের (যারা আবার পদাধিকারবলে যুগ্ম দায়রা জজও বটে) নিয়ে পারিবেশ আদালত গঠন করা হয়েছে এবং প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটদের ও বিশেষ ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটদের ছোটখাট পরিবেশগত অপরাধের বিচার করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। বিশুদ্ধ খাদ্য (সংশোধনী) আইন, ২০০৫ এর দ্বারা সংশোধিত বিশুদ্ধ খাদ্য অধ্যাদেশ, ১৯৫৯ এর অধীন অপরাধসমূহের বিচার করার জন্য প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ে বিশুদ্ধ খাদ্য আদালত গঠন করা হয়েছে। অনুরূপভাবে অভ্যন্তরীণ নৌচলাচল অধ্যাদেশ, ১৯৭৬ এর অধীন অপরাধসমূহের বিচার করার জন্য প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ে ও অ্যাসেসরদের সহায়তায় নৌ-আদালত গঠন করা হয়েছে। মেট্রোপলিটন এলাকার বাইরের জেলাগুলোতে প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটদের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট পদে নিয়োগ দেয়া হয়। জেলার ডেপুটি কমিশনাররা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনাররা অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের একজন জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের সকল বা যেকোন ক্ষমতা থাকে। তবে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটরা নির্দিষ্ট কতিপয় ক্ষেত্রে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের অধস্তন। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ছাড়াও প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির অন্যান্য ম্যাজিস্ট্রেটরাও আছেন। সরকার বা সরকারের নিয়ন্ত্রণ সাপেক্ষে প্রধান বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট স্থানীয় এলাকাগুলোর সীমা নির্ধারণ করে থাকেন যার পরিসীমার মধ্যে এই ম্যাজিস্ট্রেটরা তাদের উপর ন্যস্ত ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন।
প্রত্যেক থানায় সেই এলাকার ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব পালনের জন্য অন্ততপক্ষে একজন বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট দেয়া হয়। সিভিল সার্ভেন্ট কিম্বা জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট নন দেশের এমন যেকোন সম্ভ্রান্ত নাগরিকদেরও সরকার ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা দিতে পারেন। এমন ম্যাজিস্ট্রেটদের অনারারী ম্যাজিস্ট্রেট (শান্তির বিচারক) বলা হয় যারা বেতনভুক সিভিল সার্ভেন্ট ম্যাজিস্ট্রেটদের থেকে আলাদা। দেশ স্বাধীন হবার পর এধরনের অনারারী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দেয়ার রেওয়াজ বাদ দেয়া হয়েছে।
শ্রম আদালত
ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প শ্রমিকদের নিয়োগ সম্পর্কিত বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য শ্রম আদালত গঠন করা হয়েছে। প্রতিটি শ্রম আদালত একজন চেয়ারম্যান ও দুজন সদস্য নিয়ে গঠিত। জেলা জজ বা অতিরিক্ত জেলা জজদের মধ্য থেকে চেয়ারম্যান নিয়োগ করা হয়। সদস্যদের একজনকে মালিকদের সঙ্গে পরামর্শক্রমে এবং অপরজনকে শ্রমিকদের সঙ্গে পরামর্শক্রমে নিযুক্ত করা হয়। শ্রম আদালত শিল্পবিরোধ, মালিক-শ্রমিক সমঝোতার বাস্তবায়ন বা লঙ্ঘন, মালিক ও শ্রমিকদের পরস্পরের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ এবং ছাঁটাই, লে-অফ, নিয়োগ বাতিল, চাকরি থেকে বরখাস্ত, চাকরিতে থাকাকালে পঙ্গুত্ব বরণ হেতু ক্ষতিপূরণ ও বেতন পরিশোধ না করা সংক্রান্ত শ্রমিকদের অভিযোগ নিষ্পত্তি করে রায় দিয়ে থাকে এবং শ্রম সম্পর্কিত অন্যায্য কার্যকলাপ, সমঝোতা ভেঙে যাওয়া বা তা বাস্তবায়ন না করা, বেআইনি ধর্মঘট বা লক আউট এবং শ্রম আদালতের আদেশ না মানা সম্পর্কিত অপরাধসমূহের বিচারও করে থাকে। শ্রম আদালতের রোয়েদাদে সংক্ষুব্ধ যেকোন পক্ষ শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালে আপিল করতে পারেন। হাইকোর্ট বিভাগের চাকরিরত বা অবসরপ্রাপ্ত বিচারকদের মধ্য থেকে সরকার কর্তৃক নিযুক্ত একজন মাত্র সদস্য নিয়ে এই ট্রাইব্যুনাল গঠিত। শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালকে চাকরিচ্যুত শ্রমিক বা শ্রমিকদের চাকরিতে পুনর্বহালের রোয়েদাদের বিরুদ্ধে আপিলের নিষ্পত্তি আপিল পেশ করার ১৮০ দিনের মধ্যে করতে হয। তবে শ্রম আপিল আদালতের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কোনো আপীল করা যায় না। শ্রম আপিল আদালতের সিদ্ধান্তে কোনো পক্ষ সংক্ষুদ্ধ হয়েছে মনে করলে তিনি ঐ মামলার আইনগত বৈধতা বা যথার্থতা সম্পর্কে সন্তুষ্ট হবার উদ্দেশ্যে মামলার নথিপত্র পরীক্ষা করে দেখার জন্য রীট অব সার্টিওয়ারি ইস্যু করার ব্যাপারে হাইকোর্ট ডিভিশনে দরখাস্ত পেশ করতে পারেন। শ্রমিকের ক্ষতিপূরণের কমিশনার হিসেবে শ্রম আদালতের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট ডিভিশনে আপীল করা যেতে পারে।
পরিবেশ আদালত
বাংলাদেশে ২০০০ সালে ‘পরিবেশ আদালত আইন, ২০০০’ প্রণয়নের মাধ্যমে বিচারিক আদালতে বিশেষায়িত পরিবেশ বিচার ব্যবস্থা চালু করা হয়। আইনে প্রতিটি বিভাগে এক বা একাধিক ‘পরিবেশ আদালত’ এবং সারা দেশের জন্য এক বা একাধিক ‘পরিবেশ আপিল আদালত’ প্রতিষ্ঠার বিধান রাখা হয়। পরবর্তীতে ৬ মার্চ ২০০২ তারিখে আইন মন্ত্রণালয় একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটে (২০০৫ সাল থেকে) ১টি করে পরিবেশ আদালত এবং সমগ্র বাংলাদেশের জন্য ঢাকায় একটি পরিবেশ আপিল আদালত প্রতিষ্ঠা করে। ২০০২ সালে এ আইনে সংশোধনী এনে পরিবেশ আদালতের পাশাপাশি পরিবেশ সংক্রান্ত লঘু দণ্ডে অপরাধ বিচারের জন্য একজন মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট বা ১ম শ্রেণির জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটকে দিয়ে স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত গঠনের বিধান করা হয়।
কোর্ট অব সেটেলমেন্ট
বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর সরকার পরিত্যক্ত সম্পত্তি (নিয়ন্ত্রণ, ব্যবস্থাপনা ও বিলিব্যবস্থা) আদেশ, ১৯৭২ (রাষ্ট্রপতির ১৯৭২ সালের ১৬ নং আদেশ) জারি করেন এবং পরিত্যক্ত সম্পত্তির সংজ্ঞার আওতাভুক্ত সম্পত্তি সমূহের নিয়ন্ত্রণ, ব্যবস্থাপনা ও বিলি ব্যবস্থার দায়িত্ব গ্রহণের বিধান রাখেন। এজাতীয় সম্পত্তির ক্ষেত্রে সরকারের সিদ্ধান্ত নিয়ে বিরোধ দেখা দেয় এবং এসব বিরোধ চিরতরে দূর করার জন্য সরকার পরিত্যক্ত ভবন (সম্পূরক বিধান) অধ্যাদেশ, ১৯৮৫ এর অধীনে সকল পরিত্যক্ত ভবনের একটি তালিকা সরকারি গেজেটে প্রকাশ করার এবং এসব সম্পত্তির উপর দাবিদাওয়া কোর্ট অব সেটেলমেন্ট নামে একটি ট্রাইব্যুনালে নিষ্পত্তি করার ব্যবস্থা করেন। কোর্ট অব সেটেলমেন্ট একজন চেয়ারম্যান ও দুজন সদস্য নিয়ে সরকার কর্তৃক গঠিত। সুপ্রীমকোর্টের বিচারক বা অতিরিক্ত বিচারক পদে আছেন বা ছিলেন কিংবা এই পদ ধারণ করার যোগ্যতা রাখেন এমন ব্যক্তিদের মধ্য থেকে চেয়ারম্যান নিযুক্ত করা হয়। দুই সদস্যের একজনকে অতিরিক্ত জেলা জজের পদমর্যাদার নিচে নয় এমন অফিসার যারা আছেন বা ছিলেন তাদের মধ্য থেকে এবং অপর সদস্যকে সরকারের উপসচিবের পদমর্যাদার নিচে নয় এমন অফিসার যারা আছেন বা ছিলেন তাদের মধ্য থেকে নিয়োগ দেয়া হয়। কোনো সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি পরিত্যক্ত ভবনের তালিকা থেকে তার সম্পত্তি বাদ দেয়ার জন্য কোর্ট অব সেটেলমেন্টের কাছে আবেদন করলে কোর্ট সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর বক্তব্য শুনে এবং উপস্থাপিত সাক্ষ্যপ্রমাণ বিচার বিবেচনা করে আবেদনের নিষ্পত্তি করেন। কোর্ট অব সেটেলমেন্টের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কোনো আপীল করা যায় না। তবে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি কোর্ট অব সেটেলমেন্টের সিদ্ধান্তের আইনগত বৈধতা বা যথার্থতা সম্পর্কে সন্তুষ্ট হবার জন্য মামলার নথিপত্র পরীক্ষা করে দেখার উদ্দেশ্যে হাইকোর্ট বিভাগের কাছে রীট অব সার্টিওয়ারি ইস্যুর আবেদন পেশ করতে পারেন।
সালিশি ট্রাইব্যুনাল ও সালিশি আপীল ট্রাইব্যুনাল
সরকার যেকোন ব্যক্তির মালিকানাধীন জমি বা ভবন সরকারি উদ্দেশ্যে বা জনস্বার্থে হুকুমদখল বা অধিগ্রহণ করতে এবং ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তাদের নিরূপিত মূল্য অনুযায়ী এমন জমি বা ভবনের মালিক ও দখলদারদের ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে পারেন। ক্ষতিপূরণ নিরূপণের আদেশে সংক্ষুব্ধ কোনো ব্যক্তি যুগ্ম জেলা জজের পদমর্যাদার নিচে নয় এমন পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিদের মধ্য থেকে সরকার কর্তৃক নিযুক্ত সালিশকারীর কাছে আবেদন পেশ করতে পারেন। সালিশকারীর রোয়েদাদের বিরুদ্ধে সালিশি আপিল ট্রাইব্যুনালে আপিল করা যেতে পারে। জেলা জজ পদে রয়েছেন বা ছিলেন এমন ব্যক্তিদের মধ্য থেকে একজন সদস্য নিয়োগ করে এই সালিশি আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। ক্ষতিপূরণের পরিমাণ নির্ণয় করে সালিশি আপিল ট্রাইব্যুনালের দেয়া সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।
সংক্ষুদ্ধ ব্যক্তি সালিশী আপীল ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্তের আইনগত বৈধতা বা যথার্থতা নিয়ে সন্তুষ্ট হবার উদ্দেশ্যে মামলার নথিপত্র পরীক্ষা করে দেখার জন্য হাইকোর্ট বিভাগের কাছে রীট অব সার্টিওয়ারি ইস্যুর আবেদন পেশ করতে পারেন। ক্ষতিপূরণের পরিমাণ সম্পর্কিত প্রশ্নের নিষ্পত্তি করার জন্য সাধারণত জেলা আদালতের একজন যুগ্ম জেলা জজকে সালিশকারী হিসেবে এবং সেই জেলার জেলা জজকে সালিশি আপীল ট্রাইব্যুনাল হিসেবে নিয়োগ করা হয়।
এছাড়াও অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ ট্রাইব্যুনাল ও আপীল ট্রাইব্যুনাল, ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনাল ও আপীল ট্রাইব্যুনাল রয়েছে।
বিশেষ ক্ষেত্রে বিচার ট্রাইব্যুনাল
বাংলাদেশে বিশেষ ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট এখতিয়ার দিয়ে বিচার বিভাগীয় বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়। এগুলর মধ্যে রয়েছে- আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল, নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল, প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত একটি অপরাধ ট্রাইবুনাল যার উদ্দেশ্য হচ্ছে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে সংঘটিত আন্তর্জাতিক অপরাধসমূহের বিচার করা। এর আওতায় পড়ে যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এবং শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ। বাংলাদেশে ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক ইশতেহার ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু করা। সে নির্বাচনে তারা নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে বিজয়ী হয়। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আওয়ামী লীগের একজন সাংসদ ২০০৯ সালের ২৯শে জানুয়ারি জাতীয় সংসদে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রস্তাব পেশ করলে তা সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। অবশেষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের ৩৯ বছর পর যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্তদের বিচারের জন্য ২০১০ সালের ২৫শে মার্চ ট্রাইবুনাল, আইনজীবী প্যানেল এবং তদন্ত সংস্থা গঠন করা হয়।
নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল
বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচন সংক্রান্ত অভিযোগ আমলে নিতে হাইকোর্টের নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়। তাছাড়া স্থানীয় সরকার নির্বাচন সংক্রান্ত অভিযোগ গ্রহণ ও নিষ্পত্তিতে বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তার কর্তৃত্বে নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল গঠন করে নির্বাচন কমিশন।
প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল
সরকার প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছেন। জেলা জজ পদে ছিলেন বা আছেন এমন ব্যক্তিদের মধ্য থেকে সরকার কর্তৃক নিযুক্ত একজন সদস্য নিয়ে এধরনের প্রতিটি ট্রাইব্যুনাল গঠিত। প্রজাতন্ত্রের চাকুরিতে (প্রতিরক্ষা বাহিনীতে নিযুক্ত ব্যক্তি বাদে) কিম্বা বাংলাদেশ ব্যাংক ইত্যাদির মতো সুনির্দ্দিষ্ট কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানে নিযুক্ত কোনো ব্যক্তি পেনশনের অধিকার সহ তার চাকরির শর্তাবলির ব্যাপারে কিংবা এমন চাকরিতে ব্যক্তি হিসেবে তার ক্ষেত্রে গৃহীত কোনো পদক্ষেপ সম্পর্কে আবেদন পেশ করলে তা শোনার ও নিষ্পত্তি করার একক এখতিয়ার প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের রয়েছে।
প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক আপিল ট্রাইব্যুনালে আপিল করা যেতে পারে। এই আপিল ট্রাইব্যুনাল একজন চেয়ারম্যান ও দুজন সদস্য নিয়ে গঠিত। চেয়ারম্যান হবেন এমন একজন ব্যক্তি যিনি সুপ্রীম কোর্টের বিচারক পদে আছেন বা ছিলেন কিংববা বিচারক হবার যোগ্যতাসম্পন্ন অথবা তিনি প্রজাতন্ত্রের চাকরিতে নিযুক্ত এমন একজন অফিসার পদে আছেন বা ছিলেন যার পদমর্যাদা সরকারের অতিরিক্ত সচিবের নিচে নয়। সরকার সুপ্রীম কোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারককে চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ দিয়ে থাকেন। একজন সদস্যকে অবসরপ্রাপ্ত বা চাকরিরত জেলা জজদের মধ্য থেকে এবং অপরজনকে অবসরপ্রাপ্ত বা চাকরিরত যুগ্ম সচিবদের মধ্য থেকে নিয়োগ করা হয়। প্রশাসনিক আপীল ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপীল সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগের কাছে ঐ বিভাগের অনুমতিক্রমে পেশ করা যায়।
উপরোক্ত আদালত সমূহের বাহিরে আরও রয়েছে- গ্রাম আদালত ও ভ্রাম্যমাণ আদালত
গ্রাম আদালত
বাংলাদেশে বিচার ব্যবস্থার সর্বনিম্ন স্তর হচ্ছে গ্রাম আদালত। গ্রামাঞ্চলের কিছু কিছু মামলার নিষ্পত্তি এবং তৎসর্ম্পকীয় বিষয়াবলীর বিচার সহজলভ্য করার উদ্দেশো গ্রাম আদালত অধ্যাদেশ, ১৯৭৬ (বর্তমানে গ্রাম আদালত আইন, ২০০৬) এর আওতায় গঠিত একটি মীমাংসামূলক আদালত।
ভ্রাম্যমাণ আদালত
বাংলাদেশে বিচার বিভাগের আওতার বাহিরে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দ্বারা পরিচালিত বিশেষ বিচার ব্যবস্থা হলো ভ্রাম্যমাণ আদালত। মোবাইল কোর্ট আইন, ২০০৯ দ্বারা পরিচালিত হয়।
এই আদালতে অপরাধীর বিচার দ্রুত করা হয়। ম্যাজিস্ট্রেট এবং আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ভ্রাম্যমাণ আদালতে অংশ নেয়। তবে ভ্রাম্যমাণ আদালতে শিশুদের শাস্তি দেওয়া যায় না।
তথ্যসূত্র- উইকিপিডিয়া